Apan Desh | আপন দেশ

ঢাকায় অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ ভবন, এতেই খুশি দায়িত্বশীল সংস্থার কর্মকর্তারা!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১২:৪১, ১০ মার্চ ২০২৩

আপডেট: ১৪:৫৬, ১০ মার্চ ২০২৩

ঢাকায় অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ ভবন, এতেই খুশি দায়িত্বশীল সংস্থার কর্মকর্তারা!

ফাইল ছবি

রাজধানীতে প্রায়শই বিভিন্ন ভবনে দুর্ঘটনা হচ্ছে। এর মাঝে কোনো কোনো ভবন ধসে পড়ছে। মাঝে মাঝে ঘটছে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেক ভবন হেলে পড়ছে। তারপর শুরু হয় তোড়জোড়। কেন এমনটি হলে খোঁজ চলে। চলে আরো কিছু কার্যক্রম। নানা দৌড়ঝাপ, তদন্ত কমিটি, গণমাধ্যমের প্রতিবেদন, নানা আলোচনা-সমালোচনা।

দুর্ঘটনার পর ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত রাজধানীতে কত ভবন ঝুঁকিপূর্ণ এর প্রকৃত হিসাব কারো কাছে নেই।

সংশ্লিষ্ট সরকারি দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর উদাসীনতায় প্রায় প্রতিদিন ঘটছে এসব দুর্ঘটনা। অন্যদিকে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। যদিও কেন ঘটছে এসব ঘটনা, তা নিয়ে নেই বলার মতো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ। অভিযোগ আছে, ভবন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তাদের পকেট ঠিকই ভারি হয়। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজধানীর অধিকাংশ ভবনের সুরক্ষা নেই। ঝুঁকিতে থাকা এসব ভবনে রয়েছে বিভিন্ন আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। সেপটিক ট্যাংক, স্যুয়ারেজ লাইন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসলাইন সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে না। অথচ আবাসিক ভবনগুলোর অ্যাপার্টমেন্ট মালিক ও ভাড়াটিয়া, শপিংমল ও মার্কেটের দোকান মালিক ও ভাড়াটিয়ারা নিয়মিত রক্ষণাবক্ষেণের জন্য টাকা দিয়ে আসছেন। ভবনের মাটির নিচের জলাধারের ধারণক্ষমতা রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। তদারকি সংস্থাগুলোরও নজরদারি নেই।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বলছে, রাজধানীতে অন্তত ৯০ শতাংশ ভবন তৈরির ক্ষেত্রে নকশা পুরোপুরি মানা হয়নি। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুসরণ করা হয় না। 

২০১৮ সালে তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন রাজধানীতে ৩২১ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ বলে জাতীয় সংসদকে জানিয়েছিলেন। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজউক জানিয়েছিল, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ১৫৫। ২০১৬ সালের ১৭ মে ফায়ার সার্ভিসের তৎকালীন মহাপরিচালক আলী আহাম্মেদ খান জানান, নগরীতে ১১০ ভবন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এর আগে ২০০৯ সালে এক জরিপের বরাত দিয়ে রাজউক জানিয়েছিল, রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন প্রায় ৭২ হাজার। সর্বশেষ বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা শহরে সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল-পুলিশ স্টেশনের ভবনগুলোর ওপর জরিপ চালায়। এতে তিন হাজার ২৫২ ভবনের ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট করা হয়। এর মধ্যে ১৮৭ ভবন পাওয়া যায়, যেগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও রেট্রোফিটিংয়ের মাধ্যমে নিরাপদ করা সম্ভব। আর ৪২টি ভবন এতই ঝুঁকিপূর্ণ যে সেগুলোকে অপসারণ করার কথা বলা হয়।

২০২১ সালের ২৭ জুন সন্ধ্যায় রাজধানীর মগবাজারে একটি তিনতলা ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে দুই শতাধিক লোক আহত হয়। মারা যায় ১২ জন। ঘটনাস্থলে অসংখ্য যানবাহন ও ভবন এই বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই বিস্ফোরণে আশপাশের অনেক ভবন কেঁপে ওঠে। গ্যাসলাইন লিকেজ থেকে ওই বিস্ফোরণ হয় বলে তদন্তসংশ্লিষ্টদের ভাষ্য। 

চলতি সপ্তাহে চারটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৩০ জন। যেখানে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবে একটি ভবনে বিস্ফোরণে তিন জন মারা যাওয়ার ক্ষতই এখনো শুকায়নি, সেখানে ওই ঘটনার দুই দিন পরই বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে সিদ্দিকবাজার। গত মঙ্গলবার বিকালে পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারে সাততলা একটি ভবনে বিস্ফোরণে এখন পর্যন্ত ২২ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। এই সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বুয়েটের একাধিক বিশেষজ্ঞ, রাজউকের শীর্ষ কর্মকর্তা ও সিদ্দিকবাজারের ঘটনার একাধিক তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ক্যাফে কুইন ভবন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তবে শুরুতে ছিল তিনতলা ভবন। পরে তা আরো চারতলা বাড়ানো হয়। কিন্তু রাজউক কিছুই জানে না। তারা বলে, ভবনের মাটির নিচের জলাধার, পাইপলাইন, গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন প্রতি তিন মাস অন্তর রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। কিন্তু অধিকাংশ ভবনে তা মানা হচ্ছে না। 

আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের পরিচালক ও রাজউকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ড. আব্দুল লতিফ হেলালী বলেন, ঢাকা শহরের সব ভবনেরই ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট করা দরকার। এটি করতে অনেক সময় ও অর্থের দরকার। 

রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিক বলেন, রাজউকের অ্যাসেসমেন্টে চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়া হয়েছে। তাদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, বিভিন্ন কারণেই ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। হয়তো একটি ফ্ল্যাট নকশায় দেড় হাজার বর্গফুট হওয়ার কথা। সেখানে ১০০ বর্গফুট বাড়ানো হলে সেটাও এক ধরনের ঝুঁকি তৈরি করে।

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশনের (রিহ্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি কামাল মাহমুদ বলেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবনের চেয়ে রিহ্যাব সদস্যদের তৈরি করা ভবন অনেক মানসম্মত। এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ড ছাড়া রিহ্যাবের কোনো ভবনে কখনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মেহেদি হাসান আনসারী বলেন, ঢাকা শহরে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা বিক্ষিপ্তভাবে হয়েছে। সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে কারিগরিভাবে কখনো হয়নি। সময় এসেছে, এখন সেটি করতে হবে। সিটি করপোরেশন, তিতাস, ডিপিডিসি, ওয়াসা, রাজউক- কোনো সংস্থাই বিস্ফোরণের দায় এড়াতে পারে না। 

তিনি বলেন, ঝুঁকি যাচাইয়ের জন্য সব ভবনের তথ্য চাওয়ার অধিকার রাজউকের রয়েছে। রাজউক শর্ত দিয়ে দেবে- কোন কোন জিনিস না থাকলে ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হবে। এসব শর্ত ভবন মালিকরা পূরণ করবেন। নাহলে ভবন ব্যবহার বাতিল করে দিতে পারে রাজউক। এমন কড়াকড়ি না করলে কখনো নিরাপদ নগর গড়ে উঠবে না।

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ও নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘ভবন ব্যবহারের ছাড়পত্র দেয় রাজউক। ভবন মালিকরা ব্যত্যয় ঘটিয়েছে কিনা, সেটি দেখার দায়িত্ব কার? রাজউকের অথরাইজড অফিসার কি ভবন পরিদর্শনে যান? আসলে জবাবদিহি নেই বলে রাজউক এমন দায়সারা কথা বলে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাতে ব্যস্ত।’

আপন দেশ/আরএ

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ