Apan Desh | আপন দেশ

সুইসাইড নোটে গৃহবধূ জ্যোতির লেখা, ‘আমার মৃত্যুর বিচার চাই’

সৈয়দপুর, নীলফামারী প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১৭:৪৯, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২

আপডেট: ০০:৩২, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২

সুইসাইড নোটে গৃহবধূ জ্যোতির লেখা, ‘আমার মৃত্যুর বিচার চাই’

জ্যোতি

আভিজাত্যের আড়ালে লুকিয়ে ছিল লোমহর্ষক কাহিনী। নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরে। মারোয়াড়ী গৃহবধূকে তার জন্মদিনে মৃত্যুকে আলিঙ্গণ করতে হল। তবে যাবার আগে লিখে গেছেন সুইসাইড নোট। দিয়েছেন এই প্রভাবশালী পরিবারের বর্বরতার লোমহর্ষক বর্ণনা। যা চলছিল টানা ২১ বছর। এই বধূর নাম জ্যোতি আগরওয়ালা। স্বামীর নাম নিক্কি আগরওয়ালা। শ্বাশুড়ি-স্বামী ও দেবরের অমানুষিক অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহত্যা চেষ্টাে করেছিলেন জ্যোতি। সেদিন মরেনি; তবে তিনি যা চেয়েছিলেন তা-ই হলো।

রোববার (১৮ সেপ্টেম্বর) সকালে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান জোতি। মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে স্বামীসহ পরিবারের লোকজন গা ঢাকা দিয়েছে।

মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে তিনদিন ধরে হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিলেন দুই সন্তানের জননী ওই অসহায় নারী। তার নিজের হাতে লেখা সুইসাইড নোটে উঠে এসেছে আভিজাত্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা নির্যাতনের নানা অভিযোগ। সৈয়দপুরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সন্তান ও ব্যবসায়ী সুমিত কুমার আগারওয়াল নিক্কির স্ত্রী ছিলেন জ্যোতি আগরওয়াল। 

জানা যায়, কয়েকদিন আগে তার উপরে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে দুই পৃষ্ঠার একটি চিঠি লিখে তা ছবি তুলে সৈয়দপুর হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের কাছে ম্যাসেঞ্জারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় জ্যোতি। এনিয়ে কেউ তার উপর অত্যাচারের বিষয়ে সুরাহা করতে না পারায় বৃহস্পতিবার (১৫ সেপ্টেম্বর)  শহরের শহীদ ডা. বদিউজ্জামান রোডের ভাড়া বাসায় গভীর রাতে মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। ঘটনাটি জ্যোতির স্বামী নিক্কি আগরওয়ালাসহ পরিবারের সদস্যরা টের পেয়ে যায়। তাকে হাসপাতালে না নিয়ে বাড়িতেই চিকিৎসা দেয় নিক্কির ছোট ভাই অমিত কুমার আগারওয়ালার স্ত্রী ডা. অমৃতা কুমারী আগারওয়াল। 

কিন্তু অবস্থার অবনতি হওয়ায় পরদিন শুক্রবার (১৬ সেপ্টেম্বর) জ্যোতিকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তিনদিন নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকা অবস্থায় আজ রোববার সকালে মারা যান তিনি। 

দুই পৃষ্ঠার সুইসাইড নোটে লেখা জ্যোতি তার মৃত্যুর জন্য চারজনকে দায়ী করেছেন। তারা হলেন, স্বামী সুমিত কুমার আগরওয়ালা নিক্কি, শ্বাশুড়ি উমা দেবী, দেবর অমিত কুমার আগরওয়ালা ও দেবরের স্ত্রী ডা. অমৃতা কুমারী। নোটে তার দুই সন্তান নির্দোষ বলে তুলে ধরেছেন। 

সুইসাইড নোটে ২০০১ সালের ১২ ডিসেম্বর তার বিয়ে হয়েছে উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘বিয়ের পর থেকেই শ্বাশুড়ি ও স্বামী-দেবর মানসিক নির্যাতন করে আসছিল। দেবরের বিয়ের পর জা অমৃতাও তাদের সাথে যোগ দেয়। তারা আমাকে চারবার মেরে ফেলার চেষ্টাও করেছে। আমার গয়না ও জমানো টাকা নিয়েছে। ফেরত দেবে বলে আজও দেয়নি। বরং টাকা ও গয়নার কথা বললেই অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। পিতা-মাতা হারিয়ে ভাই বোনদের জন্য বেঁচে থাকতে চেয়েছিলাম।শ্বাশুড়ি উমা দেবী আমাকে কখনো ভালবাসেনি। তিনি উল্টাপাল্টা বলে তার ছেলে সুমিতের কান ভরতো। এমনকি আমার সন্তানদেরকেও ভয় দেখিয়ে রাখতো। জ্যোতি তার সন্তানদের রক্ষার আকুতি জানিয়েছে ওই নোটে।

দীর্ঘ নোটে তিনি আরও লিখেছেন, ‘মানুষ মৃত্যুর সময় কখনো মিথ্যে বলেনা। বিশ্বাস না হলে কাজের লোক ও পাড়া প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করে দেখবেন। আমার শ্বাশুড়ি অনেক অত্যাচার করেছে। ২১ বছরে কান্না ছাড়া কোন সুখ পাইনি। আমার মৃত্যুর বিচার চাই। 

সূত্র জানায়, জ্যোতি আগারওয়ালের বাবার বাড়ি নারায়ণগঞ্জ। তার স্বামী সুমিত কুমার আগারওয়াল নিক্কি সৈয়দপুর উপজেলা হিন্দু কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের সিনিয়র সহ-সভাপতি। সে দানবীর ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ তুলশীরাম আগারওয়ালার নাতি ও একসময়ের বিশিষ্ট পাট ব্যবসায়ী প্রয়াত সুশীল কুমার আগারওয়ালার বড় ছেলে। 

এদিকে ব্যবসায়ীর স্ত্রী জ্যোতির মৃত্যু ঘটনায় শহরজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে এবং সুইসাইড নোটের কথাগুলো ছড়িয়ে পড়ায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। মাড়োয়ারি সম্প্রদায়সহ ব্যবসায়ী মহল ও  সাধারণ মানুষের মাঝেও সমালোচনার ঝড় তুলেছে পারিবারিক নির্যাতন ও আত্মহননের বিষয়টি। 

এ বিষয়ে জানতে জ্যোতির স্বামী সুমিত কুমার আগারওয়ালা নিক্কির মুঠোফোনে কল দেওয়া হলে তার ফোন বন্ধ থাকায় কোন মন্তব্য জানা যায়নি। তার বাড়িতে গিয়েও কাউকে পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে জ্যোতির ভগ্নিপতি কালিচরণের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, জ্যোতি সুইসাইড নোটে যা লিখেছে সেটাই বক্তব্য। এর বাইরে আপাতত আলাদা কোন বক্তব্য নেই।

এব্যাপারে সৈয়দপুর থানার অফিসার ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম বলেন, মৃত্যুর খবর শুনেছি। রংপুরে ময়নাতদন্ত শেষে মৃতের পরিবারের লোকজন জানিয়েছেন সৈয়দপুরে মামলা করা হবে।  মামলার পরই তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

 

আপন দেশ ডটকম/ আবা

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়