Apan Desh | আপন দেশ

রোজার আগেই বাজার গরম

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৫:২১, ১০ মার্চ ২০২৩

আপডেট: ২০:২০, ১০ মার্চ ২০২৩

রোজার আগেই বাজার গরম

ফাইল ছবি

প্রতি রমজানেই দেশে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। অথচ মুসলমানদের সিয়াম সাধনার মাসটি শুরুর আগে প্রতি বছরই সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা আশ্বাস দেন নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক থাকবে। 

এবারো এমন আশ্বাস ছিল। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর মতবিনিময় সভা এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের একাধিক বৈঠকে ব্যবসায়ীরা আশ্বাস দিয়েছিলেন, রমজান ঘিরে নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে না। সেই আশ্বাস শুধু কথাতেই সীমাবদ্ধ। কাজে কিংবা বাস্তবে মিলছে না। 

রমজান শুরু হওয়ার আগে আরেক দফা বেড়েছে কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম। ইফতারিতে ব্যবহৃত পণ্যের দাম বেড়েছে বেশি। এ ছাড়া মাছ, মাংস, ডিম ও সবজির মতো অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। রমজানে ইফতারি তৈরিতে সাধারণত ছোলা, অ্যাঙ্কর ডাল ও বেসন বেশি ব্যবহার হয়। রোজার দুই সপ্তাহ বাকি থাকলেও এরই মধ্যে বেড়ে গেছে এসব পণ্যের দাম। 

এদিকে রমজান সামনে রেখে বাজারে অস্বস্তি বাড়ায় উদ্বেগ বাড়ছে নিম্নআয়ের মানুষের। নিত্যপণ্যের বাড়তি দামে নাভিশ্বাস উঠছে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভোক্তাদের। এ-দোকান ও-দোকান ঘুরেও সাধ্যের মধ্যে প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারছেন না অনেকে। প্রতিদিনের ডাল-ভাতের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অনেকে অতি প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে চুপচাপ বাজার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, গত এক মাসে ছোলার দাম প্রায় ছয় এবং এক বছরে ২৩ শতাংশ বেড়েছে। এ ছাড়া অ্যাঙ্কর ডাল এক বছরে কেজিতে দাম বেড়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশ।

আমদানিকারকরা জানান, দেশে বছরে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টন খেজুরের চাহিদা রয়েছে। এর পুরোটাই আমদানি হয় মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশ থেকে। সারাবছর যে খেজুর প্রয়োজন, এর চেয়ে তিন থেকে চার গুণ চাহিদা বাড়ে রমজানে। এ সময় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টন খেজুরের দরকার হয়। তবে ডলার সংকটে এ বছর আমদানিকারকদের অনেক দেরিতে এলসি খুলতে হয়েছে। ডলারের দামও গুনতে হয়েছে বেশি। 

টিসিবির বাজারদর বলছে, খেজুরের দাম এক বছরে বেড়েছে ২০ শতাংশ। বাজারে বাড়ার কারণে টিসিবির সাশ্রয়ী খেজুরের দামও কেজিতে ২০ টাকা বাড়ানো হয়েছে।

করোনার পর থেকে ভোজ্যতেলের বাজারে শুরু হওয়া অস্থিরতা এখনো চলছে। বেশিরভাগ সময় সরকারের বেঁধে দেয়া দাম উপেক্ষিত হয় বাজারে। ১৫ থেকে ২০ দিন ধরে পাইকারি বাজারে খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েলের দর দুই-এক টাকা করে বাড়ছে। খুচরা বাজারেও এর প্রভাব দেখা গেছে। সরকার প্রতি লিটার খোলা পাম অয়েলের দর ১১৭ টাকা নির্ধারণ করলেও খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা। একইভাবে সরকার নির্ধারিত ১৬৭ টাকার প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৭২ থেকে ১৭৫ টাকায়। তবে বোতলজাত সয়াবিন তেলের লিটার নির্ধারিত ১৮৭ টাকায় বিক্রি করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশে ১৮ থেকে ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে তিন থেকে চার লাখ টন তেলের দরকার হয় রমজানে।

আরও পড়ুন<> দাম চড়া তাই গরুর টুকরা, মুরগীর বন্ট বিক্রি হচ্ছে!

গত ছয় মাসে চারবার দাম বাড়ানোর পরও চিনির বাজারের হৈচৈ থামেনি। এরপরও আমদানিকারকদের দাবির মুখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চিনি আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশে নামিয়েছে। একই সঙ্গে প্রতি টন অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে তিন হাজার টাকা এবং পরিশোধিত চিনিতে ছয় হাজার টাকা আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করেছে। 

আমদানিকারক ও বাজারজাতকারীদের তথ্যমতে, শুল্ক ছাড়ের এই সুবিধার আওতায় চিনি আমদানি হলে কেজিতে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ টাকা পর্যন্ত দাম কমতে পারে। তবে বাজারে দাম কমেনি। এখনও খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি খোলা চিনি ১১৫ থেকে ১২০ এবং প্যাকেটজাত চিনি ১১২ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া লাল চিনি (দেশি) বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা দামে। সরকারি হিসাবে গত এক বছরে চিনির দাম প্রায় ৪৯ শতাংশ বেড়েছে।

এদিকে, এবার বেশ স্বস্তি ছিল পেঁয়াজে। তবে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে পাঁচ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৩০ থেকে ৪০ এবং আমদানি করা পেঁয়াজ ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে মাছ-মাংস এখন অনেকটাই স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। মধ্যবিত্তরাও মাছ-মাংস কিনতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ছেন। মুরগির বাজার দেড় মাস ধরেই অস্থির। দফায় দফায় বেড়ে ব্রয়লারের কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা এবং সোনালি জাতের মুরগি ৩৩০ থেকে ৩৪০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। ডিমের বাজারও কিছুটা বেশি। প্রতি হালি ডিম বিক্রি হচ্ছে ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা। শবেবরাতের আগে গরুর মাংসের কেজি ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকায় বিক্রি হলেও শবেবরাতের দিন দাম বেড়ে যায়। ওই দিন ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে গরুর মাংস। হাত দেয়া যাচ্ছে না মাছে। তেলাপিয়া, পাঙাশ ও চাষের কই মাছ বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। মানভেদে রুই-কাতলার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। চিংড়ি আর ইলিশ কেনা এখন বিলাসিতা। আকারভেদে চিংড়ি ৬০০ থেকে এক হাজার টাকা এবং ইলিশ ৭০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। টিসিবির তথ্য বলছে, এক বছরে ব্রয়লারের দাম ৮৫, গরুর মাংস, ডিম ১৬ এবং রুই মাছের দাম প্রায় ৩৫ শতাংশ বেড়েছে।

লেবু আমদানি করা লাগে না। দেশের উৎপাদন দিয়েই মেটে চাহিদা। লেবুর সঙ্গে ডলারেরও কোনো সম্পর্ক নেই। তবু হঠাৎ করে অস্থির লেবুর বাজার। অস্বাভাবিক দাম বেড়ে এক হালি লেবু আকারভেদে বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত। সে হিসাবে প্রতিটি লেবুর দাম পড়ছে প্রায় ১৩ থেকে ২০ টাকা। তবে বড় বাজারগুলোতে কিছুটা কম দামে মিলছে লেবু। 

বছরের অন্য সময়ের চেয়ে রমজানে বেগুনের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। এ জন্য রমজানের আগেই আগুন লেগেছে বেগুনের। গোল বেগুনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা দরে। তবে লম্বা বেগুন কিছুটা কমে ৫০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে শসার টান নেই। তবু দাম তুলনামূলক বেশি। মানভেদে ৫০ থেকে ৭০ টাকা দরে শসা বিক্রি হচ্ছে। কাঁচামরিচের দামও কিছুটা চড়া। মাঝে কয়দিন কমে আবার বেড়েছে দাম। খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি মরিচ বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে।

রাজধানীর তালতলা বাজারের মুদি ব্যবসায়ী হোসেন মিয়া বলেন, সবকিছুর দাম বাড়তিই আছে। নতুন করে আর কী বাড়বে? এ দেশে কোনোকিছুর দাম বাড়লে আর সেটি কমে না।

বাংলাদেশ ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শফি মাহমুদ জানিয়েছেন, রমজানের আগেই ছোলা আমদানি করে রাখেন ব্যবসায়ীরা। একই সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি নাসের উদ্দিন খান বলেন, অস্ট্রেলিয়া-কানাডা থেকে যেসব ছোলা আগে এসেছিল, সেগুলোর দাম বেশি পড়েছে। ফলে বাজারে সেগুলোর দাম বেশি থাকতে পারে। তবে এখন ভারত থেকে অনেক ছোলা ঢুকছে। দামও তুলনামূলক কম। 

বাংলাদেশ ফ্রেস ফ্রুটস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘দাম আগের মতোই আছে। নতুন করে পাইকারি বাজারে বাড়েনি। তবে মনে হয়, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। কারণ, পাইকারি বাজারে বেচাকেনা আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে।’

বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বলেন, রমজানে ভোজ্যতেলের চাহিদা কিছুটা বাড়ে। কয়েক দিন ধরে মিল পর্যায়ে দাম বেড়ে গেছে।

জাতীয় ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, বারবার সভা করে প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা রাখেননি ব্যবসায়ীরা। অধিদফতরের আইন অনুযায়ী বাজারে তদারকি চলছে। এটি আরো জোরদার হবে। ব্রয়লারের বাজারে তদারকি জোরদার করা হয়েছে। 

এফবিসিসিআইর সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, আমদানি করা জিনিসগুলোর দামই বেশি বেড়েছে। বাড়ার পেছনে যুক্তিও আছে। ৮৫ টাকার ডলারের দাম বেড়ে হয়েছে ১১২ টাকা। এই দর দিয়ে ব্যবসায়ীদের পণ্য আমদানি করতে হয়েছে। অর্থাৎ প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে ডলারের দাম। ডলারের দাম বাড়ার কারণে তাদের শুল্কও বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে। সে হিসাবে পণ্যের দামও ৩০ শতাংশ বাড়ার কথা। এ ছাড়া এর সঙ্গে পরিবহন, শ্রমিকের মজুরি ও উৎপাদন খরচ বেড়েছে। পণ্য বিক্রি করেই তো ব্যবসায়ীকে সেসব খরচ সামাল দিতে হবে। মুনাফাও করতে হবে। ব্যবসায়ীরা তো লোকসান দিয়ে পণ্য বিক্রি করতে পারবে না।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, রমজানে কোনো পণ্যের ঘাটতি নেই। পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। তবে আমদানিনির্ভর পণ্যের বাজারদর নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক বাজারদরের ওপর। সেক্ষেত্রে দেশীয় বাজার পরিস্থিতি কেমন হবে তা সময়ই বলে দেবে।

আপন দেশ/আরএ

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়