Apan Desh | আপন দেশ

এটি আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়!

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১২:৩২, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

আপডেট: ১২:৪১, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

এটি আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়!

আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

একটি টিনের চাল। চালের নিচে পেতে রাখা কয়েকটি বেঞ্চ। বেড়া-দরজা-জানালার কোনো বালাই নেই। চারদিকে কৃষি জমি। ধান রোপণে ব্যস্ত কৃষকরা।

প্রথম দেখায় মনে হতেই প্রখর রোদে কাজ করা ক্লান্ত কৃষকের বিশ্রামের জন্য এই টিনের চালাটি তৈরি করা হয়েছে। ওই টিনের চালার সামনের সাইনবোর্ড আর বাঁশের খুঁটির শীর্ষে জাতীয় পতাকা বলছে ভিন্ন কথা। সেই টিনের চালাটিই কি না একটি বিদ্যালয়! সেটাও আবার সরকারি। ন্যূনতম একটি দোচালা ঘরের অবকাঠামো থাকার কথা আছে বিধানে।   

এ স্কুলটি কুড়িগ্রাম সদরের মোগলবাসা ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর মৌজার উত্তর মাঝেরচরের। নাম আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০০৪ সালে। সে হিসাবে প্রতিষ্ঠার প্রায় দুই দশক হতে চলল ‘আদর্শ’ এই প্রাথমিক বিদ্যালয়টির। এর মধ্যে একবার বিদ্যালয়টি স্থানান্তর হয়েছে। তবে এই দীর্ঘ সময়েও একটি টিনের ঘরও তৈরি করা সম্ভব হয়নি বিদ্যালয়টির জন্য।

দেখা গেল, বিদ্যালয় নামের ওই টিনের চালার নিচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে কয়েকটি কাঠের বেঞ্চ আর প্লাস্টিকের চেয়ার। একটি টেবিল পেতে সেখানে বসে রয়েছেন কয়েকজন শিক্ষক আর অভিভাবক। টেবিলের ওপর রয়েছে হাজিরা খাতা। সামনেই বাঁশের খুঁটিতে উড়ছে জাতীয় পতাকা। এর সামনে সাইনবোর্ডে লেখা ‘উত্তর মাঝেরচর আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। এই সাইনবোর্ড ছাড়া শিক্ষার্থীদের কোলাহল কিংবা পাঠদানের ব্যস্ততার কোনো নজিরই নেই। থাকবেই বা কী করে, বিদ্যালয়টিতে যে শিক্ষার্থীই নেই।

স্থানীয়রা জানালেন, এই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করতে আগ্রহী নন তাদের কেউ। কেননা বিদ্যালয়ে নেই কোনো শ্রেণিকক্ষ। শুধু তা-ই নয়, বিদ্যালয়ে যাওয়ার রাস্তাই যে নেই। সেখানে যেতে হয় জমির আইল বেয়ে পায়ে হেঁটে। বাস্তব চিত্র এমন হলেও খাতা-কলমে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা ৮০ জন, শিক্ষক রয়েছেন পাঁচজন।

২০০৪ সালে বেসরকারিভাবে গঠিত উত্তর মাঝের চর আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়। নিচু স্থান হওয়ায় ওই জায়গাটি বন্যার পানিতে ডুবে থাকে বছরের অধিকাংশ সময়। তাই ২০১১ সালে পাশেই উত্তর মাঝের চর গ্রামে একটু উঁচু স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় বিদ্যালয়টি। এরপর ২০১৮ সালে বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ হয়। গত বছরের বন্যায় ধরলা নদীর ভাঙনে একই ইউনিয়নের পাশের চর কৃষ্ণপুর গ্রামের চর কৃষ্ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভেঙে যায়। এরপর সেই বিদ্যালয়টিও স্থানান্তরিত করা হয় উত্তর মাঝের চর গ্রামেই। পাশাপাশি দুটি বিদ্যালয়ের অবস্থান হওয়ায় উত্তর মাঝের চর আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে আগের জায়গায় স্থানান্তরের নির্দেশ দেয় উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস। এরপর থেকেই বিদ্যালয়ের এমন চিত্র হলেও কর্তৃপক্ষের নজর নেই। বিদ্যালয়ের পরিবেশ না থাকায় সন্তানদের ভর্তি করাচ্ছেন না অভিভাবকরাও।

বিদ্যালয়টির সহকারী শিক্ষক আশরাফিয়া বিনতে আকতার বলেন, বিদ্যালয়ে আসার কোনো পথ নেই। জমির আইল দিয়ে আসা-যাওয়া করতে হয়। এ জন্য বাচ্চারা বিদ্যালয়ে আসে না। বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ৮০ জন শিক্ষার্থী আছে। এর মধ্যে ১০-১৫ জন শিক্ষার্থী আসে। জমির আইল ভেজা থাকায় প্রায় সময় পিছলে পড়ে বাচ্চারা আহত হয়, পোশাক নষ্ট হয়ে যায়।

অভিভাবক সোহেলি বেগম বলেন, স্কুলের ঘর নেই। পতাকা আর সাইনবোর্ড না থাকলে শুধু টিনের চাল দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে এটি একটি স্কুল।

আরেক অভিভাবক মর্জিনা বেগম বলেন, সরকারি স্কুল হলেও এখানে ঘর, বেঞ্চ, টিউব অয়েল, ল্যাট্রিন কিছুই নেই। এমনকি স্কুলে যাতায়াতের রাস্তাও নেই। কোনো অভিভাবক কি তার সন্তানকে এমন পরিবেশে দিতে পারে?

এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলতাফ হোসেন। তিনি বলেন, বিদ্যালয় স্থানান্তর আর জমি-সংক্রান্ত জটিলতার কারণে এমন করুণ চিত্র। দান করা জমিতে দাগ নম্বরের সমস্যার কারণে নতুন ভবন হচ্ছে না। অথচ একই মালিকের জমি বিদ্যালয়ের চারপাশে। বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের জন্য বরাদ্দ এলেও অর্থছাড় হচ্ছে না এই জমি জটিলতার কারণে।

জমিদাতা ও ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, আমি এক বিঘা জমি দান করেছি বিদ্যালয়ের নামে। এখন জমি-সংক্রান্ত কী জটিলতা হয়েছে, তারাই ভালো জানে। বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি না থাকা এবং উন্নয়ন না হওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেন তিনি।

সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা লুৎফর রহমান বলেন, জমি-সংক্রান্ত জটিলতা থাকায় ভবন করা যাচ্ছে না। সদরের সহকারী কমিশনারসহ (ভূমি) বিদ্যালয়ের স্থান পরিদর্শন করা হয়েছে। জমি-সংক্রান্ত জটিলতা দূর করতে প্রধান শিক্ষককে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। প্রধান শিক্ষকের অবহেলার কারণে বিদ্যালয়ের এই নাজুক অবস্থা বলে অভিযোগ শিক্ষা কর্মকর্তা লুৎফর রহমানের।

আপন দেশ ডটকম/ এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়