Apan Desh | আপন দেশ

বিএসএমএমইউ’র ট্রেজারার ডা. আতিকের দুর্নীতি ধরতে ইউজিসির তদন্ত কমিটি গঠন

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৭:৩৬, ১৭ মে ২০২৩

আপডেট: ১৭:৩৮, ১৭ মে ২০২৩

বিএসএমএমইউ’র ট্রেজারার ডা. আতিকের দুর্নীতি ধরতে ইউজিসির তদন্ত কমিটি গঠন

অধ্যাপক ডা. আতিকুর রহমান

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ট্রেজারার অধ্যাপক ডা. মো. আতিকুর রহমানের জালিয়াতি, সার্ভিস ফাইল গায়েব, বরাদ্দ লোপাটসহ ডজন অভিযোগ তদন্ত করতে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মন্জুুরী কমিশন (ইউজিসি)। গত মঙ্গলবার (১৬ মে) এ কমিটি গঠন করা হয়। 

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকসহ সরকারের বিভিন্ন দফতরে ডা. আতিকুর রহমানের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ হয়েছে।

গত মঙ্গলবার ইউজিসির যুগ্ম সচিব  স্মাক্ষরিত পত্রে (স্মারক: ইউজিসি/প্রঃশঃ/অভিযোগ/২(৩০৭)/২০২৩/১৩৮৬) উল্লেখ করা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ট্রেজারার অধ্যাপক ডা. মো. আতিকুর রহমানের বিরুদ্ধে জালিয়াতির মাধ্যমে পদোন্নতি গ্রহণ, তার মেডিক্যাল অফিসার পদে চাকরির নিয়ম বহির্ভুতভাবে স্থায়ীকরণ, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও সিন্ডিকেটের অনুমোদন ব্যতিরেকে সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে ভুতাপেক্ষভাবে পদোন্নতি গ্রহণ, ব্যক্তিগত নথি গায়েব, বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ত কাজ ও ডি-ব্লকের ক্যাপসুল লিফ্ট স্থাপনের কাজ থেকে অর্থ লোপাট এবং হাসপাতালের রোগী নিজ ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া অভিযোগ সম্বলিত একটি পত্র ইউজিসি বরাবর দাখিল করা হয়েছে। উত্ত অভিযোগ তদন্তপূর্বক সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন পেশ করার জন্য কমিটি গঠন করা হলো।

ইউজিসির সদস্যকে (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজম্যান্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত) আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটির অপর চার সদস্য হলেন- ইউজিসি সদস্য (র্অথ ও হিসাব বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত), প্রো ভাইস চ্যান্সেলর (শিক্ষা) বিএসএমএমইউ, ইউজিসির সচিব ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজম্যান্ট বিভাগের উপ-পরিচালক। 

অধ্যাপক  ডা. আতিকের বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ:

তিনি ছিলেন মেডিক্যাল অফিসার। অতিরিক্ত রেজিস্ট্রারের চিঠিতে পদোন্নতি পেয়ে হয়ে যান নিয়মিত সহকারী অধ্যাপক। সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়মিত হওয়ার নয় মাস ২৫ দিনে আগের রেজিস্ট্রারের এক চিঠিতে পান সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি! তার সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতিতে কোনো নিয়মই মানা হয়নি। প্রয়োজন হয়নি সিন্ডিকেট সভার।

বিএসএমএমইউর সিনিয়র শিক্ষকরা বলছেন, তিনি জালিয়াতির মাধ্যমে সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক হলে, তার বর্তমানের অধ্যাপক পদটিও অবৈধ। দেশের স্বনামধন্য চিকিৎসা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান জাতির জনকের নামের মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনায় রীতিমতো বিস্মিত অনেকে।

সহকারী অধ্যাপক পদে স্থায়ী না হয়েই মেডিক্যাল অফিসার থেকে তিনি কীভাবে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি নিলেন সেই প্রশ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকের। কিন্তু প্রভাবশালীদের সঙ্গে ডা. মো. আতিকুর রহমানের সখ্যতা থাকায় ভয়ে তার বিরুদ্ধে কেউই মুখ খুলছেন না।

ডা. মো. আতিকুর রহমানের বিরুদ্ধে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ভূয়া তথ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতি ও নিয়োগবিধি ভঙ্গ করে উচ্চতর গ্রেডে উন্নীত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রশাসনের অনৈতিক সহযোগিতারও প্রমাণ মিলেছে নিয়োগ প্রক্রিয়ায়।

জানা গেছে, ১৯৯৯ সালের ১ জুলাই রেজিস্ট্রার মুহাম্মাদ আবদুল গফুর স্বাক্ষরিত এক পত্রে ছয় শর্তে দুই বছরের চুক্তিতে ডা. মো. আতিকুর রহমানকে সাময়িকভাবে কার্ডিওলজি বিভাগে মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে যোগদান করতে বলা হয়। ডা. মো. আতিকুর রহমান ১৯৯৯ সালের ৪ জুলাই ৩০ বছর এক মাস ১৯ দিন বয়সে যোগদান করেন। ওই নিয়োগপত্রে উল্লেখিত দ্বিতীয় শর্তে বলা হয়, দুই বছরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে তার নিয়োগ স্বংয়ক্রিয়ভাবে বাতিল হবে (যার স্বারক নং- বিএসএমএমইউ- ৯৯/২৩২৭)।

সিন্ডিকেট সভায় পাস হওয়া নিয়োগবিধি অনুযায়ী কোর্সে থাকা কোনো চুক্তিভিত্তিক চিকিৎসক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ও স্থায়ী হতে পারবেন না। কিন্তু এসব আইন ও সংবিধি ভঙ্গ করে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অদৃশ্য ক্ষমতাবলে ২০০২ সালের ৩১ ডিসেম্বর ডা. আতিকুর রহমানকে নিয়মিত করে।

২০১৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মেডিসিন বিভাগের (রেসপিরেটরি) প্রফেসর পদে ডা. মো. আতিকুর রহমানের নিয়োগ কার্যপত্রের তথ্য অনুযায়ী, তিনি ১৯৮৪ সালে এসএসসি, ১৯৮৬ সালে এইচএসসি, ১৯৯৪ সালে এমবিবিএস এবং ২০০২ সালে এমডি (বক্ষব্যাধি) পাস করেন।

নিয়োগ কার্যপত্রের অভিজ্ঞতায় উল্লেখ রয়েছে, ১৯৯৯ সালের ৪ জুলাই থেকে ২০০২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

২০০৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০০৭ সালে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগে (রেসপিরেটরি) সহকারী অধ্যাপক (নিয়মিত) হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত মেডিসিন (রেসপিরেটরি) বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক (পিপি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০১১ সালের ২৭ মার্চ থেকে ২০১৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মডিসিন (রেসপিরেটরি) বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক (নিয়মিত) হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৪ সালের ১ জানুয়ারি তাকে রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে স্ববেতনে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বিধি অনুযায়ী স্ববেতনে অস্থায়ী সহকারী অধ্যাপক পদটি বর্তমান নবম গ্রেডের মেডিক্যাল অফিসার সমমানের একটি পদ।

এই পদে ২০০৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তৎকালীন অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার ডা. কাজী এবাদুল্লাহ স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে তিনি স্থায়ী হন (যার স্মারক নং বিএসএমএমইউ ২০০৮/৮০৩০)। যোগদানের তারিখ ০৭/১০/২০০৮ইং, স্মারক নং বিএসএমএমইউ ২০০৮/৮২৮১(৬)।

ওই আদেশে বলা হয়েছে, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক পদে প্রার্থীর আবেদন যাচাই বাছাই কমিটি গত-২৫/৯/২০০৮ইং তারিখ অনুষ্ঠিত সভার সুপারিশের ভিত্তিতে কর্তৃপেক্ষর অনুমোদনক্রমে নিম্নলিখিত মেডিক্যাল অফিসার/স্ববেতনে সহকারী অধ্যাপকগণকে নিয়মিত সহকারী অধ্যাপক পদে পদায়ন করা হল।’

তবে নিয়োগ বিধি অনুযায়ী অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার বা সহকারী রেজিস্টারের শিক্ষক নিয়োগ বা পদোন্নতির চিঠি প্রদানের এখতিয়ার নেই। সিন্ডিকেটের অনুমোদনের পর শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও স্থায়ীকরণ পত্রাদেশ শুধু রেজিস্ট্রার প্রদান করতে পারবেন।

অপরদিকে ২০০৯ সালের ২৫ মে এই বিশ^বিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. আব্দুল গফুর স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে ডা. মো. আতিকুর রহমানকে ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে ব্যক্তিগত পদোন্নতি দেয়া হয়!

ওই পদোন্নয়ন পত্রে বলা হয়েছে, ‘আপনার ২৯/০৯/২০০৮ইং তারিখের আবেদনের প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিটির সুপারিশ এবং কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে আপনাকে জানানো যাচ্ছে, আপনি বর্তমানে মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপকের (মেডিসিন রেসপিরেটরী) যে পদে নিয়োজিত আছেন, সেই পদটিকে আপগ্রেডিং এর মাধ্যমে সহযোগী অধ্যাপক পদে রূপান্তর করে ব্যক্তিগত পদোন্নয়নের মাধ্যমে উক্ত পদে আপনাকে নিম্মলিখিত শর্তে নিয়োগ করা হয়েছে।

এমন অস্বভাবিক ঘটনা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তার অনেক সহকর্মীও। চাকরীবিধি অনুযায়ী সহকারী অধ্যাপক পদে একই বিষয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে তিন বছর স্থায়ী চাকরি করার পর সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হবেন। স্ববেতনে সহকারী অধ্যাপক মানে মেডিক্যাল অফিসারের চাকরিকাল কখনোই সহযোগী অধ্যাপক হওয়ার জন্য বিবেচিত হবে না। কিন্তু ডা. মো. আতিকুর রহমানের বেলায় সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়মিত হওয়ার নয় মাস ২৫ দিন আগেই স্ববেতনে সহকারী অধ্যাপক/মেডিক্যাল অফিসার থেকে সরাসরি তাকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি প্রদান করা হয়!

পদন্নোতি ও নিয়োগ বিধির ৫(খ) ধারা অনুযায়ী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রদান করার জন্য সিন্ডিকেট সভার অনুমোদনের বিধান থাকলেও ডা. আতিকুর রহমানের বেলায় তা মানা হয়নি। নিয়মানুযায়ী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে বহুল প্রচারিত পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও নিয়োগ নির্বাচনী বোর্ডের সুপারিশ সিন্ডিকেট থেকে অনুমোদন নিতে হয় এবং সিন্ডিকেটে অনুমোদনের তারিখ থেকে এই নিয়োগ কার্যকর হয়। অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডেকেট সভার ধারাবাহিক তারিখ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ডা. মো. আতিকুর রহমানের সহকারী ও সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ কার্যকরের ২০০৪ সালের ১ জানুয়ারী ও ২০০৮ সালেল ১ জানুয়ারি সিন্ডিকেট কোনো সভা অনুষ্ঠিত হয়নি। এ ছাড়া ওই তারিখের পরের সিন্ডিকেট সভায়ও তার নিয়োগ সংক্রান্ত কোনো আলোচ্যসূচিও ছিল না। ফলে তার এই নিয়োগের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষকএ প্রতিবেদককে বলেন, পূর্বের ধারাবাহিক জালিয়াতির কারণে তার বর্তমানের অধ্যাপক পদটি ও আইন অনুযায়ী অবৈধ। চাকুরীবিধি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধিতে ভুতাপেক্ষ পদোন্নতির কোনো সুযোগ নেই। তিনি বিধিবর্হিভূতভাবে প্রতি পদে পদোন্নতিতে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। এ ছাড়া ২০০৪ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় আতিকুর রহমানের খণ্ডকালীন কোর্সে অবৈধভাবে উত্তোলিত অর্থফেরত প্রদান করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আর এসব তথ্য গোপন করার জন্য তার অফিস ফাইল (সার্ভিস ফাইল) গায়েব করেছেন। অফিস ফাইলে শুধু ২০১৩ সাল পর্যন্ত তার চাকরির তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

আপন দেশ/এবি

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়