Apan Desh | আপন দেশ

ডেঙ্গু চোখ রাঙাচ্ছে প্রজনন মৌসুমের আগেই 

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১০:১৬, ২৩ মে ২০২৩

আপডেট: ১০:১৯, ২৩ মে ২০২৩

ডেঙ্গু চোখ রাঙাচ্ছে প্রজনন মৌসুমের আগেই 

ফাইল ছবি

সাধারণত জুন থেকে ডেঙ্গুর মৌসুম। ওই সময়টিতে বর্ষাকাল শুরু। তখন বৃষ্টির পানি বিভিন্ন স্থানে জমে থাকে। আর এই প্রাদুর্ভাব চলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। তাই পুরো সময়টিকে ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশার প্রজননকাল ধরে নেয়া হয়।

সেই হিসাবে এডিস মশার প্রজনন এখনো শুরু হয়নি। এর আগেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে, আক্রান্তের সংখ্যা গত বছরের প্রথম ‘পাঁচ মাসের’ তুলনায় প্রায় ছয় গুণ। গত বছর এই সময়ে ডেঙ্গুতে মৃত্যু শূন্য থাকলেও এবার তা ১৩ জন। 

পরিবেশবিদ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের পরিবেশ-পরিস্থিতি বদলে গেছে। নগরায়ন ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামেও। তাই এখন ডেঙ্গুর কাল বদলে যাচ্ছে। মৌসুম শুরু আগে আক্রান্তের হারই তার প্রমাণ। তার জন্য এখন রাজধানী ও বিভাগীয় শহর ছাড়াও ডেঙ্গু নির্মুলের কার্যক্রম গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে দিতে হবে। 

কীটতত্ত্ববিদেরা বলছেন, এখন এমন অনেক জায়গায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে বৃষ্টির পানির সম্পর্ক নেই। এর মধ্যে বহুতল ভবনের পার্কিংয়ের জায়গা, নির্মাণাধীন ভবনের বেজমেন্ট, ওয়াসার মিটার বাক্স এবং বাসাবাড়িতে জমিয়ে রাখা পানি রয়েছে। রাস্তা উঁচু করার ফলে নিচু হয়ে যাওয়া বাসাবাড়ির জমা পানিতেও এডিস মশা জন্ম নিচ্ছে।

২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২১ মের মধ্যে আক্রান্ত (হাসপাতালে ভর্তি হওয়া) ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছিল ১০০ জন। এই সময়ের মধ্যে কোনো মৃত্যু ছিল না। পরের বছর ২০২২ সালেও এই সময়ের মধ্যে কোনো ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়নি। তবে আক্রান্ত সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ২৪৩ জন। অথচ স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে ২১ মে পর্যন্ত আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগী এক হাজার ৪৪৭ জন; যা গত বছরের তুলনায় পাঁচ দশমিক ৯৬ গুণ বেশি। আর ২০২১ সালের তুলনায় প্রায় সাড়ে ১৪ গুণ। এ বছর এ পর্যন্ত ১৩ ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে।

সারা দেশেই মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। সোমবার (২২ মে) সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ৪০ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন চার জন।

বর্তমানে দেশে ১৪৮ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাইরে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ২৬ জন। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ছয়, কক্সবাজারে তিন, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, লক্ষ্মীপুরে দুই জন করে এবং কিশোরগঞ্জ, খাগড়াছড়ি ও সাতক্ষীরায় এক জন করে ভর্তি আছেন। এই ২০ রোগীর বাইরে বাকি ছয় রোগীর মধ্যে চার জন ভর্তি রয়েছেন বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ও দুই জন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের বলেন, মশা নিধনের অংশ হিসেবে দক্ষিণ সিটির আওতাধীন ১৩ অংশী প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয়া হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় ১০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চাওয়া হয়েছে। জুনের মধ্যে মশা নিয়ে নিয়ন্ত্রণকক্ষ চালু করা হবে।

ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান বলেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতা বৃদ্ধির ওপর বেশি জোর দেয়া হয়েছে। এর জন্য স্কাউট ও বিএনসিসির সদস্যদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে। নতুন ওষুধ বিটিআই ব্যাকটেরিয়া প্রয়োগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, নানা কারণে সারা বছরই এখন পানি জমে থাকছে। মে মাসে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় এডিসের আরও বেশি প্রজননক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। নগরবাসীকে সিটি করপোরেশনের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে। করপোরেশনের উচিত আক্রান্ত রোগীর এলাকায় বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং বর্তমান উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ডেঙ্গু সারা বছরই ছিল। গত বছর বর্ষাকালের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ছিল। বর্তমানে বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। যেহেতু বাংলাদেশে নগরায়ন এখন উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত, কোনো কোনো ইউনিয়নেও পাকা রাস্তাঘাট ও বিল্ডিং রয়েছে। আমরা ভৌগোলিকভাবেও অত্যন্ত ছোট দেশ। ফলে ডেঙ্গু মশা ও রোগী সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়ছে। যেখানে এডিস মশা আছে কিন্তু রোগী নেই সেখানে ডেঙ্গু ছড়াবে না, আবার যেখানে রোগী আছে এডিস মশা নেই সেখানেও ডেঙ্গু ছড়াবে না। কিন্তু এখন দুটোই ছড়াচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, রাজধানী ঢাকাতো বটেই ছোটখাটো অন্যান্য যে শহর রয়েছে, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে, সেখানে ডেঙ্গু বিরোধী পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো প্রয়োজন। ভবিষ্যতে বৃষ্টি আরও হবে। বৃষ্টির পানি যেন জমতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বৃষ্টি হওয়ার পর যেসব স্থানে পানি জমে যেমন বাড়ির ছাদ, সরকারি বিভিন্ন অফিস আদালতের ছাদ, বিভিন্ন থানায় জব্দ করা গাড়িতেও পানি জমে থাকে, কিন্তু সেগুলো কেউ পরিষ্কার করে না, ডাবের খোসা, বিভিন্ন খাবারের টিনের এবং প্লাস্টিকের কৌটা-প্যাকেট সেগুলোতেও বৃষ্টির পানি জমে, সেগুলো বন্ধ করতে হলে একদিকে যেমন কর্তৃপক্ষ এবং আরেক দিকে কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করতে হবে। স্থানীয়ভাবে ছাত্র ও যুবকদের যে বিভিন্ন ক্লাব রয়েছে, তারা প্রতিটা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কোথায় পানি জমে সেগুলো বিষয় খুঁজে বের করবে এবং সেই পানি জমার স্থানগুলোতে পানি যেন না জমে, সেই ব্যবস্থা করবে এবং ভবিষ্যতে যেন এসব স্থানে পানি না জমে সেই বিষয়ে প্রতিটা পরিবারকে সচেতন করবে। স্থানীয় কমিউনিটির এসব ভলান্টিয়ারদের ডেঙ্গু প্রতিরোধ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

কীটতত্ত্ববিদ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ফ্যাকাল্টি জি এম সাইফুর রহমান বলেন, ‘এডিস মশা নিধনে আমাদের কোনো অ্যাকটিভ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম নেই। কারণ আমরা ওষুধ ছিটাই বা যা কিছু করি, কিউলেক্স মশার জন্য। এই সময়ে আমাদের করণীয় হলো ‘আরবো ভাইরাস চেক’।

আপন দেশ/আরএ

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ

জনপ্রিয়