ছবি : আপন দেশ
বর্ষা মৌসুম শুরু হয়নি এখনো। এর মাঝেই দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠছে। সাধারণত জুন থেকে শুরু হয় ডেঙ্গুর মৌসুম। তখন বৃষ্টির পানি বিভিন্ন স্থানে জমে থাকে। আর এর প্রাদুর্ভাব চলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। তাই পুরো সময়টিকে ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশার প্রজননকাল ধরে নেয়া হয়।
দেশে বর্তমানে প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতলে ভর্তি হচ্ছেন। ঢাকার বাইরে কক্সবাজার হয়ে উঠছে বড় ‘হটস্পট’। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদফতর জরুরি বৈঠক করে বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলন করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ১১ দফা নির্দেশনার কথা জানানো হয়েছে।
আর ডেঙ্গু পরীক্ষায় বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। এদিকে রোববার (২৮ মে) সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৬৭ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৫৮ জনই ভর্তি হয়েছেন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে। চলতি বছর এক হাজার ৭৭১ জন ডেঙ্গু নিয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ বছর ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ১৩ জন; যাদের দশজন ঢাকার। তবে সরকারের এ হিসাবের বাইরে রয়েছেন কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা। স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্ত বা মৃত্যুর যে পরিসংখ্যান দেয়, সেখানেও রোহিঙ্গাদের তথ্য থাকে না।
এর ব্যাখ্যায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক নাজমুল ইসলাম রোববার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, রোহিঙ্গা কমিউনিটি যেহেতু আমাদের নাগরিক না, তাদের তথ্য আমরা একসঙ্গে আনি না। তবে যেহেতু তারা আমাদের সঙ্গেই থাকে, জাতিসংঘও তাদের তথ্যটা চায়, সেহেতু গুরুত্ব দিয়েই আমরা তাদের তথ্য সংগ্রহ করি এবং আলাদাভাবে হিসাব করি।
এ বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, কক্সবাজারে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। সেখানকার স্থানীয় মানুষদের মধ্যে ছড়ানো এই সংখ্যাটাও উপেক্ষা করার মতো নয়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের যা পরিস্থিতি, তাতে সেখানে ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা ‘কঠিন’ বলে মন্তব্য করেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের এ কর্মকর্তা।
নাজমুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষের মাঝে সচেতনতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। তাদের কালচার আলাদা হওয়ায় এ ব্যাপারে কাজও সেভাবে করা যায় না। তারা একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে থাকেন, সেখানে স্বাস্থ্যকর্মীদেরও অনেক নিয়ম মেনে কাজ করতে হয়।
তিনি বলেন, তাদের পরিষ্কার পানির উৎস সীমিত, তাই তারা পানি সংগ্রহ করে অনেক সময় খোলা পাত্রে রেখে দেয়; যা মশার জন্য একটা ভালো প্রজননক্ষেত্র। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কম জায়গায় মানুষ বেশি। ফলে সেখানে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অন্যান্য এলাকার চেয়ে বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় থাকা রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত এক হাজার ৬৬ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। আর কক্সবাজারে থাকা বাংলাদেশিদের মধ্যে এই সংখ্যা ৪২৬। অর্থাৎ, মৌসুম শুরুর আগেই এ জেলায় এক হাজার ৩২ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে; যা একই সময়ে ঢাকায় শনাক্ত রোগীর চেয়ে বেশি।
রোববার স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ২০৯ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। ঢাকার ৫৩টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ১৮০ জন এবং অন্যান্য বিভাগে ২৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন। চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে এখন পর্যন্ত এক হাজার ৭৭১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় এক হাজার ১৭৭ জন এবং ঢাকার বাইরে ৫৯৪ জন। অন্যদিকে চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন এক হাজার ৫৪৯ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ৯৮৭ ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থানে ৫৬২ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এ বছর ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ১৩ জন, যাদের দশজন ঢাকার।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক নাজমুল ইসলাম বলেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় যেখানে ঘনবসতি বেশি সেখানে মশার উপদ্রব বেশি। তবে নির্দিষ্ট করে কোন এলাকায় সবচেয়ে বেশি সেটি বলা এই মুহূর্তে কঠিন। রোগীদের তথ্য যাচাই করে তারপর বলা যাবে। আমরা পুরো ঢাকা শহরকেই বিবেচনায় নিচ্ছি। আমাদের কাজ রোগী ব্যবস্থাপনা। ডেঙ্গু কোথায় বেশি এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের।
রোগী জটিলতার ব্যাপারে অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. রোবেদ আমিন বলেন, ঢাকা শহরে অপরিকল্পিত নগরী গড়ে উঠছে। ঠিক ব্রাজিলের মতোই। ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেই আমরা প্লাটিলেটকে সামনে আনি। অথচ এটি সেভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাদের উচিত সচেতনতায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া।
ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার বিস্তারের কারণ হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও জনঘনত্বকে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন। অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, বাংলাদেশ অনেক জনবহুল, তার ওপর এখানে দ্রুত নগরায়ন হচ্ছে। ফলে এখানে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সহজ না। এরই মাঝে অপ্রত্যাশিত কিছু মৃত্যু হয়েছে। মে মাসে যেটুকু হয়েছে, তা অন্যান্য সময়ে হয়নি।
চলতি মে মাসের গত ২৮ দিনে সারা দেশে (রোহিঙ্গাদের তথ্য ছাড়া) ৭৬৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন; যা এ বছরের সর্বোচ্চ। এ মাসে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে দুই জনের। এর আগে জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৫৬৬ জন; মৃত্যু হয় ছয় জনের। আর ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন, মার্চে ১১১ জন, এপ্রিলে ১৪৩ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গত বছর ৬২ হাজার ৩৮২ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। তাদের মধ্যে ২৮১ জনের মৃত্যু হয়। এর আগে ২০১৯ সালে দেশের ৬৪ জেলায় এক লাখের বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন; যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। সরকারি হিসাবে সে ওই বছর মৃত্যু হয়েছিল ১৬৪ জনের।
অধ্যাপক ডা. মো. রোবেদ আমিন বলেন, জানুয়ারি মাসের পর থেকে আমাদের অনেক গরম পড়েছে। বিজ্ঞান বলে, কোনো জিওগ্রাফিতে এক ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়লে তার ডাবল পরিমাণ ডেঙ্গু কেইস চলে আসে। তাপমাত্রা অনেক বেড়ে গেল যখন তখন বৃষ্টিপাত, বাতাসের গতি কত ছিল তা দেখে কিন্তু অনুমান করা হয়েছে প্রাক মৌসুমেই ডেঙ্গু কেইস বেশি হবে।
সিটি করপোরেশনের সঙ্গে ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রমের সমন্বয় প্রসঙ্গে আহমেদুল কবির বলেন, আমরা এরই মাঝে সিটি করপোরেশনগুলোকে জানিয়েছি। খুব দ্রুত যদি মশার স্থানান্তর নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে যে কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটতে পারে। দুই সিটি করপোরেশনের সঙ্গেই আমাদের যোগাযোগ হয়। আমরা তাদের ম্যাপিং করে জানিয়ে দিই, কোথায় বেশি ছড়াচ্ছে। তাদের জায়গা থেকে আরেকটু বেশি অ্যাক্টিভ হতে হবে। যেহেতু আমরা জানিয়ে দিচ্ছি, কোথায় কী হচ্ছে, তাই তাদের উড়ন্ত মশা নিয়ন্ত্রণ, লার্ভা ধ্বংসসহ তারা যেসব ব্যবস্থা নেন, সেগুলোর মাধ্যমে যেন আমরা ভেক্টরটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।
ডেঙ্গু চিকিৎসায় সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন তৈরির সঙ্গে যুক্ত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. কাজী তারিকুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রশাসনের কেন্দ্র থেকে শুরু করে সবার অংশগ্রহণ জরুরি। ২০০০ সালে এটি বাংলাদেশে আসার পর মাঝে পরিস্থিতি ভালো গেছে। কোভিডের আগের বছর আমরা একটা বড় সংক্রমণ দেখেছি। গত বছর দেখলাম, আর এবার আমরা অনুমান করছি, এবারো হয়তো এমন কিছু একটা হতে পারে।
এদিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, নানা কারণে সারা বছরই এখন পানি জমে থাকছে। মে মাসে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় এডিসের আরও বেশি প্রজননক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। নগরবাসীকে সিটি করপোরেশনের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে। করপোরেশনের উচিত আক্রান্ত রোগীর এলাকায় বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং বর্তমান উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ডেঙ্গু সারা বছরই ছিল। গত বছর বর্ষাকালের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ছিল। বর্তমানে বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। যেহেতু বাংলাদেশে নগরায়ন এখন উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত, কোনো কোনো ইউনিয়নেও পাকা রাস্তাঘাট ও বিল্ডিং রয়েছে। আমরা ভৌগোলিকভাবেও অত্যন্ত ছোট দেশ। ফলে ডেঙ্গু মশা ও রোগী সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়ছে। যেখানে এডিস মশা আছে কিন্তু রোগী নেই সেখানে ডেঙ্গু ছড়াবে না, আবার যেখানে রোগী আছে এডিস মশা নেই সেখানেও ডেঙ্গু ছড়াবে না। কিন্তু এখন দুটোই ছড়াচ্ছে।
কীটতত্ত্ববিদ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ফ্যাকাল্টি জি এম সাইফুর রহমান বলেন, এডিস মশা নিধনে আমাদের কোনো অ্যাকটিভ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম নেই। কারণ আমরা ওষুধ ছিটাই বা যা কিছু করি, কিউলেক্স মশার জন্য। এই সময়ে আমাদের করণীয় হলো ‘আরবো ভাইরাস চেক’।
আপন দেশ/আরএ