Apan Desh | আপন দেশ

মারুফুল ইসলাম: মরমিয়া সুরে মর্মভেদী চিৎকার

মাহমুদ নোমান

প্রকাশিত: ১৯:৩০, ৩১ মার্চ ২০২৩

আপডেট: ১৯:৫৮, ৩১ মার্চ ২০২৩

মারুফুল ইসলাম: মরমিয়া সুরে মর্মভেদী চিৎকার

ফাইল ছবি

‘পুকুরে ফেলেছিলাম জাল গতরাতে/উঠেছিল আজাইরা জঞ্জাল/সাঁইজি প্রভাতে বড়শিতে ধরলেন বোয়াল।’ 

কবিতাটি মারুফুল ইসলামের ‘সাঁইজি’ কবিতার বইয়ের শুরুর তিনটি লাইন। আমার মনে হল, পুরো বইটি এমনকি সাঁইজি কী ব্যাপার বুঝিয়ে দিতে উপরোক্ত তিনটি লাইনই যথেষ্ট; এরপরে বইটিতে কেবল তিনটি লাইনেরও বিস্তার, সঞ্চার ঘটে গেছে তিনটি লাইনের আকুতি, ভাব-বোধ, ধ্যান এমনকি মর্মভেদী চিৎকার!

ভেতরকার আশয় চর্চা এক উদ্দেশকে পরমে পবিত্রে ধ্যান আর জ্ঞানে জপে ঠিক ‘ভ’ অক্ষরে আকৃতিতে নিবিষ্ট অক্তে অক্তে সেই ভক্ত কিন্তু গুরু অর্থাৎ ভেতরকার ওই চর্চার ব্যাপারের মালিক সে কেবলি ধায় কখনো সায়, তিনিই সাঁই আর আদরে মোলায়েম স্বরে রাজি করানোর অনুনয় বিনয়ের ডাক সাঁই এর জি, একত্রে সাঁইজি।

এবার বলি, আপনার প্রিয়কে যেমন তমা সংযুক্ত করে ‘প্রিয়তমা’ কিংবা সোনা, জান বলে ডাকেন ঠিক তেমনি।

তাহলে, রাজি করানো (সায় পাওয়া) কিংবা নিজের করে নেওয়া অথবা (সাঁই) সায় দিলে আস্তে আস্তে সাঁইয়ের মধ্যে মিলিয়ে যাওয়ার এই সাধন হলো আধ্যাত্মিকতা; মারুফুল ইসলাম এক্ষেত্রে দারুণ মোচড় দিয়েছেন-
 
‘আত্মায়-পরমাত্মায় নাই কোনো ভেদ/যাহাই মিলন বটে তাহাই বিচ্ছেদ।’

আরেকটা ব্যাপার বলি, চট্টগ্রামে গরু-লাঙল দিয়ে জমি চাষের সময় গরুর মুখে মাস্কবিশেষ একটি বেতের তৈরি টুপি পরনো হয় যাতে কোনোকিছুতে মুখ লাগাতে না পারে এবং গরুকে দাঁড় করানোর সময় ডাক দেওয়া হয়- ‘ভ, ভ’ 

ঠিক তেমনি জাগতিক বাস্তবতার মধ্যেও নিজের বোধ-ভাব নিজের মধ্যে তত্ত্বজ্ঞানে নিজেকে উন্নীতকরণের এই যাত্রা নিজেকে অন্বেষণ; চূড়ান্ত সত্যি মানুষ হওয়ার এই আকুলতায় জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কোনো ভেদাভেদ নেই, নিজেকে এমন অনুশাসন অর্থাৎ পাপে থেকেও পাপ যেন না ছোঁয়-

‘তাবিজ-কবজ-মাদুলি/সিকি-রেজগি-আধুলি/বাঁকা হাড্ডি, মাথার খুলি/কাদা-মাটি-ধূলি/লাল কাপড়ের ঝুলি/সব ফাঁকি-ফক্কিকার/সাঁইজি জানান, দেহতত্ত্ব সার/দেহ জগৎ-সংসার/আধেয় আর আধার/বিশেষ নির্বিশেষ/উদ্দেশ-নিবেশ/দেহমধ্যে সৃজন/স্বাগত অভিবাদন/বরণ-লালন-পালন-মিলন/বিদায়সম্ভাষণ/দেহঘরে অধিষ্ঠান/প্রবেশ-প্রতিষ্ঠা/আমি আর অন্তর্যামী/অভিন্ন হদিস/একমেবা দ্বিতীয়ম বন্দিশ/পঞ্চভূতে এক ঠাঁই/ সাঁইজি, তোমার শেষ যে না পাই।’

মারুফুল ইসলামের যেসব কবিতা পড়ে অর্থাৎ যে ঢঙের কবিতা পড়ে আমি একটা প্লটে এতোদিন দাঁড় করিয়েছি মারুফুল ইসলামকে, সেখান থেকে একেবারে ভিন্ন আঙিনায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ‘সাঁইজি’ আর ‘সাঁইজি পুনশ্চ’ কবিতার বই দুটিতে; এক্ষেত্রে আমার ব্যর্থতার চেয়ে বলবো মারুফুল ইসলামের ব্যক্তিক পরিচিতি আর যে সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন সেখানে এ রকম মাটি সংলগ্ন একেবারে আত্মিক ব্যাপারে কবিতা লেখা মুখের কথা নয়; বই দুটি পড়ে মনে হল, আমার আশ্চর্য হওয়া উচিত আবার আরেকটি কথা যেÑ কবিতা মানে আধ্যাত্মিকতা। ‘আধ্যাত্মিকতা’ শব্দটি অনেকে এড়িয়ে যেতে চায় হীনমন্যতায় বুঝি, শব্দটিকে অনেকের অজ্ঞতার ফলস্বরূপে নীচতায় এনে যারা আড়াল করতে চায়, তারাই ম্যাজিক রিয়েলিজম বলে জাতে উঠে, বেশ ঢিলেঢালা মনোভাব এটি; অথচ কবিতা কোত্থেকে আসে কোনো কবি দেখাতে পারবে না, এটাও বিশ্বাস করে।

অতএব বলতে পারি প্রত্যেক কবি আধ্যাত্মিকতা চর্চা করে সহজাতভাবে; ‘সাঁইজি’ কবিতার বইটি পাঠে যতটুকু বুঝেছি মারুফুল ইসলাম বেশ চর্চা করেছেন লালনের জীবনদর্শন ও লালনের ঐতিহ্যগত বোধ আর ভাবের মিশেল আত্মস্থ করতে। শব্দের ক্ষেত্রেও লালনের আশপাশে, এক্ষেত্রে খুশি হতাম যদি আধ্যাত্মিক সরলতায় নিজেকে পুরোপুরি সপে দিতেন নিজের ভাব বোধে; তখন নতুন এক দর্শন পেতাম, নতুন এক ভাব পেতাম, নতুন এক জগৎ পেতাম। আমি বিশ্বাস করি, আধ্যাত্মিক ব্যাপারটি বই পড়ে শেখার নয়, গায়েবি অঞ্চলের তাগাদায় নিজের ভেতরের শুদ্ধিকরণ কিংবা উন্নীতকরণ অথবা জারি করা। তবু কিছু কিছু পঙ্ক্তিতে চমকে গেছি সত্যি, যে জীবন কবির সেখানে এ রকম নির্ভেজাল আকুতিভরা টলটলে সত্যের অন্বেষায় কবিতা লেখা শ্রদ্ধা আর প্রশংসা পেতেই পারে। কবিকে বারবার পাঠ করে বারেবার নতুনভাবে পাবো, এটাই সত্যি; ‘সাঁইজি’ আর ‘সাঁইজি পুনশ্চ’ মূলত সিরিজ কবিতার দুটি সংকলন। একটি শিরোনামে উভয় বইয়ে ৩৯টি কবিতা রয়েছে সংখ্যা লিখে। ‘সাঁইজি পুনশ্চ’ বইটি ২০১৬ সালে ‘সাঁইজি’ প্রকাশ হওয়ার ঠিক তিন বছর পরে ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়। বই দুটির প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান চন্দ্রাবতী একাডেমি। ‘সাঁইজি’ কবিতার বইয়ে কবি মারুফুল ইসলাম আধ্যাত্মিকতার রূপরেখা অঙ্কিত করেছেন সরলতার বৃত্তে। একজন সাধকের প্রাত্যাহিক জীবনাচরণ আনন্দ-বেদনা, চাওয়া আর পাওয়া সাঁইজির ভাবাবেগে তাড়িত হয়ে অনন্ত মিলনের মায়ানগরের পথযাত্রার সন্ধান দিতে চেয়েছেন। ‘সাঁইজি পুনশ্চ’ বইটিতে করেছেন এই পথযাত্রার মার্জিত বয়ান। এখানে কবি নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন অকাতরে; এই বইটিতে রবীন্দ্রিক- হাছন রাজার পিরিতির উছল ভাবাবেগের আঁচ পাওয়া যায় আবার কবি মারুফুল ইসলামের নিজস্ব জগতের সফল মঞ্চায়নও বলতে পারি। সবশেষের পথ যে মারেফত অর্থাৎ মায়ের পথ এই সত্যটুকু উপলব্ধির জন্য হয়তো আবার আমাদের কাছে ফিরে এসে লিখলেন- ‘সাঁইজি পুনশ্চ’।

ক. ‘ও মন মানুষ মানুষ সবাই বলে/সাঁইজি তুলে ধরেন ফাঁকি আর ফাঁক/সাঁইজির চুলে ধরেছে পাক/ও মনা/এ সংসারে কেউ নয় আপনজনা।’

খ. ‘সন্ধেয় সুরভিত আজান/রঙিন উলুধ্বনি/ঘরে ঘরে ঘরামি বিদ্যুৎবাতি/তুলসিতলায় ঘরামি প্রদীপ/ধূপধুনোর পালতোলা গন্ধে/শীত বসন্তের পথভোলা দ্বন্দ্বে/দিকবদলের লাগামছাড়া ছন্দে/মনকাড়া আনন্দে বাতাস আত্মহারা পাগলপারা/তোরা জ্বেলে দে লোবান ওলো সহচরি/তোরা ঢেলে দে আতর ওলো সহচরি।’

গ. ‘মেলার ভেতরে চলে ছুরির খেলা/বাজি হারলে তখন/কড়ায় কাহন/লজ্জায় মরণ/গরলে শরণ/কী বিভাব কী আলিঙ্গন/জলের স্থলের অন্তরীক্ষের আদিগন্ত আলিম্পন/অবেলার আশ্লেষে ফুরোয় বেলা/প্রেমসুধা জমে খরদেহে মধুমেহে/আমিষ-শর্করা-স্নেহে/আগে জান নারে মন/সাইজি চলেন একেলা।’

ঘ. ‘কার কাছে কে ন্যস্ত/কোন কাজে কে ব্যস্ত/পাগলা ঘোড়া ছোটে/বর্গিরা ধান লোটে/রাজা পাটে প্রজা বাটে/কে আর করে হেস্তনেস্ত/ক্রান্তি ক্রান্তি কড়া কড়া/বিহিত ব্যবস্থায়/দিন কাটে রাত কাটে/লগ্ন বয়ে যায়/ সাঁইজির বসুন্ধরা ধন ধান্য পষ্পভরা।’

‘সাঁইজি’ আর ‘সাঁইজি পুনশ্চ’ বই দুটিকে গুরুর প্রতি ভাবব্যঞ্জক কবিতা বা স্তোত্র বলতে পারেন। সংহত আবাহনধর্মী কল্পনাসমৃদ্ধ মহিমাব্যঞ্জক বন্দনাগীতি। এই গীতি মাঝেমধ্যে রূপকাশ্রয়ে পাঠকমনকে বিলোড়িত করবে নিঃসন্দেহে; মারুফুল ইসলাম বাংলা কবিতায় সৌন্দর্যের উপলব্ধি, রহস্যময় প্রাচীরের ধারে মরমিয়া সত্যি সত্যি কবি। 

আপন দেশ/আরএ

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়