Apan Desh | আপন দেশ

বেলা-অবেলার কবি এনাম রাজু

সৈয়দ নূরুল আলম

প্রকাশিত: ০৯:৩৮, ৯ এপ্রিল ২০২৩

আপডেট: ০৯:৪৩, ৯ এপ্রিল ২০২৩

বেলা-অবেলার কবি এনাম রাজু

ফাইল ছবি

‘আকাশে-বাতাসে ধ্বনি নীল পরিডানা মৌসুমি মহুয়া কূপে এক/নেপথ্য ঘুমায়, হাওয়ায় উধাও দিন, রাত বেজে যায় পাতার—/শরীর পচে হাড়গুলো প্রতিদিন তবু দেখো বাঘকে মানচিত্রে সাজায়!’

কবিতাংশ লিখেছেন এই  সময়ের  তরুণ কবি এনাম রাজু। কবিতার ছত্রে ছত্রে যে মানুষ আর মাটির সন্ধানে আজীবন ছুটে চলেছেন, তিনি কবি ও গল্পকার এনাম রাজু। কবিতার মাধ্যমে যার সাথে আমার পরিচয়। পরিচয়ের পর থেকেই দেখে আসছি তার নিরলসভাবে হেঁটে চলা। তিনি চলতে ভালোবাসেন মানুষকে সঙ্গী করে। তবে কখনো সঙ্গী পান, কখনো বা একাই তাকে ছুটতে হয়। সেই একাকী পথ চলাতে তার মধ্যে বিন্দু মাত্র ক্ষরণ  দেখা যায় না। শব্দের পর শব্দ গুছিয়ে, কবিতায় নানান বিষয়কে খুব সহজভাবে উপস্থাপন করে ইতোমধ্যে কবিতার জগতে একটা স্থান তৈরি করেছেন। তিনি কবিতার মানুষ। তাই পরিচয়ের পর থেকে কবিতার আলোচনা ছাড়া অন্য কিছুই করতে দেখিনি তাকে। 

এনাম রাজু মূলত একজন কবি। কবি হিসেবেই তিনি নিজেকে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। তবে মাঝে মধ্যে তিনি পাঠকের সামনে গদ্যলেখক হিসেবেও আবির্ভূত হন। 

এনাম রাজুর গদ্যের বৈশিষ্ট্য— সহজ, সরল, চরিত্রে থাকে আটপৌরে মুখের ভাষা। সংলাপে সরলতা। চরিত্র সৃষ্টিতে যে দক্ষতার দরকার তা এনাম রাজুর করায়ত্ব। ভালোবেসেও ভালোবাসাকে প্রশ্নচিহ্ন এঁকে  দিতে তিনি খুবই  দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন—

‘পাখির কালের ডানা মেলে বহুদূর

ভুলিনি। দিনের একফালি চাঁদ/যদি কথা হয় তারা ছাড়া কোনো রাতে, রাজপথে অথবা চায়ের—/কাপে। ঘড়িঠোঁট সিলেবাসে জীবনের পাঠ, মনের ব্যথায় ছেপেছি-/যে ছায়া অনায়াসে তুলে নেবে তা, পৃথিবীর যাবতীয় নীরবতা-রব?’

তিনি লেখায়, সেটা কবিতা হোক বা গল্প হোক, নিম্নবৃত্ত ও নিম্নমধ্যবৃত্তের জীবনবোধ তুলে আনার চেষ্টা করেন, জীবনের ব্যথা-বেদনা, সুখ-দুঃখ, বেলা-অবেলার গল্পের ছবি তিনি আঁকেন। তার লেখার শক্তিময়তার পরিচয় তার উপস্থাপনায়, তার চিত্রকল্পে, তার দৃষ্টি গভীরতায়।

কত সহজে একটি জীবনবোধের চিত্র আঁকা যায়, তা এনাম রাজুর  গদ্যে আমরা খুঁজে পাই।

সমাজে যা কিছু অসত্য, যা কিছু অন্যায় তা একজন সচেতন লেখককে ছুঁইয়ে যাবে- সেটাই স্বাভাবিক। কবি এনাম রাজুও এর বাইরে নন, তাই তো আমরা দেখি তিনি লেখায় যে চরিত্রগুলো তুলে আনেন, তা আমাদের খুব চেনা, খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। আমাদের সমাজের একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী। তিনি  বলেছেন- সাক্ষী আমি পৃথিবীর ভাই একা-বোকা বিক্রিত কাপুরুষ।

একই সাথে উপস্থাপনা কৌশল, চরিত্রের টানটান উত্তেজনা, গতিময়তা, জাদুকরী ভাষাশৈলী, চিত্রকল্প এসব পাঠকদের মুগ্ধ করে। 
তিনি লিখেছেন—

‘ধ্বংস খেলায় পরমাণু প্রাণী! জলাভূমি দলে বহুমূখি হাতি/সুন্দরী বন উজাড়, ছাড়াবাড়ির পেঁচা যেনো রাজার রাজা/চুপচাপ দেখে যাই খুঁটিহীন আকাশ যেনো আয়নামানব।’

লেখার বাইরে এনাম রাজুর আরেকটি বড় পরিচয় তিনি লড়তে জানেন। ২০১২ সাল থেকে তিনি নিজ জেলা কুড়িগ্রামের উন্নতির কথা ভাবেন। তাই তো চাকরি জীবনের যে অর্থ উপার্জন করেছেন তা দিয়ে গড়ে তুলেছেন গ্রামে এসডিও নামের পাঠাগার। এই পাঠাগারের মাধ্যমে নিজ গ্রামকে আলোকিত করতে সচেষ্ট হয়েছেন সামান্য হলেও। একটা মানুষের চিন্তা কতটা সুন্দর ও মার্জিত হলে একটি ইউনিয়নে একাধিক পাঠাগার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা যায়। হ্যাঁ, কবি এনাম রাজুর উদ্যোগ ও অর্থায়নে ‘এসডিও’ নামের দুটি পাঠাগার এখন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে তৃতীয় পাঠাগার তৈরির জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। কবি এনাম রাজুর এই যে মহতী উদ্যোগ সেটা করা ততো সহজ ছিলো না। কিন্তু তিনি তার কাজে বদ্ধ পরিকর ছিলেন এবং আছেনও। 

পিতা আবু বক্কর সিদ্দিক মাতা রাশেদা বেগম। তিন ভাইয়ের মধ্যে এনাম রাজু দ্বিতীয়। প্রকাশিত কবিতার বই : ১. চাঁদে  বেহুলার ভেলা ২. ট্রয়ের ঘোড়া ৩. আপনালয়ই নিরাপদ জেল। গল্প : ভাঁজ খোলার আনন্দ। সম্পাদনা : তিন কবির কবিতা (কাব্যগ্রন্থ), ধরলা, সাহিত্যের ছোট কাগজ।

বই মেলা ২০২১-এ প্রকাশ পেয়েছে প্রিয় বাংলা পাণ্ডুলিপি পুরস্কার বিজয়ী বই ‘বিকিনি পরা অমাবস্যা’। 

চলুক এনাম রাজুর কলম। বাংলা সাহিত্যে কবিতা কিংবা গদ্য সাহিত্যে একটা পক্ত জায়গা করে নিক, প্রিয় কবি এনাম রাজুর জন্য সে কামনা। কবি ভালো থাকবেন নিরন্তর।

তার সাম্প্রতিক তিনটি কবিতা—

বেদীমূলে তুমি

এসেছ বলেই—কৃষ্ণ-রুপালি মনে হলো কাকের শরীর

বিরক্তির লেশ মুছে কণ্ঠে ছড়িয়ে যায়— ভালোবাসার

সুলোতিত আজান। স্থির চোখ, পথের শুরু থেকে শেষ

ধ্যানঘরে ক্ষুধার্ত বাঘের মন, নীরবতা ভেঙে ভেঙে তুমি

গৌতমের বড় না ফেরার দেশে, নাকি অন্য কোথাও?

কোনো এক বাতিঘরে। আশার প্রদীপ জ্বেলে পেয়ালায়—

একা সক্রেটিস। কুড়িটি গ্রাম হেঁটে ডুবে যায় ধরলার বুকে।

সে খবর রূপমের হাত ছুঁইয়ে আকাশের চাঁদ— আমি পাখি ঠোঁট

কিংবা চাতক, মাছরাঙা ধ্যানে নেটের শহীদবেদীমূলে,

তুমি ফুলের তোড়ার মতো মহামারি মেরে সুবাস ছড়াও।


স্মৃতির প্রসাধন

স্মৃতি মোছার খেলায় মেতে হাতে রেখে স্বর্গের হাত

সাক্ষী তার নীতি—দূর্নীতি তবু অসম্ভব হয়ে ওঠে ভুল—

পথ পাওয়া। নেকাবের নিচে লিপস্টিক: ভান ! আর

অন্ধ বধূর বিশ্বাস বাড়ি রাত্রির মোড়ে! একা ঘোরে

নিজেকে ঘোরায় দূরে দেয়ালের ওপাশে কিশোরী

আগুন ঠোঁট, মুখোমুখি হেসে ওঠে ঘসেটি প্রলয়।

তবুও আলেয়ার আলো ছুঁইয়ে এক নদী চাঁদ,

একাকী জাগে ক্ষোভে টুপটাপ ইতিহাস, রক্ত বেয়ে—

পিছলে দাঁড়ায় ফোর্ডের কলেজ ডামাঢোলে প্রসাধনে

কারূকাজ নাকি বাংলামায়ের চেতনকণ্ঠে বেদনার ফাঁস?

 

গবেষণা

সেদিনের কথা। নিগূঢ় জোছনায় ভিজে প্রিয়া বলে,

কাম ছাড়া ভালোবাসা, দাম নেই যার। কামরাঙা

লতাপাতা তারপর পরিণয়: বিয়া। চোখ বুজে বুজে

আনমনে অদ্ভুত কথা, সাপের ফণায় ভঙিমা শরীর

সয়ে—বিস্ময়ে রোপন করি কতিপয় ব্যথা। জ্বরে পুড়ে

প্রিয়া, আরও পুড়ে কাল, কি কথা বোঝাতে নিরালা নিপুণ

গবেষণা দেহে ঝোলে কাশ্মিরী শাল। কথার মাঠে

কতো শতো বীজকথা, সপ্রমাণ, খোলামেলা—অযথা।

আপন দেশ/আরএ

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ