Apan Desh | আপন দেশ

কলাপাতার লিখন ও গুডলাক কালি

আতা সরকার

প্রকাশিত: ১২:১১, ১০ অক্টোবর ২০২২

আপডেট: ১৫:৫৩, ২১ ডিসেম্বর ২০২২

কলাপাতার লিখন ও গুডলাক কালি

ফাইল ছবি

বর্ণপরিচয় ঠিকঠাক হতে না হতেই ঝোঁক চাপল লিখতে হবে। এখন লিখব কোথায়? অক্ষরগুলোই তো ঠিক মতো চেনা হয় নাই। কিন্তু এরই মধ্যে শোনা হয়ে গিয়েছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের গল্প, রবীন্দ্রনাথ নজরুলের শুধু গল্পই নয়, তাঁদের কবিতাও। আমি তো এখনই নিজেকে তাঁদের মাত্রায় ভাবতে শুরু করে দিয়েছি।

সুতরাং আমাকে লিখতেই হবে। কেন জানি আমাদের বাসায় তখনো সিলেট পেন্সিল চক ঢোকেনি। কাগজ কলম পেন্সিল আছে। সেসব স্পর্শ করার অধিকার আমার নেই। সময়টা গত শতকের। গল্প বলছি পঞ্চাশের দশকের। তাও এক অজ মফস্বল শহরের। মহকুমা শহর জামালপুরের ভাড়াটে বাসায় আমাদের বাস।

অগত্যা আর কি করা! উঠোনে ধুলো জমিয়ে সেটাকেই বানাই খাতা। ডান হাতের তর্জনি হলো কলম। উঠোনের মাটিতে ধুলোয় আঁকিবুকি যা কাটি সবই আমার লেখা। লেখা বটে, তাতে কোন অক্ষরের আদল নেই। আছে কতকগুলো সোজা বাঁকা দাগাদাগি। মনের খায়েশে জাত শিল্পীর ঢঙে ছবি আঁকারও কোশেশ।

পড়তে পড়তে অক্ষরগুলো যখন ঝরঝরে বলতে পারছি, এর সাথে রপ্ত হয়ে আ-কার ই-কারসহ বানান কায়দা, তখনই এলো রুল টানা খাতা। কাঠপেন্সিল। পেন্সিল কাটার জন্য তখনো কাটার দেখিনি, পেন্সিল আেঁছে চোখা শিস বের করতে ব্লেডের সাহায্য নেয়া।

এই ফাঁকে আমাদের হোম টিচারের কথা বলতে হয়। মেজো ভাই সেজো ভাই ছোট দুবোনসহ আমাদের পাঁচজনের অক্ষর জ্ঞান দিয়েছেন ছোট বুজান। ছোট বুজানের উপরে মিয়াভাই আর বড় বুজান।

ছোট বুজানের ছোট একটা পরিচয় দিয়ে রাখা ভালো। তাঁর নাম মনসূরা বেগম, আছমা নামে পরিচিতা। আমাদের ভাইবোনদের জন্য তিনি জ্ঞানের বাতিঘর। আমি যকন অক্ষরজ্ঞান নিচ্ছি তখন তিনি জামালপুর গার্লস স্কুলের ছাত্রী। কর্মজীবনেও তিনি শিক্ষকতাকেই বেছে নিয়েছিলেন। শুরু করেন কিশোরগঞ্জের এক স্কুলের মাধ্যমে। অল্প কিচুদিন পরেই চলে আসেন জামালপুরে নিজের পড়া স্কুলে, সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে। অধ্যাপক আবুল কাশেমের সাথে বিয়ের পর চলে যান স্বামীর কর্মস্থল রাজশাহীতে, সেখানে হেলেনাবাদ গার্লস স্কুলে যোগ দেন। অবসর নেন ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী গার্লস স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে। প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন, কিন্তু ট্রান্সফার গ্রহণ করেননি বলে তা কার্যকর হয়নি। দুলাভাই ময়মনসিংহ উইমেন টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ও ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন।

এই ছোট বুজানের কাছেই আমাদের অক্ষরজ্ঞান ও লেখা শেখা।

তিনি খাতায় গোটা গোটা করে অক্ষরগুলো লিখে দেন। পেন্সিলেই। সেই অক্ষরের উপরই হাত ঘুরাই। এখন বুঝি, আমাদের পাঁচ ভাইবোনের অক্ষরের ছাঁচ ছোট আপার হাতের লেখার মতো একারণেই।

লেখার প্রতি আগৃরহ ও আকর্ষণ তৈরির জন্য কায়দা-কানুনও কম করা হয় নাই। বাঁশের কঞ্চি কেটে একদিক চোখা করে কলম বানানো হয়েছে। কোন কালির প্রয়োজন নেই। কলাপাতা কেটে এনে তার উপর লিখেছি অ আ। কলাপাতার উওর সবুজ দাগ পড়ে লেখা ফুটে বেরুচ্ছে, এটাতে বেজায় আমোদ। কখনো কখনো কলম ডেবে গিয়ে পাতা ছিঁড়ে চৌখান। ওতেও মুখ ভারের বদলে আনন্দটাই বেশি। উৎসাহে আরো কলাপাতা কেটে আনতে যাই।

কিন্তু লেখার তৃপ্তিটা যেন পুরোপুরি আসে না। কাগজে কলমে কালিতে লেখালেখি না করলে কি মন ভরে? তার মধ্যে শহর জুড়ে প্রচার: গুড লাক ইঙ্ক সেরা কালি। এই কালিতে লেখা ঝকঝকে তকতকে। দোয়াতে কলম চুবিয়ে কাগজে লেখাট আনন্দই আলাদা। এর উপর কলমের চোঙ্গায় কালি না ভরলে লেখর মজাটাই আসবে কি করে?

গুড লাক তখন জামালপুর শহরেই তৈরি হয়। খুব সম্ভব স্টেশন রোডে। পুরো জামালপুর সাবডিভিশনে তার একচেটিয়া মার্কেট-- শহরে কিংবা গ্রামে। এই কালি ব্যবহার করে লিখতে মনটা বড়ই আনচান করত।

হাতের লেখা যখন খানিকটা পোক্ত হলো, শব্দ লিখতে পারি নিজে নিজে, 'সদা সত্য কথা বলিবে' বাক্যগুলোও রপ্ত হচ্ছে, তখনই এক অভিনব লেখা।

ঠিক লেখা নয়, কালি অভিনব। চাল পোড়া পোড়া মতো করে ভেজে সেগুলো গুরা করে নেয়া হলো। পানিতে ডুবিয়েই হয়ে গেল কালি। লেখাটা সোনাভ রঙের। ওতেই চুবাও বাঁশের কলম। কলম শুধু বাঁশের নয়, পাখির ফড়িয়া, পাখির না পাওয়া গেলে মুরগীর ফড়িয়া হয়ে গেল কলম।

সোনাভ নয়, কালো রঙটাই যে পছন্দ। এজন্য চাই গুড লাক ইঙ্ক।

কালি দোয়াত ঢুকতে না ঢুকতেই মনের দাবী জোরাল হয়ে উঠল ফাউন্টেন পেন বা ঝর্না কলমের।

এমন কলমেরই বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন কবিগুরু★

 

লেখক : আতা সরকার, কথাসাত্যিক ও কলামিষ্ট

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ