Apan Desh | আপন দেশ

সাত মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর অসংখ্য গুণাবলীর প্রকাশ

রেজাউল করিম খোকন

প্রকাশিত: ১৫:৪৯, ৫ মার্চ ২০২৩

আপডেট: ১৫:৫১, ৫ মার্চ ২০২৩

সাত মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর অসংখ্য গুণাবলীর প্রকাশ

ফাইল ছবি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছা শক্তি ও দূরদর্শিতা ছিল অত্যন্ত প্রবল। তার সহকর্মীদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত তরুণরা এবং ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের টগবগে সদস্যরা তার নেতৃত্বের প্রতি মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। পাকিস্তানিদের অন্যায়, অবিচার, জুলুম, শোষণের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার মতো যোগ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই তাদের হৃদয়ে আসন গেড়ে বসতে সক্ষম হয়েছিলেন।

পাকিস্তানি দুঃশাসন ও বৈষম্যমূলক নীতির শিকার সামরিক বাহিনীর কিছু চাকরিরত ও অবসরপ্রাপ্ত সদস্যও শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে ভাবতে শুরু করেছিলেন। দৃশ্যত, পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী সামরিক বেসামরিক পর্যায়ে বাঙালিদের প্রতি যে অমানবিক শাসন শোষণের প্রক্রিয়া চালাতে থাকে তা থেকে জাতিকে মুক্তির লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছিল ঐতিহাসিক ৬ দফা। পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত হয়েছে যে, ৬ দফা ছিল পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন রচনার প্রধান সোপান। শেখ মুজিব জানতেন, ৬ দফা দাবি কোনোভাবেই পাকিস্তান সরকার মেনে নেবে না। আর বাংলার জনগণ ৬ দফা গ্রহণ করলে এর ভিত্তিতে নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার জনগণ পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারবে। এভাবে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিকভাবে গড়ে উঠবে একটি ভিত্তি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ বঞ্চনার মাত্রা চরমে পৌঁছেছিল। বিশেষ করে অর্থনৈতিক শোষণ পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন অগ্রগতির চাকাকে রুদ্ধ করে ছিল।

মূলত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বৈদেশিক মুদ্রার নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার এবং বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের উন্নয়নের ব্যাপারে সুষম দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না। বিদেশি সাহায্যভুক্ত প্রকল্পের সিংহভাগই নেয়া হতো পশ্চিমাঞ্চলে এবং বিনিয়োগও হতো সেখানে। বাংলাদেশে উৎপাদিত পাট ও পাটজাত দ্রব্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার হতো পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পোন্নয়ন খাতে। এ অবস্থায় বাংলার জনগণ সামগ্রিকভাবে উন্নয়নে পিছিয়ে পড়ে, ফুটে ওঠে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে চরম বৈষম্যের চিত্র।

পাকিস্তান সৃষ্টির আগে থেকে অবিভক্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীতে বাঙালি সদস্য সংখ্যা ছিল খুবই কম। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নতুন রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর বিভিন্ন শাখায় লোক নিয়োগ করা হলেও তাতে বাঙালিদের নিয়োগ করা হতো খুবই নগণ্য  সংখ্যায়। যারা নিয়োগ পেতেন তাদের সঙ্গে পশ্চিমারা প্রায় সময় দুর্ব্যবহার করতো। নানা অজুহাতে বাঙালি অফিসার সৈনিকদের চাকরিচ্যুতি ছিল নিত্য নৈমত্তিক ঘটনা। এ নিয়ে পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকেই বাঙালি সেনা সদস্যদের মধ্যে ক্ষোভ ও বিদ্রোহী মনোভাব তৈরি হয়েছিল। বাঙালি অফিসার ও সৈনিকরা সব সময়েই পরিণত হতো পাকিস্তানি অফিসারদের রাজনৈতিক শিকারে। বড় বড় সব পদ আর লোভনীয় নিয়োগগুলো বরাবরই থাকতো পাকিস্তানিদের ভাগ্যে। বিদেশে উচ্চতর শিক্ষা কিংবা প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হতো না বাঙালি অফিসারদের। এরপর এলো আইউবি দশক। আইউব খানের নেতৃত্বে চালিত এক প্রতারণাপূর্ণ সামরিক শাসনের কালো দশক। বাংলাদেশের বীর জনতা অবশ্য বীরত্বের সঙ্গে প্রতিহত করেছে এই হীন প্রচেষ্টা।

৬ ও ১১ দফার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের জোয়ারের মধ্যেই ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যার ফলাফল গোটা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল। যদিও আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ ছিল দীর্ঘ সংগ্রাম, আন্দোলনের অনিবার্য ফসল। ৭০-এর নির্বাচনের ফলাফল খুব স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতার দম্ভ আর শাসক-শোষক মনোভাবের প্রতি চরম আঘাত ছিল যা তাদের আসনকে টলিয়ে দিয়েছিল। তার ক্ষমতা হারানোর ভয়ে প্রমাদ গুনতে শুরু করেছিল, আর ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে শুরু করেছিল। কীভাবে বাঙালিদের নির্বাচনী বিজয়ের ফলাফল ধূলিসাৎ করে দেয়া যায়, তার ফন্দিফিকির শুরু করেছিল তারা। সামরিক শক্তির প্রয়োগে বাঙালিদের উত্থানকে রোধ করতে তারা উঠে পড়ে লেগেছিল। ওই নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে বাংলার জনগণ ৬ দফার ভিত্তিতে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন অথবা নিজেদের ভাগ্য গড়ার ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের ওপর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব অর্পণ করেছিল। পশ্চিমারা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তথা বাঙালিদের ঐতিহাসিক বিজয় ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে শুরু করেছিল নানামুখী ষড়যন্ত্র। পাকিস্তানের পুঁজিপতি ও সামরিক আমলাচক্র ও রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের কর্তৃত্ব হারানোর ভয়ে যোগ দিয়েছিল ষড়যন্ত্র। ইয়াহিয়া খানের ভূমিকা ছিল শঠতাপূর্ণ। বস্তুত ১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দলের নিরঙ্কুশ বিজয়ের প্রেক্ষাপটে দীর্ঘদিনের  শাসন-শোষণের একচেটিয়া ক্ষমতা হারানোর ভয়ে পশ্চিমা  শাসকগোষ্ঠী ও তাদের এদেশীয় কায়েমী স্বার্থবাদী মহল প্রমাদ  গুণতে থাকলো। জনগণের পক্ষে কথা বলার একমাত্র বৈধ  প্রতিনিধি হিসেবে বঙ্গবন্ধু এবং নিজেদের মুক্তির উপায় হিসেবে ৬  ও ১১ দফার প্রতি গণরায় পশ্চিমাদের শাসনের ভিতকে নাড়িয়ে  দিয়েছিল। জাতীয় পরিষদে সাধারণ আইন তো বটেই প্রাদেশিক  পরিষদের যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিরঙ্কুশ অধিকার  আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবুর রহমান পাওয়ায় আতঙ্কিত  পাকশাসক গোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করে। মেতে ওঠে  বাঙালিদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার গোপন ষড়যন্ত্রে। কথা  ছিল, ৩ মার্চ নির্বাচিত জাতীয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে।সমগ্র পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ তখনো আশা করেছিলেন যে  তাদের দীর্ঘদিনের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটবে পার্লামেন্টের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। গণতান্ত্রিক রীতি-নীতির বিকাশ ঘটবে রাজনীতি শাসন ক্ষেত্রে। কিন্তু তাদের আশা অচিরেই ধুলোয় মিশে গিয়েছিল ইয়াহিয়া ভুট্টোর চক্রান্তে। ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া বানচালের চক্রান্তে প্রাথমিকভাবে সফল হন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে। ৭১-এর ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান এক ঘোষণায় ৩ মার্চের প্রস্তাবিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে বাংলার ছাত্র-শিক্ষক, শ্রমিক, কৃষক-মজুর, জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। ইয়াহিয়ার স্বৈরাচারি ঘোষণায় বিক্ষুব্ধ জনতা রাজপথে নেমে এসেছিল, দোকানপাট, রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগ ১ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল এবং ৭ মার্চ রেসকোর্সে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) জনসভার কর্মসূচি ঘোষণা দেয়।

নির্বাচনপরবর্তী দিনগুলোতে বিভিন্ন সময় পাকিস্তানি বর্বরবাহিনী বাংলার মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ বিক্ষোভ দমনের উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকে। পাশাপাশি ২ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো প্রতিদিন পালিত হতে থাকে হরতাল। ৬ মার্চ পর্যন্ত কর্মসূচি পালিত হওয়ার পর এলো সেই বহু আকাক্সিক্ষত ৭ মার্চ, শিহরণ জাগানো ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানের রাজপথ জুড়ে নিমেছিল জনতার ঢল, বিশাল রেসকোর্স ময়দানের কোথাও তিল ধারনের ঠাঁই ছিল না। ছাত্র-জনতাসহ দেশি-বিদেশি অনেকের ধারণা ও প্রত্যাশা ছিল, এই বিশাল জনসমুদ্রের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। তাই সভার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবার দৃষ্টি ছিল বঙ্গবন্ধুর দিকে। সবার অনুমান ছিল রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ঘোষণা দেবেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার।

৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের কথা বলেছেন। মুক্তির জন্য সংগ্রামের কথা বলেছেন। যুদ্ধ শব্দটি সরাসরি না বলে লড়াইয়ের জন্য জনগণকে প্রস্তুত হতে বলেছেন। সামরিক বেসামরিক পর্যায়ে চাকরিজীবী ও সাধারণ মানুষের অনেকেই এই ভাষণ শুনে শিহরিত হয়েছেন। সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের গন্ডিবদ্ধ নেই। বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতাপ্রাপ্তি তার সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই ভাষণ শোনার পর থেকে যে রক্ত আগুন জ্বলে ওঠে বাঙালির শিরায় শিরায়Ñ সেই থেকে নতুন উদ্যেমে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সমগ্র বাঙালি জাতির মনে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বাড়িয়ে দিয়েছিল শত সহস্রগুণ। দেরি যেন আর সয়না কারো এক মুহূর্তও সারা দেশের মানুষের, বেসামরিক প্রশাসন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবকিছুই তখন থেকে চলছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। সাধারণ কৃষক-শ্রমিক থেকে দিনমজুর, গৃহবধূর মুখে মুখে তখন বলাবলি হচ্ছিল বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের সঙ্গে থাকছে না। শেখ সাহেব ঘোষণা করছেন, দেশে স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। অবস্থা বুঝে সবাই ধরে নিয়েছিলেন, যে কোনো মুহূর্তে দেশে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ওই ভাষণেই তিনি জনগণকে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দিয়েছিলেন। শত্রুকে মোকাবিলার আহবান এবংএবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবং এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে প্রকারন্তরে তিনি অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাই দিয়েছিলেন তার এই ঘোষণাকে ভিত্তি করেই সারাদেশে শুরু হয়েছিল প্রস্তুতি। তবে ওইদিন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দেয়ার কারণ প্রসঙ্গে ওই সময়ের সার্বিক প্রেক্ষাপট ও বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। তৎকালীন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তখনো বিশ্বের অন্যতম প্রধান পরাশক্তি দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ শক্তি চীন পাকিস্তান সরকারের প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলে বা যুদ্ধ শুরু হলে তা দীর্ঘায়িত হবে নাকি স্বল্পকালীন হবে তার নিশ্চয়তা ছিল না। এ ছাড়া যুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন লাভের বিষয়টি বৃহৎ শক্তিবর্গের ভূমিকার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের মৈত্রী চুক্তি তখনো সম্পাদিত হয়নি। পাকিস্তানিদের দীর্ঘদিনের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, বছরখানেক আগে শেষ হওয়া আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার ফলাফলসহ সামগ্রিক বিষয়টি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে ছিলেন সে সময় বঙ্গবন্ধু। সবদিক বুঝে শুনেই ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি দিয়েছিলেন তিনি।

আব্রাহাম লিংকন, উইনস্টন চার্চিল এবং বঙ্গবন্ধুÑতিন মহানায়কের তিনটি কালজয়ী ভাষণ বিশ্বের ইতিহাসে অম্লান হয়ে আছে। এই তিন মহানায়কের ভাষণের মধ্যে অপূর্ব মিল দেখা যায়Ñমার্কিন গণতন্ত্রের পথ প্রদর্শক আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণ, ব্রিটিশ জাতির সংকটকালীন প্রদত্ত উইনস্টন চার্চিলের যুদ্ধকালীন একটি বেতার ভাষণ ও বাঙালি জাতির চরম ক্রান্তিলগ্নে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত হওয়ার সার্বিক দিক-নির্দেশনা দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ। তিনি ৭ মার্চের ভাষণে জনতাকে সুষ্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তার অবর্তমানে কীভাবে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে, তার সুস্পষ্ট কৌশল পন্থা তিনি তার ভাষণে সহজভাবে ব্যক্ত করেছিলেন। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রতিটি শব্দে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতিকে বিদ্রোহ করার অনুপ্রেরণা দেয়া হয়েছে। ওই ভাষণে যুদ্ধ পরিচালনার সকল নির্দেশনা ছিল। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের উদ্দীপনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে এবং মাত্র নয় মাসে দেশ স্বাধীন হয়েছে এটা মানতেই হবে সবাইকে। ৭ মার্চের ভাষণে প্রদত্ত নির্দেশ মতো মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছে জীবনবাজি রেখে। ওই ভাষণই ছিল মুক্তিযুদ্ধের নৈতিক বলের প্রধান উৎস এবং যুদ্ধ পরিচালনার পদ্ধতি ও কৌশল। আজকের নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দারুন কারিশমেটিক একজন নেতা মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ একটি ভাষণেই তিনি গোটা বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন।

এর আগে ক্ষুদিরাম এসেছিলেন, তিতুমীর, সুভাষ বসু, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সূর্যসেন এসেছিলেন। তারা পরতে পরতে মহা আহ্বানের সোপান রচনা করে গেছেন। অবশেষে এলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সাগর সমান প্রমত্ত প্রবাহ তার ভাষণকে হৃদয়ের বীনায় ঝংকৃত করে দিয়েছিল। ছোট বড় বিরাশিটি বাক্য সমন্ব^য়ে সাড়ে আঠার মিনিটের ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ওই ভাষণে রাজনীতি ছিল, সমাজ অর্থনীতি ইতিহাস সবই ছিল, অসহযোগের আহ্বান ছিল, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ধিক্কার ছিল, যুদ্ধের বিশাল প্রস্ততির কথা ছিল। এমন হৃদয় বিদীর্ণ করা, এমন দিগন্ত প্লাবিত করা, এমন আবেগ মথিত জলোচ্ছ্বাসময় প্রবল ভাষণ বাংলাদেশের মানুষ আগে কখনো শোনেনি। এই ভাষণ শুধুমাত্র ভাষণ ছিল না, যা ছিল এক বীজমন্ত্র যা কোটি কোটি মানুষকে শুধু উদ্দীপ্ত করেনি, এক কঠিন সংগ্রামের দিকে ধাবিত করেছে। যে কোনো ব্যক্তি নয়, একটা আলোড়িত জাতির মর্মমূল থেকে এই ভাষণের উৎপত্তি প্রাকৃতিক ঘটনার মতো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে সমগ্র বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য পুরোপুরি মানসিকভাবে তৈরি করেছিলেন। স্বাধীনতার ঘোষণা ছাড়া, অন্য কিছুতেই তারা তখন সন্তুষ্ট হতো না। সে জন্যই ২৬ মার্চ থেকে বাঙালিরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশের সবখানে প্রতিরোধের লড়াইয়ে নেমে পড়েছিল।

আর কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণার জন্য তারা অপেক্ষা করেনি তখন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন তিনিই দেখিয়েছিলেন বাঙালিকে। তিনি বহু দলে বিভক্ত বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন ৭ মার্চের কালজয়ী সেই ভাষণের মাধ্যমে। তার উদাত্ত আহ্বান যাদুকরী প্রভাব ফেলেছিল এদেশের আবালবৃদ্ধবণিতা সবার হৃদয়ে। ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জাতির জনক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিলেন জনগণের কাছে। ওই ভাষণেই তিনি সাহস, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দক্ষতা, নেতৃত্বের গুণাবলীর প্রকাশ ঘটিয়ে ছিলেন অদ্ভুত সুনিপুণতায়; যা সচারচর সব নেতার ক্ষেত্রে ঘটে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে।

লেখক: রেজাউলকরিম খোকন, অবসরপ্রাপ্ত  ব্যাংকার ও কলাম লেখক।

(আপন দেশ -এর সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের আপন কথার মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার আপন দেশ ডটকম  নেবে না।)

 

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ