Apan Desh | আপন দেশ

স্যাটানিক ভার্সেস ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা

মোস্তফা কামাল

প্রকাশিত: ১১:৩০, ১৪ আগস্ট ২০২২

আপডেট: ২২:৪১, ১৮ আগস্ট ২০২২

স্যাটানিক ভার্সেস ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা

ফাইল ছবি

“মত প্রকাশের স্বাধীনতা” প্রয়োগ করা যে কত বিপজ্জনক তা আমার মতো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একজন কলমজীবীর হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করার সুযোগ হয়েছে ১৯৯৬ সালে। স্বাধীন মত প্রকাশ করতে গিয়ে আমাকে চাকুরিচ্যুত হতে হয়েছে, আমার সম্পাদিত একটি মাসিক ম্যাগাজিনের সার্কুলেশন হ্রাস পেয়েছে এবং কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়েছে। চিঠিতে অসংখ্য এবং টেলিফোনেও কিছু হুমকি লাভ করেছি।

তবুও আমি যে কারও যেকোনো মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এমনকি সালমান রুশদি তাঁর “স্যাটানিক ভার্সেস” যে উদ্দেশে বা যাদের লক্ষ্য করেই লিখে থাকুন না কেন, আমি তাঁর লেখাকে সাদরে গ্রহণ করেছি এবং তাঁর সাহিত্য প্রতিভার প্রশংসা করেছি এবং এখনও করি।

“স্যাটানিক ভার্সেস” যখন প্রকাশিত হয় (সেপ্টেম্বর ১৯৮৮) তখন আমি ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের স্কলারশিপ নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে কিছু পড়াশোনার কাজে নিয়োজিত ছিলাম। গ্রন্থটি নিয়ে মুসলিম বিশ্বে যখন বইটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। যারা প্রতিবাদ করছিলেন, তাদের অধিকাংশই যে বইটি পাঠ করেননি সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের বুক স্টোর থেকে আমি বইটি কিনে আমি নিবিড়ভাবে পাঠ করেছি। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ইসলামে বিশ্বাসীদের আপত্তি করার যথেষ্ট খোরাক “স্যাটানিক ভার্সেস” এ রয়েছে। কিন্তু কারও কল্পনার জগতে হানা দেওয়ার কী অধিকার আমার আছে! 

আমাদের গ্রুপে মোট আঠারো জন সাংবাদিক-ছাত্রের মধ্যে ১২ জন যুক্তরাষ্ট্রের, আমি সহ ৬ জন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের এবং একমাত্র আমিই মুসলিম। নিয়মিত ক্লাসের অতিরিক্ত প্রতি বুধবার লাউঞ্জে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে উপস্থিত থাকা আমাদের জন্য ম্যান্ডেটরি। প্রোগ্রামের ডাইরেক্টর দুই বার পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী সাংবাদিক জেমস ভি রিসার এবং প্রোগ্রামের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর হ্যারি এন প্রেস (পরলোকগত) একদিন আমাকে বললেন যে বিশেষ করে আমার জন্যই একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে, আমি যাতে প্রস্তুতি নিয়ে আসি। মূল বক্তা হিসেবে আসবেন ইউসি বার্কেলির ইতিহাস বিভাগের একজন প্রফেসর। সেমিনারের বিষয়বস্তু সালমান রুশদির (আমেরিকানরা উচ্চারণ করে ‘রাশদি’) “স্যাটানিক ভার্সেস।” আমি তাদের জানালাম, বইটি ইতোমধ্যে আমি পড়েছি, অতএব আমার প্রস্তুতি আছে। 

ইতোমধ্যে আমি নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতো সংবাদপত্রগুলোতে “স্যাটানিক ভার্সেস” এর রিভিউ এবং পক্ষে-বিপক্ষে যা লেখা হচ্ছিল, সেগুলোর ওপরও দৃষ্টি রাখছিলাম। মূল আলোচক যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সংবিধানে “মত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা’র গ্যারান্টির সুযোগ নিয়ে ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের ওপর কিছু বলা বা লেখার ক্ষেত্রে সতর্ক ও যথাসম্ভব সংযত থাকার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন, যাতে তারা তাদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় ধর্মবিশ্বাসীদের চেতনার ওপর আঘাত হেনে সমাজ ও রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করেন। কারণ মানুষ ব্যাপক অর্থে তাদের বিশ্বাসকে ধারণ করেই বাঁচে এবং বিশ্বাসের ওপর আঘাতকে ব্যাপকভাবে নিজেদের ওপর আঘাত বিবেচনা করে। সেমিনারে অংশগ্রহণকারীদের অনেককেই ধর্মনিষ্ঠ ছিলেন, তারাও প্রফেসরের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। 

ধর্মে আমার বিশ্বাস অটল এবং অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু এ বিষয়ে আমার জ্ঞান সীমিত। তবুও ইতিহাস পাঠ করে ধর্মীয় অসহনশীলতার পরিণতি সম্পর্কে যতটুকু জানি, সক্রেটিসের সত্য কথনকে সহ্য করতে না পেরে তাঁকে বিষপানের দণ্ড দেওয়া, হযরত ঈসা ইশ্বরের বাণী প্রচার শুরু করলে তাঁকে ক্রশবিদ্ধ করে হত্যা করা, মহানবী মুহাম্মদ সা: এর ওপর নিপীড়ন ও তাঁর জন্মভূমি থেকে বিতাড়ন, এবং ক্রসেডে অগণন খ্রিষ্টান ও মুসলিম হত্যাযজ্ঞের দৃষ্টান্ত সংক্ষেপে উপস্থাপন করে “স্যাটানিক ভার্সেস” সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন তুলে ধরলাম। শ্রোতাদের পক্ষ থেকে কিছু প্রশ্ন এলো, প্রশ্নকর্তাদের সকলকে সন্তুষ্ট করার মতো উত্তর আমার কাছে না থাকায় প্রফেসর সাহেব সেগুলো খোলাসা করলেন। 

“স্যাটানিক ভার্সেস” পড়ার আগে আমি সালমান রুশদির আর কোনো উপন্যাস পড়িনি। বিতর্ক তুঙ্গে ওঠার সময়ের মধ্যে তাঁর “মিডনাইট’স চিলড্রেন”ও পড়া হলো, যে উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৮১ সালে ‘বুকার প্রাইজ’ লাভ করেছিলেন। তাঁর চরিত্র চিত্রণ ও ভাষার কারুকাজে বিস্মিত না হয়ে উপায় থাকে না। এটিকে আমার পড়া সেরা উপন্যাস বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না। ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ এর বিরুদ্ধে আপত্তি ওঠেছে, মুসলিম দেশগুলোতে, এমনকি ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ দেশও সমাজে বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে বইটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যদিও সংশ্লিষ্ট প্রতিটি দেশের সংবিধানে “বাক স্বাধীনতা,” “সংবাদপত্রের স্বাধীনতা” ইত্যাদির কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। “স্যাটানিক ভার্সেস” দেশে দেশে নিষিদ্ধ হওয়া একমাত্র উপন্যাস নয়, এর আগেও অনেক বই নিষিদ্ধ হয়েছে, অনেক বইয়ের ওপর আদালতের নিষেধাজ্ঞা এসেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ ঘোষিত সকল বই বাজারে পাওয়া গেছে। 

শুধু বই নয়, শিল্পকর্মের ওপরও নিষেধাজ্ঞা এসেছে, মামলার পর মামলা হয়েছে। লেখক, শিল্পীদের বছরের পর বছর নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়েছে, যার স্মরণযোগ্য দৃষ্টান্তা ভারতের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মকবুল ফিদা হোসেন। জ্ঞানের দেবী স্বরস্বতীর একটি নগ্ন রেখাচিত্র অঙ্কন করার “অপরাধে” তাকে দেশ থেকে পালাতে হয় এবং তিনি আর দেশে ফিরে আসতে পারেননি। নির্বাসিত অবস্থায় তিনি মারা যান। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, কংগ্রেস সরকার যখন ভারতে “স্যাটানিক ভার্সেস” নিষিদ্ধ করে তখন বিজেপি নেতারা কংগ্রেসকে এই বলে সমালোচনা করেছিলেন যে তারা মুসলিম ভোট ব্যাংক ঠিক রাখার জন্য তারা যেকোনো বই নিষিদ্ধ করতে পারে। বিজেপি এবং উদার ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা “বাক স্বাধীনতার” পক্ষে যুক্তি দিয়ে মুসলমানদের নবীর অপমানে ক্ষুব্ধ হওয়া উচিত নয় বলে উপদেশ দান করে; কিন্তু এম, এফ হুসাইনের হিন্দু দেবীর নগ্ন চিত্র অঙ্কনকে “বাক স্বাধীনতা” বলে স্বীকার করে না। সাহিত্য ও শৈল্পিক প্রকাশের প্রতি তাদের প্রকৃতপক্ষে কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের কারণেই পরিস্থিতি বেশি ঘোলাটে হয়।  

কাজেই ব্যাপারটি এমন নয় যে শুধু ইসলাম বিরোধী কিছু লেখা বা নবী মুহাম্মদের ব্যঙ্গচিত্র অঙ্কনের কারণেই মুসলমানরা প্রতিবাদ করে বা তাদের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চড়াও হয়, বা হত্যা করার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে। যেকোনো ধর্মে বিশ্বাসী সকলের মধ্যে একই ধরনের চেতনা কাজ করে না। অনেকে নমনীয় থাকে, তারা ইতিবাচক উপায়ে ধর্মবিরোধিতার প্রতিকার করার পথ খুঁজে। ধর্মান্ধরা তাদের ধর্ম ও ধর্মীয় নেতাদের নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রƒপ বা কটুক্তি করলে উগ্র প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে। যারা প্রতিবাদ করেন তারা যদি হত্যা, অগ্নিসংযোগসহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মতো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হন, তাহলে নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদ করারও অধিকার তাদের রয়েছে। কারণ প্রতিবাদ করাও “বাক স্বাধীনতার” অংশ। 

“স্যাটানিক ভার্সেস” এবং অন্যান্য সাহিত্য ও চিত্রকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় জানমালের বহু ক্ষয়ক্ষতি হওয়া ছাড়াও লেখক ও শিল্পীদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কেবল শোচনীয় হয়েছে। গ্রন্থটির জাপানি অনুবাদক হিতোশি ইগারাশিকে ১৯৯১ সালে হত্যা করা হয়; ১৯৯৩ সালে স্যাটানিক ভার্সেস এর নরওয়েজিয়ান প্রকাশক উইলিয়াম নেগার্ড অল্পের জন্য হত্যা প্রচেষ্টা থেকে রক্ষা পান; ২০০৪ সালে চলচ্চিত্র নির্মাতা থিয়ো ভ্যান গগ আমস্টারডামে নিহত হন; ২০০৫ সালে ডেনিশ কার্টুনিক নবী মুহাম্মদের ব্যঙ্গচিত্র অঙ্কন করায় হুমকির সম্মুখীণ হন। ২০০৮ সালে শেরি জোনসের “দ্য জুয়েল অফ মেদিনা” উপন্যাসের প্রকাশকের বাড়িতে বোমা নিক্ষেপ করা হয়। ২০১৫ সালে প্যারিস থেকে প্রকাশিত ‘শার্লি হেবদো’র কার্টুনিস্টকে হত্যা করা হয়। 

“স্যাটানিক ভার্সেস” প্রকাশিত হওয়ার ৩৪ বছর পর সালমান রুশদি যুক্তরাষ্ট্রে এসে  হামলার শিকার হয়েছেন। তাঁর জীবন সঙ্কটাপন্ন। আমি তাঁর নিরাময় আশা করি।

লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, নিউইয়র্ক

( আপন দেশ ডটকমের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের আপন কথার  মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার আপন দেশ ডটকম নিবে না।)

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

জনপ্রিয়