Apan Desh | আপন দেশ

শ্রমিকরা মানুষের অংশ 

আবদুল আউয়াল ঠাকুর

প্রকাশিত: ২৩:৫৫, ৩০ এপ্রিল ২০২৩

আপডেট: ০১:০১, ১ মে ২০২৩

শ্রমিকরা মানুষের অংশ 

ছবি : আপন দেশ

রেনেসাঁ উত্তর মানুষের মুক্তির সনদ হিসেবে বিবেচনা করা হয় গণতন্ত্রকে। গণতন্ত্রে নিরঙ্কুশ ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষফলই হচ্ছে শ্রম দাস। নিয়ন্ত্রণহীন ব্যক্তি স্বাধীনতা চূড়ান্তকরণেই সেদিন যে শিল্প বিপ্লব হয়েছিল তার ফলেই মানুষের মুক্তির পরিবর্তে একশ্রেণির মানুষের গড়ে উঠেছিল অবাধ পুঁজি আর এক শ্রেণি পরিণত হয়েছিল শ্রম দাসে। সে বিবেচনায় দেখলে বলতে হবে মানুষের মুক্তির যে স্লোগান রেনেসাঁয় দেয়া হয়েছিল ঠিক তেমনটি ঘটেনি বা ঘটতে পারেনি। শ্রম দাস থেকে বের করে শ্রমকে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা ও শ্রমিক তথা শ্রমজীবি মানুষের মর্যাদা অধিকার প্রতিষ্ঠার বর্তমান যুগের সূচনা দিবসকেই বলা হয় মে-ডে।

বাস্তবতা হচ্ছে, ইসলামে শ্রমের মর্যাদা অনেক  আগে  থেকেই  স্বীকৃত। অনেক নবী-রাসুল শ্রম দিয়ে নিজের পরিবারের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করেছেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকাবার আগেই তার মজুরি পরিশোধ করতে বলেছেন। শ্রমিক শ্রেণির ইবাদত কবুলেরও বিশেষ ঘোষণা দেয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনুল কারিমের সুরা জুমায় পরিস্কারভাবে বলা হয়েছে তোমরা নামাজ আদায় করে ব্যবসা-বাণিজ্যে বেরিয়ে পরো। সুতরাং শ্রমের মর্যাদা নিয়ে কোনো প্রশ্ন অতীতেও ছিল না। মানবাধিকার যুগের সূচনার আগে শ্রমিক নির্যাতনের কোনো বড় ধরনের বিররণ পাওয়া যায় না।

সেসময়ে মানুষকে শ্রমভিত্তিক বিভাজনে দেখা হতো না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটি ঠিক মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে সমাজে এমন এক শ্রেণির জন্ম হয়েছে যারা মানুষকে বিচার করতে শুরু করেছেন ধন-সম্পদ ও দুনিয়াবি আচরণের মাধ্যমে। কার্যত সে সূত্র ধরেই সমাজে সৃষ্ট বৈষম্য নিরসনে মানুষকেই লড়াই করতে হয়েছে মানুষের গড়া বিভাজনের বিরুদ্ধে। এই বিভাজনে প্রকৃতি নানা জায়গায় নানারূপ। 

শ্রমের বিভাজনের বিরুদ্ধে যে লড়াই তার জন্ম হয়েছিল ১৮৮৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হেমার্কেটে। মূলত নির্দিষ্ট শ্রমঘণ্টার দাবিতে এ আন্দোলন হলেও এরমূলে ছিল শ্রমজীবি তথা মানুষের মুক্তির দাবি।

আজ ১ মে। ঐতিহাসক মহান মে দিবস। আজকের দিনে এটিই সত্য যে, দলমত নির্বিশেষে মহান মে দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে নানা কর্মসূচী পালিত হবে। সেই সঙ্গে স্মরণ করা হবে নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টাসহ ন্যায়সঙ্গত দাবি ও অধিকার আদায়ের উদ্দেশ্যে ১৮৮৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর হে মার্কেটের ঐতিহাসিক সমাবেশও তাৎপর্যবাহী ঘটনা। বাস্তবতার নিরিখে নানা ঘটনা স্থান করে নিলেও মূলত মে দিবসের মূল করণীয়তে কোনো পরিবর্তন আসেনি। যদিও এ কথা বলে রাখা দরকার যে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এক সময় বিশ্বে মহা ধুমধামে মে দিবস পালিত হতো। আজকের বিশ্বে আনুষ্ঠানিকতা, জাঁকজমক, ঠাটবাট ঠিক থাকলেও দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বব্যাপী এখন অর্থনৈতিক শোষণের জন্য অথবা প্রভাব বলয় বিস্তারের নানা কৌশল অব্যাহত রয়েছে। সে কারণেই মে দিবসের মূলগত চেতনায় চক্রান্তের বিরুদ্ধে বিশ্ব মানবতার শক্তি সংহত হচ্ছে। শিল্প বিপ্লবোত্তর পাশ্চাত্য দুনিয়ায় যে ভোগবাদী শোষক চক্রের অভ্যুদয় হয়েছিল তারা মূলত কাণ্ডজ্ঞানহীন অবস্থায় উপনীত হয়েছিল। 

তাত্ত্বিকভাবে যাই বলা হোক না কেন, বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত উপনিবেশের কারণে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশগুলো অবৈধভাবে হঠাৎ করেই ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক শোষণ তীব্রভাবে টিকে থাকায় মূলত পুুঁজিবাদ তখন দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছিল। ১৮৮৬ সালের সেদিন ছিল শনিবার। এর আগেও আমেরিকার শ্রমিকরা আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে বিক্ষোভ করে আসছিলেন। সমগ্র আমেরিকা যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল তার প্রধান কেন্দ্রস্থল ছিল শিকাগো। আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে হাজার হাজার মানুষের সংহতি শোষক শ্রেণি সুনজরে দেখেনি। ধারাবাহিক সমাবেশে ৩ মে শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ করেছিল। এতে ছয়জন নিহত এবং অনেকেই আহত হয়েছিলেন। ৪ মে গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে শিকাগোর হে মার্কেট স্কয়ারে লাখো মানুষের সমাবেশ হয়েছিল। বক্তৃতা শেষে সমাবেশের অদূরে রাতের আকাশ প্রকম্পিত করে বোমা বিষ্ফোরিত হলে নিহত হয়েছিলেন জনৈক পুলিশ কর্মকর্তা। পুলিশের ওপর আক্রমণের অজুহাতে পুলিশ বাহিনী শ্রমিকদের ওপর শুরু করে বেপরোয়া গুলিবর্ষণ। শ্রমিকরা রুখে দাঁড়ালে সংঘর্ষে চারজন শ্রমিক এবং সাতজন পুলিশ মারা যান। শ্রমিকদের রক্তে ভেজা লাল শার্টকে সেদিন সেভাবে তারা পতাকা বানিয়েছিল সেটিই পরবর্তীকালে সর্বহারা শ্রেণির প্রতীক লাল পতাকার সঙ্গে একাকার হয়েছিল।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, মহান মে দিবসের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী শ্রম ব্যবস্থায় যে ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে, তা এখন শিল্প ব্যবস্থাপনায় নয়া দিগন্তের উন্মোচন করেছে। এ ঘটনার মধ্য দিয়েই শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। এই সম্পর্কের যৌক্তিক দিক নিয়ে এখনো তেমন কোনো প্রশ্ন নেই। বর্তমান সময়ে হোয়াইট কালার শ্রমিক শ্রেণির জন্ম হয়েছে। নতুন আঙ্গীকে তাদের বিকাশ হয়েছে এবং হচ্ছে। এখন শুধু সাধারণ শ্রমিকই নয় বরং অফিসার্স নামে যারা পরিচিত, তাদের মধ্যেও প্রকারান্তরে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে উঠেছে। আত্মোন্নয়নের সিঁড়ি হিসেবে এসব ইউনিয়ন ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে বর্তমানে শ্রমিকরাজের ধারণা নেই বরং প্রেশার গ্রুপ হিসেবে এক ধরনের শ্রমিক শ্রেণির অস্তিত্ব রয়েছে। পোল্যান্ডের লেস ওলেসার আন্দোলন শ্রমিকরাজ বিরোধী ছিল। 

বাংলাদেশে এখন যে ধরনের ট্রেড ইউনিয়ন চালু রয়েছে, এর মধ্যে কার্যত শ্রমিকরাজ ধারণার কোনো প্রচলন নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পর্যালোচনা করলে এটি বলা যায় যে, কোনো না কোনোভাবে শ্রমিক সংগঠনগুলো সরকারি যন্ত্রের উইপেন হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে বিধায় দেশের প্রকৃত শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণ সাধিত হতে পারেনি। তবে বেতন বেড়েছে। ঠাট-বাট একেবারে কম হয়নি। অন্যদিকে শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের গাড়ি-বাড়ি এবং বিদেশে বড় বড় ব্যাংক ব্যালেন্সের খবরও প্রায়ই প্রকাশিত হচ্ছে। মে দিবসের সফলতার জন্যই হোক আর প্রতিবিপ্লবী চেতনার জন্যই হোক বিশ্বজুড়ে শ্রমিকের যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে মূলত পেশাদারিত্বের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের যারা কাজ করেন, তারাও এক ধরনের শ্রমিক। মে দিবসের সুফলে তাদেরও অধিক হারে বেতন-ভাতা নির্ধারিত হচ্ছে।

শিল্পীয় শ্রমিক ছাড়াও গৃহকাজে যারা নিয়োজিত, তাদের সম্পর্কেও আল্লাহর নবী (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন, তোমরা যা খাবে তাদেরকেও তা খাওয়াবে। ইসলামী ব্যবস্থায় উৎপাদিত ফসলের ওপর কর আরোপের ফলে সেখানেও শ্রমের মর্যাদাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ইসলাম মূলত মানুষে মানুষে ভেদ নীতির বিরোধী। এখানে মানুষকে বিবেচনা করা হয় আল্লাহর আনুগত্যকারী হিসেবে কে কতটা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে তার ভিত্তিতে। দুনিয়ায় জীবন ধারনের পেশাকে কেন্দ্র করে কোনো বৈষম্য বা শ্রেণিবিন্যাস করা ইসলামের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইসলামী সমাজে সততা, বিশ্বস্ততা, নৈতিকতা এবং আমানতদারীর যে প্রসঙ্গ রয়েছে ইসলাম বিদ্বেষী বিশেষ করে, ইহুদী চক্রের নানা চক্রান্তের ফলে এই প্রসঙ্গগুলো এখন নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে।

মানুষে মানুষে সম্পর্ক যখন নানাভাবে বিশ্লেষিত হতে শুরু করেছে তখন থেকে শোষণ প্রক্রিয়া চলে আসছে। মানুষকে প্রভু, দাস, শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ, ব্রাহ্মণ, শূদ্র ও বর্ণবাদের  নানা বিভাজনে বিভাজিত করার ফলে মূলত সমাজ পুঁজিবাদী শোষক শ্রেণির নিগঢ়ে বন্দী হয়ে পড়েছিল। ধর্ম, গোত্র, জাত-পাতের নামে মানুষে মানুষে শোষণ চলছিল। কার্যত শ্রমিক শ্রেণিকে ‘মানুষ’ মনে না করা অথবা শ্রমিক বলতে ভিন্ন কিছু মনে করার মধ্য দিয়েই চলমান শোষন প্রক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। সে কারণেই বলা হতো, শোষকের যেমনি কোনো জাত নেই তেমনি শোষিতেরও কোনো জাত নেই। এক সময় পৃথিবীকে শোষক ও শোষিত এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, পৃথিবী এখন নির্যাতক ও নির্যাতিত এই দুই শাখায় বিভক্ত। একদিকে ব্রাহ্মণ্যবাদ, বর্ণবাদ আর অন্যদিকে সাম্যবাদী মানুষের ঐক্যতান।

গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন প্রক্রিয়া আর ঐতিহাসিক মে দিবসের প্রাথমিক পর্বের ঘটনায় সামাঞ্জস্য রয়েছে। আজ বাংলাদেশে  মানুষের স্বীকৃতি পাওয়ার লড়াই গুরুতর হয়ে উঠেছে। মানুষের স্বীকৃতি অধিকারের স্বীকৃতি, মত প্রকাশের অধিকার না থাকলে শ্রমের স্বীকৃতিরও কোনো প্রশ্ন ওঠে না।

মানুষের মুক্তি কোনো স্লোগান নয়। এর বাস্তবতা হচ্ছে, মানুষকেই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে মনে করা। দলমত নির্বিশেষে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা গেলে অর্থাৎ মানুষকে অন্তত মানুষ হিসেবে গ্রহণ করার মানসিকতা অর্জন করা গেলেই গড়ে উঠতে পারে চমৎকার কর্মোপযোগী বাস্তবতা এবং  একটি বাসযোগ্য পৃথিবী ও বাংলাদেশ। আজকের দিনে সেটিই হোক সকলের আন্তরিক শপথ।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

(আপন দেশ -এর সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের আপন কথার মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার আপন দেশ ডটকম  নেবে না।)

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়