Apan Desh | আপন দেশ

লেবাননের দুরবস্থা ও আমাদের অবস্থা

মুজতাহিদ ফারুকী

প্রকাশিত: ১৯:৪৫, ২৮ আগস্ট ২০২২

লেবাননের দুরবস্থা ও আমাদের অবস্থা

ছবি: আপন দেশ ডটকম

লেবানন মুসলিমপ্রধান একটি ক্ষুদ্র আরব দেশ। প্রফেটখ্যাত কবি খলিল জিবরানের  লেবানন, ইরানপন্থী শক্তিশালী মুসলিম সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর লেবানন। হিজবুল্লাহ  গোষ্ঠীটি যুদ্ধে সব আরব দেশকে হারিয়ে দেয়া ইসরাইলকে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল থেকে উৎখাত করেছিল।

তারা প্রমাণ করেছে, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করলে প্রবল শক্তিমানকেও হারানো সম্ভব। প্রমাণ করেছে, মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী বলে বিবেচিত ইসরাইলী সেনাবাহিনী অপরাজেয় নয়। যতই সে আমেরিকাসহ গোটা পাশ্চাত্যের মদদ লাভ করুক না কেন। যেমনটা প্রমাণ করেছে আফগানিস্তানের তালেবান আমেরিকাকে ২০ বছরব্যাপী যুদ্ধে নাস্তানাবুদ করে।

লেবাননের রাজধানী বৈরুত। মধ্যপ্রাচ্যের সুন্দরতম এবং এতদঞ্চলের তৃতীয় বৃহত্তম এই শহরটিকে একসময় কারা যেন প্রাচ্যের প্যারিস আখ্যা দিয়েছিল। কিন্তু আজকের লেবাননের অবস্থা কি আমরা জানি? সম্ভবত খুব কম বাংলাদেশিই সেটা জানেন। কারণ বাংলাদেশে লেবাননের প্রসঙ্গ আদৌ আলোচনায় আসেনি। যেমনটা এসেছে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দুর্দশা ও গণঅভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ।

সম্ভবত ভৌগোলিক দূরত্ব এবং লেবাননের ক্ষুদ্রাকৃতি এর একটা কারণ। জনসংখ্যা এক কোটিরও বেশ কম; আয়তন মাত্রই ১০,৪৫২ বর্গকিলোমিটার। কিন্তু মিসর, ইসরাইল, ফিলিস্তিনের মতই লেবাননও বিশে^র প্রাচীনতম মানব সভ্যতার জন্মভূমি। অবস্থানগত কারণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী দেশটি। সিরিয়া, ইসরাইলের সঙ্গে সীমান্ত আছে। অদূরে তুরস্ক, জর্দান, সৌদি আরব।  

ক্ষমতাসীনদের ভ্রান্ত নীতির কারণে অর্থনৈতিক ধসের শিকার শ্রীলঙ্কা শেষ পর্যন্ত নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে। এখনও বাংলাদেশের সব পত্র-পত্রিকা প্রতিদিন শ্রীলঙ্কার খবর নিয়মিতই সরবরাহ করছে। কিন্তু লেবাননের অবস্থা আরও বেশি সঙ্গীন। বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে সংক্ষেপে গত কয়েকদিনে দেশটির পরিস্থিতি নিয়ে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় যেসব খবর এসেছে তারই কয়েকটির শিরোনাম উল্লেখ করি।

দুদিন আগে রয়টার্স এক খবরের শিরোনাম করেছে, “ টলতে টলতে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রে’র পথে চলমান লেবাননের সরকারি খাত স্থবির।” একই দিনে মিডল ইস্ট নিউজ নামে একটি পত্রিকার শিরোনাম, “তেল নেই, বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই: এই হলো লেবাননের জীবন সায়াহ্নের চিত্র।” এক সপ্তাহ আগে আল জাজিরা এক খবরে লিখেছে, “লেবানন গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কটে আটকে পড়েছে। জাতিসংঘের হিসাবে দেশটির প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষের অবস্থান এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে।”

ওই এক সপ্তাহ আগেই (১১ আগস্ট ২০২২) ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকা এবং পরদিন বিবিসি খবর দেয়, লেবাননে নিজের টাকা ফিরে পেতে ব্যাংক জিম্মিকারী এখন বীরের মর্যাদা পাচ্ছেন। ঘটনাটি সামান্য ব্যাখ্যা না করলে পাঠকের পক্ষে বুঝে ওঠা মুশকিল হবে।

ওইদিন রাইফেল হাতে এক ব্যক্তি লেবাননের রাজধানী বৈরুতের কেন্দ্রস্থলে ফেডারেল এ ব্যাংকে ঢুকে পড়েন। তিনি ব্যাংকের সব কর্মীকে জিম্মি করেন। কিন্তু তিনি টাকা লুট করতে যাননি। কী ছিল তার দাবি? তিনি বলছিলেন, তোমাদের ব্যাংকে আমি যে টাকা জমা রেখেছি তার কিছু অংশ আমাকে তুলে নিতে দাও। না হলে গায়ে আগুন ধরিয়ে মরে যাবো। দরিদ্র লোকটি তার বৃদ্ধ ও অসুস্থ বাবার চিকিৎসার জন্য নিজেরই টাকা থেকে কিছু অংশ চাইছিলেন।

দীর্ঘ সাত ঘণ্টা চলে এই জিম্মি নাটক। এরপর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাকে মাত্র ৩৫ হাজার ডলার তুলে নেবার সুযোগ দেয়। যদিও তার জমার পরিমাণ দুই লাখ ডলারের ওপরে। ডেলিভারি ভ্যান চালিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সারাজীবন ধরে তিলে তিলে ওই অর্থ ব্যাংকে জমা করেন ৪২ বছরের শেখ বাসাম হোসেন। ব্যাংক অবরোধের পর লেবাননের মানুষের কাছে তিনি জাতীয় বীরের মর্যাদা পাচ্ছেন। কেন? বঞ্চিত দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ ভাবছে, আমাদের অন্তত এক ভাই তো নিজের অধিকার আদায় করতে পেরেছেন!

লেবাননে গত দুবছর ধরে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের টাকা দিতে পারছে না। কারণ ডলার নেই। প্রথম দিকে কিছু কিছু দিলেও এখন পুরোই বন্ধ। আমদানি করা যাচ্ছে না জ¦ালানি, বন্ধ হয়ে গেছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বন্ধ হয়ে গেছে ঘরে ঘরে পানি সরবরাহ। ডিজেল নেই জেনারেটর চালানোর মত। শিল্প তো গেছেই। অর্থনীতি ধ্বংসের চূড়ান্তে। চলছে মহামন্দা।

এসবের কারণ কী। প্রধান কারণ অবশ্যই রাজনীতি। যাকে কেন্দ্র করে দেশটি ১৯৭৫ সাল থেকে ’৯০ সাল পর্যন্ত গৃহযুদ্ধের ভেতর দিয়ে গেছে। কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়। আর যেসব কারণ আছে সেগুলোই উল্লেখযোগ্য। বলা হচ্ছে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিস্থিতি আগে থেকে সামাল দেবার চেষ্টা করেনি। যখন সচেষ্ট হলে সামলে ওঠা যেতো তখন নেতারা ছিলেন নিষ্ক্রিয় এবং অবনতিশীল অবস্থাটা বার বার অস্বীকার করেছেন।

২০১৯-২০ সালেও অর্থনীতিক ও অন্যান্য বিশ্লেষকরা সরকারকে সতর্ক করেছেন মন্দার আভাস সম্পর্কে। কিন্তু না সরকার, না ব্যাংক ব্যবস্থা সেই সতর্কবাণীতে কান দিয়েছে। বরং তারা বারবার বলেছেন, কোনও সমস্যা নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের যথেষ্ট রিজার্ভ আছে, আমরা অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে সবকিছু করছি। তারা মন্দার সতর্কতাকে বিরোধীদের অপপ্রচার, ষড়যন্ত্র, গুজব, কুৎসা রটনা ইত্যাদি বলে সব সমালোচনা অস্বীকার করে এসেছেন। আর জনগণের অর্থের নয়ছয় করেছেন, তসরুফ, আত্মসাৎ, পাচার করেছেন।

২০২২ সালে এসে বিশ^ব্যাংক লেবানন বিষয়ে এক রিপোর্টের শিরোনাম করে, “ঞযব এৎবধঃ উবহরধষ.” মহামন্দা না, বলা হচ্ছে, ‘মহা অস্বীকৃতি’। ঠিক যেমনটা আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব করে চলেছেন। কেউ বলছেন, মাত্র এক মাস পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা আবার অপ্রতিরোধ্য গতিতে উন্নয়নের ট্রেন ছুটাবো। কেউ বলছেন, আমরা তো অনেকের চেয়ে রীতিমত বেহেশতে আছি। কেউ বা বিরোধীদের পিটিয়ে ঘরে তুলে দেয়ার হুমকি দিচ্ছেন।

লেবাননের এই পরিণতিকে নিছক অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ফল বললে কিছুটা সরলীকরণ হবে। সেখানে আন্তর্জাতিক নানা টানোপোড়েন আছে। ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র, ইরান তিন বড় খেলোয়াড়। ইসরাইলের সঙ্গে সমুদ্রবিরোধ মেটাতে অন্যায্য চুক্তি করার জন্য চাপ দিচ্ছে আমেরিকা। সেটা না করা পর্যন্ত তাকে ইরাক জর্দান থেকে জ¦ালানি আনার সুযোগ দেবে না। ইরান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে দেশটির রাজনীতি। তারা আমেরিকার কথায় ইসরাইলের সঙ্গে চুক্তি করবে এমনটা সম্ভবত হচ্ছে না।
একই পরিস্থিতি কিন্তু আমাদেরও। চীনের দিকে যাবেন, আমেরিকার দিকে, নাকি ভারতের দিকে? সমস্যা ত্রিমুখি। সামলাতে হিমশিম। সরকার টিকিয়ে রাখতে বৈদেশিক সাহায্য চাওয়ার মত রাজনৈতিক দেউলিয়াপনাও প্রকাশ্যে এসে যাচ্ছে। কিন্তু সেসব পরের কথা। মানুষ বাঁচাতে কী করছেন সেটাই আমরা দেখতে চাই। আইএমএফ ঋণ দেবে কিনা সেটাও কিন্তু অন্য কারও ইচ্ছা অনিচ্ছার বিষয় হতে পারে।

যেমন জালানি তেলের দাম বাড়নো হলো অন্যের ইচ্ছায় ভর্তুকি তুলে দেওয়ার নামে। সুতরাং শিক্ষা নেবার জায়গা শুধু শ্রীলঙ্কা না। লেবাননসহ অনেক জায়গা আছে যাদের পরিণতি দেখে শিক্ষা নেবার সুযোগ আছে। তবে শঙ্কা হয় একারণে যে, আমাদের বর্তমান ক্ষমতাসীনরা কারো চেয়ে কম বোঝেন না। বেশি বোঝা অবশ্য খারাপ না। যদি সে বুঝ হয় ঠান্ডা মাথায়। সামনে তারা কতটা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সামলাতে পারবেন সেটাই দেখার অপেক্ষা। 

 

লেখক: সাংবাদিক, কবি ও কথাসাহিত্যিক

ই-মেইল : [email protected]

 

( আপন দেশ ডটকমের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের আপন কথার  মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার আপন দেশ ডটকম নিবে না।)

 

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

জনপ্রিয়