Apan Desh | আপন দেশ

আতঙ্কে কমছে ইসলামী ব্যাংকের আমানত

ইসলামী ব্যাংকে আতঙ্ক: শুধু নভেম্বরেই প্রায় ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা আমানত প্রত্যাহার

আফজাল বারী

প্রকাশিত: ১৪:০০, ৪ ডিসেম্বর ২০২২

আপডেট: ১৬:২৯, ৬ ডিসেম্বর ২০২২

ইসলামী ব্যাংকে আতঙ্ক: শুধু নভেম্বরেই প্রায় ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা আমানত প্রত্যাহার

ফাইল ছবি

বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডে (আইবিবিএল) ঋণ বিতরণের কোনো নীয়মনীতি মানা হচ্ছে না অভিযোগ উঠেছে। হাজার হাজার কোটি টাকা নেয়া হচ্ছে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। বিতরণকৃত ঋণের বিপরীতে রাখা হচ্ছে না পর্যাপ্ত জামানত।

এমন তথ্য আমানতকারীদের কানে কাকে। ফলে আতঙ্ক বাড়ছে ব্যাংকটির আমানতকারীদের মধ্যে। এদের কেউ কেউ ব্যাংকটি থেকে তাদের আমানত তুলে নিচ্ছেন। ব্যাংকটি থেকে বানের পানির মতোচলে যাচ্ছে আমানতের টাকা। খোঁজ মিলেছে, শুধু গত নভেম্বর মাসে ব্যাংকটিতে আমানত কমেছে প্রায় ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংকে মনিটরিং বাড়ানোয় বেপরোয়া ঋণে কিছুটা লাগাম পড়বে বলে আশা করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। আর এখনো ব্যাংকটিতে দেড় লাখ কোটি টাকা আমানত থাকায় আতঙ্কের কিছু নেই বলে দাবি তাদের।

দায়িত্বশীলদের মতে, আর যাতে কোনো বেনামী ঋণ বিতরণ না হয় সেটি নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিতরণকৃত ঋণের অর্থ উদ্ধারে মনোযোগ দিলে ব্যাংকটি তার আগের শক্তিশালী অবস্থান ফিরে পাবে।

আরও পড়ুন<<>> তিন ব্যাংকের ঋণ দেয়ায় সম্পৃক্তদের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট

এদিকে ইতোমধ্যে এই ব্যাংক থেকে ১১ প্রতিষ্ঠানকে আগ্রাসীভাবে ঋণ দেয়ার অভিযোগে তদন্ত শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে, পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এসব কোম্পানিকে ৯ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা ঋণ ছাড় বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে।  

তথ্য অনুযায়ী, সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড থেকে কিছু প্রতিষ্ঠান বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহীকেন্দ্রিক ব্যবসা পরিচালনাকারী নাবিল গ্রুপের নতুন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নামে পর্যাপ্ত জামানত ছাড়াই প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি। এ ক্ষেত্রে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালাও লঙ্ঘন করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদ আপন দেশ ডটকম’কে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। ইতিমধ্যে ইসলামী ব্যাংকের উপর তিন সদস্যের একটি টিম পরিদর্শন কাজ করছে। তারা দুদিন ইসলামী ব্যাংকে গেছেন। তারা আরও চারদিন সেখানে যাবেন। এসব বিষয়ে পরবর্তীতে বিস্তারিত জানানো হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জামানত ছাড়া অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দেয়ায় এখন ঝুঁকিতে পড়েছে ব্যাংকটির আমানত। আতঙ্কিত হয়ে আমানতকারীরা টাকা তুলে নিতে শুরু করেছেন।

চলতি অর্থবছরের ৩০ নভেম্বর এসে ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা। গত ৩১ অক্টোবর শেষেও ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ ছিলো ১ লাখ ৫৩ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসের ব্যাবধানে ব্যাংকটির আমানত কমেছে ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইও মুহাম্মদ মুনিরুল মওলাকে মোবাইলে কল দিলে তিনি রিসিভ করেননি। অন্যান্য মাধ্যমে বার্তা পাঠিয়েও মতামত নেওয়া সম্ভব হয়নি। 

ব্যাংকটির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত ১৬ অক্টোবর- ১৭ নভেম্বর নাবিল গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৩ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। এছাড়া গত ছয় মাসে ৮টি প্রতিষ্ঠানকে মোট ৬ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে শিমুল এন্টারপ্রাইজ, গ্রেইন ক্রপস, নাবা ফার্ম ও নাবা এগ্রো ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে ৪ হাজার ৪৩৫ কোটির ঋণ দেয়া হয়। একই সময় রাজশাহীভিত্তিক মার্টস বিজনেস লিমিটেডকে ৯০০ কোটি, আনোয়ারা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে ১ হাজার কোটি টাকা এবং ইন্টারন্যাশনাল প্রডাক্ট প্যালেস নামের প্রতিষ্ঠানকে ৫০০ কোটি ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি। ঋণ বিতরণ করা প্রতিষ্ঠানের কয়েকটি, কাগুজে, ওয়েবে এবং অস্তিত্বহীন বলে জানা গেছে।

নাবিল গ্রুপ কারা

নাবিল গ্রুপের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, তাদের ১৭টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নাবিল নব ফুড, ফ্লাওয়ার মিল, ফিডমিল, অটোরাইস মিল, ডাল মিল, কনজ্যুমার প্রডাক্ট, নাবিল ফার্ম, ক্যাটল ফার্ম নাবিল ট্রান্সপোর্ট। তবে, ওয়েবসাইটে প্রোডাক্ট অপশনে মাত্র ছয়টি পণ্যের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো- চাল, আটা, ময়দা, সুজি, দুধ, ডাল পশুখাদ্য।

কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন মো. জাহান বক্স মন্ডল। ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আমিনুল ইসলাম। পরিচালক ইসরাত জাহান এবং উপ-পরিচালক মো. মামুনুর রশীদ।

কাগুজে ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানে ঋণের বিষয়ে জানা যায়, ইন্টারন্যাশনাল প্রডাক্ট প্যালেসের ঋণগ্রহীতার বর্তমান ঠিকানায় বড়গাছী, পবা, রাজশাহী ব্যবহার করা হয়েছে। তবে গরমিল রয়েছে পোস্ট কোডে। আনোয়ারা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে ইসলামী ব্যাংক থেকে ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। আনোয়ারা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে যিনি ঋণ গ্রহণ করেছেন, তার নাম হচ্ছে মোখলেসুর রহমান। ঠিকানায় দেয়া হয়েছে রাজশাহী জেলার দুর্গাপুর উপজেলার পারিলা গ্রাম। অথচ দুর্গাপুর উপজেলায় পারিলা নামে কোনো গ্রামই নেই। পারিলা মূলত রাজশাহীর পাবা উপজেলার একটি ইউনিয়ন। ওই ব্যক্তির পোস্ট অফিস দেখানো হয়েছে দাওকান্দি আর পোস্ট কোড ৬২৪০। যে পোস্ট কোডটি রাজশাহীর দুর্গাপুরের পোস্ট কোড। এছাড়া অস্তিত্বহীন আরেক প্রতিষ্ঠান মার্টস বিজনেস লিমিটেডকে ৯০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক।

চলতি বছর ১ থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে আট ধাপে প্রতিষ্ঠানটিকে এ ঋণ দেয়া হয়েছে। এদিকে চলতি বছর ৬ জুলাই থেকে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের রাজধানীর গুলশান-২ শাখা নাবিল গ্রেইন ক্রপস নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ছয় ধাপে ৯৬৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ দেয়। ব্যাংকের বিভিন্ন চার্জসহ বর্তমানে এ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১১ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এসব ঋণের অধিকাংশই বিতরণ করা হয়েছে গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে।

এদিকে ইসলামী ব্যাংকের গুলশান-২ শাখা গত ২৫ এপ্রিল থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত তিন মাসে নাবা এগ্রো ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ১ হাজার ১৪৮ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়। অস্তিত্বহীন এই প্রতিষ্ঠানটিকে আট ভাগে এসব ঋণ বিতরণ করা হয়। ইসলামী ব্যাংকের দাবী অনুযায়ী, নাবা এগ্রো ট্রেড নাবিল গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। তবে গ্রুপটির ওয়েবসাইটে নাবা এগ্রো ট্রেডের নাম নেই। এভাবে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে জামানত ছাড়াই ধারাবাহিকভাবে ঋণ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। এতে শঙ্কার মধ্যে পড়েছে ব্যাংকটির আমানত। আতঙ্কিত হয়ে আমানতের টাকা প্রত্যাহার করা হচ্ছে।

ঋণ প্রশ্নে অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এ ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছে। এখন যেটা করা উচিত, এসব ঋণ শক্তভাবে মনিটরিং করা। ঋণের টাকা যেখানে বিনিয়োগ হবে সেখান থেকে অর্থ ফেরত আসবে কি না, তা যাচাই-বাছাই করা। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত হবে বিষয়গুলো তদারকি করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া। এভাবে ঋণ চলে গেলে অর্থ আর ফেরত আসে না। অতীতের রেকর্ড এটি বলে।
এই বিশেষজ্ঞের মতে, এতা বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণের বেলায় ব্যাংকের উচ্চতর কর্তৃপক্ষ অবশ্যই অবগত থাকেন, কোনো কোনো সময় এ অপকর্মের নিজেদের সম্পৃক্তও করে ফেলেন বলে মন্তব্য করেন মির্জা আজিজুল ইসলাম। 

আপন দেশ ডটকম/ এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়