Apan Desh | আপন দেশ

মাউশিতে লিয়াকত শিকদার-তরুণ দে’র লুটপাট, শিক্ষামন্ত্রণালয়ে নথি তলব

বিশেষ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৫:১৪, ২৭ মার্চ ২০২৩

আপডেট: ১৫:৪২, ২৭ মার্চ ২০২৩

মাউশিতে লিয়াকত শিকদার-তরুণ দে’র লুটপাট, শিক্ষামন্ত্রণালয়ে নথি তলব

ফাইল ছবি

সরকারি কলেজের কেনাকাটায় যৌথভাবে চলছে হরিলুট। তাতে শরিক হয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলা, ক্ষমতাসীন ও রাজপথের বিরোধী দলীয় নেতা। ঘটনার কেন্দ্রস্থল মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফত (মাউশি)।

শিক্ষামন্ত্রণালয় তো দূরেই থাক, প্রধানমন্ত্রীর মৌখিক ও লিখিত কোনো নির্দেশই মানা হচ্ছে না এখানে। উল্টো নিষেধাজ্ঞামূলক কর্মকাণ্ডই অগ্রাধিকার পাচ্ছে। টেন্ডার অনুযায়ি ঠিকাদার নয়, ঠিকাদারের কাজ পেতে প্রস্তুত করা হয় কাজের টেন্ডার।  

শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে জেলা সদরের (৭০) পোস্ট-গ্রাজুয়েট কলেজ সমূহের উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় প্রায় অর্ধশত সরকারি কলেজের জন্য প্রায় ৩৬ কোটি টাকার আসবাবপত্র কেনাকাটা করা হচ্ছে। কেনাকাটায় করা হয় মোট ১৭টি লট। এর ৮টি লট দেয়া হয়েছে যুবদলের সহ-যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তরুন দের প্রতিষ্ঠান ‘মমতা এন্টারপ্রাইজ’কে, শর্ত শিথিল করে ২ লটের কাজ দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের শ্রম ও জনশক্তি বিষয়ক উপকমিটির সদস্য, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদারের ‘কম্পিউটার ওয়ার্ল্ড বিডি’ নামক প্রতিষ্ঠানকে। এছাড়াও আখতার ফার্নিচার, অটবি, রয়েল ফার্নিচারসহ কয়েক প্রতিষ্ঠানকে বাকি ৭ লটের কাজ দেয়া হয়েছে।

এরমধ্যে তরুন দের প্রতিষ্ঠান মমতা এন্টারপ্রাইজ অতীতে নিন্মমানের কাজ করার দায়ে জামনত আটকে রাখা হয়েছিল, এরপরও তার প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে কয়েকটি কাজ চলমান, আখতার ফার্নিচার অনিয়মের দায়ে সাজা স্বরূপ জরিমানা গুনেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দফায় দফায় নির্দেশনা দিয়েছেন চাহিদা মোতাবেক কাজ সম্পাদনের স্বার্থে একই প্রতিষ্ঠান যেন একাধিক কাজ না দেয়া হয়। ট্রেন্ডার রুলেই আছে অনিয়মের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হলে পরবর্তীতে যে প্রতিষ্ঠান টেন্ডারে অংশগ্রহণে অযোগ্য হবে। কিন্তু এসবই ‘কাগুজে বিধা ‘ রূপ পেয়েছে।   

এদিকে কেনাকাটার কাজ প্রদানের প্রক্রিয়া নিয়েও স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। মোট তিন ধাপে ট্রেন্ডার আহ্বান করা হয়েছিল। এরমধ্যে প্রথম ধাপে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে বাদ দেয়া এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে দরপত্রের শর্ত পরিবর্তন করে সর্বনিম্ন দরতাদাকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ দরতাদাকে কাজ দেয়া হয়েছে। এতে সরকারের প্রায় তিন কোটি ৩০ লাখ টাকার মতো বাড়তি গুনতে হচ্ছে।

অনিয়মের কারণে এই প্রকল্পভুক্ত ভোলা সরকারি কলেজ, ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ ও রাজশাহী সরকারি কলেজে অবকাঠামো নির্মাণ কাজ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। প্রকল্পের এই অনিয়ম ও কাজ ভাগাভাগির বিষয়ে দুদক, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশিতে লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, অতীত আমলনামা যা-ই হোক এবার বেঁকে বসেছেন শিক্ষামন্ত্রণালয়। স্বল্প সময়ে তদন্ত কমিটি, তলব আর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা লিয়াকত শিকদার ও যুবদল নেতা তরুণ দের মালিকানাধিন দুই প্রতিষ্ঠানসহ অনিয়ম ধরতে গঠন করা হয়েছে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। ‘অনিয়মসমূহ যথাযথভাবে চিহ্নিত’ এবং এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়-দায়িত্ব নিরুপণ করে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। গত ২৬ মার্চ তলবপত্র জারি করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব ফরহাদ হোসেন স্বাক্ষরিত নোটিশে উল্লেখ, আগামী ২৯ মার্চ সকালে অভিযোগকারী ঠিকাদার, প্রকল্প কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে নথিপত্রসহ উপস্থিত থাকতে হবে।  

এদিকে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মাউশি থেকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হলেও প্রকল্প কর্মকর্তারা সে নোটিশের পাত্তাই দেয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কেনাকাটা প্রক্রিয়া বন্ধ রাখতে বলা হয়েছিল। প্রকল্প কর্মকর্তারা এরও তোয়াক্কা করেনি। উল্টো তড়িগড়ি করে ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি করে এবং কার্যাদেশ চূড়ান্ত করেছে।

মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বিষয়টি নিয়ে বলেন, অভিযোগ এসেছে। প্রকল্প পরিচালকের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছিল। তারা কোনো জবাবই দেয়নি। তিনি বলেন, শুনেছি বিএনপির এক নেতাকেই নাকি আটটি লটের কাজ দেয়া হচ্ছে। এটি খুবই বিস্ময়কর। আমি কারো অপকর্মের দায় নেব না।

মাউশির কারণ দর্শানো নোটিশের জবাব না দেয়ায় প্রকল্পটির অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত ১৯ মার্চ গঠিত এ কমিটির আহ্বায়ক হলেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের যুগ্মসচিব মাহমুদুল আলম এবং সদস্য হলেন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ইইডি) নির্বাহী পরিচালক এসএম সাফিন হাসান। এ কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের উপসচিব ড. ফরহাদ হোসেন।

তদন্তের সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন কর্মকর্তা আপন দেশ‘কে বলেন, তদন্ত কমিটি নথিপত্র পর্যালোচনা শুরু করেছে। তাদের তলব করা হয়েছে। তদন্ত প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে মহল বিশেষ ভূমিকা রাখছেন বলেও ওই কর্মকর্তা জানান।

প্রকল্প’র পরিচালক (পিডি) অধ্যাপক মুহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, কেনাকাটায় কোন অনিয়ম হয়নি। নিয়ম মেনেই ক্রয় কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী কাজ দেয়া হচ্ছে। এরপরও কোন ‘ভুল-ত্রুটি’ হয়ে থাকলে তার দায়-দায়িত্ব ওই কমিটিকেই নিতে হবে।

জানা গেছে, তিন সদস্য বিশিষ্ট ক্রয়-কমিটির আহ্বায়কসহ দু’জন পিডির অনুগত এবং একই প্রকল্পের কর্মকর্তা। তাদের একজনের সঙ্গে ঠিকাদার যুবদল নেতা তরুন দের যোগসাজশ রয়েছে। কমিটির অন্যজন শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের একজন সিস্টেম এনালিস্ট।

বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতার মধ্যে কাজ বন্টনের কারণ প্রসঙ্গে ক্রয় কমিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, এ কাজের বিলের জামানত (১০ শতাংশ) এক বছর আটকে থাকবে। আগামীতে যদি আওয়ামী লীগ সরকারের আসতে না পারে সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নেতা বা ঠিকাদারের জামানত অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এক্ষেত্রে বিএনপি নেতা সহযোগীতার প্রয়োজন হবে।

প্রকল্প কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথম আটটি লটের টেন্ডারে অন্যতম শর্ত ছিল দরতাদা প্রতিষ্ঠানের আসবাবপত্র প্রস্তুতকারী হিসেবে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।

দ্বিতীয় ধাপেও একই শর্ত রেখে পাঁচটি লটের দরপত্র আহ্বান করা হয়। যুবদল নেতা তরুন দের  প্রতিষ্ঠান মমতা এন্টাপ্রাইজকে দুটি ধাপের অন্তত আটটি লটের কাজ দেয়ার পরিকল্পনা ‘সাজায়’ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কিন্তু অভিজ্ঞতা সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতার কারণে এ ধাপেও লিয়াকত শিকদারের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার সুযোগ হয়নি।

আরও পড়ুন<> মাউশিতে প্রকৌশলী-ঠিকাদার সিন্ডিকেট: অবকাঠামোর খবর নেই, চলছে অর্থ ছাড়

পরবর্তীতে তৃতীয় ধাপে আসবাবপত্র প্রস্তুতকারী হিসেবে দারদাতা প্রতিষ্ঠানের শর্ত শিথিল করে আট বছর করা হয়। এতে লিয়াকত শিকদারের প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার ওয়ার্ল্ড বিডি’কে দুটি লটের কাজ দেয়ার সুযোগ হয়। এতে টাকার অংকও বৃদ্ধি পায়। এর চেয়ে বেশি কাজ করার ‘সক্ষমতা’ ওই প্রতিষ্ঠানটির নেই বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, ‘সুশিতা’ ও ‘রয়েল’ নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রকল্পের পুরো ক্রয়-প্রক্রিয়া নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ করা হয়েছে। একই অভিযোগপত্র মাউশি, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে দেয়া হয়েছে।

এরমধ্যে সুশিতা এন্টারপ্রাইজের প্রোপাইটার শফিউল আলমের অভিযোগ হলো তার প্রতিষ্ঠান অন্তত চারটি লটের কাজে সর্বনিম্ন দরদাতা ছিল। এসব লটের কাজ অন্যদের দেয়া হয়েছে।

প্রকল্প অফিস থেকে জানা গেছে, ১৭টি লটে আসবাবপত্র কেনার খাতে মোট ৩৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকার মতো বরাদ্দ রয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে এ টাকা খরচ দেখাতে হবে।

টেন্ডারে অংশ নেয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ দেয়া হলে মোট ব্যয় হতো ২৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকার মতো। কিন্তু পছন্দের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ দিতে গিয়ে এখন সরকারের গুনতে হবে ৩৩ কোটি টাকার বেশি।

আপন দেশ/এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ