Apan Desh | আপন দেশ

দুদকের মামলায় গড়িমসির নেপথ্যে কী?

বিশেষ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৯:১১, ১৩ মার্চ ২০২৩

আপডেট: ১৯:২৩, ১৬ মার্চ ২০২৩

দুদকের মামলায় গড়িমসির নেপথ্যে কী?

ফাইল ছবি

তিনি এলেন, চাকরি করলেন, বিদায়ও নিলেন। মাঝখানে তিন বছরের বেশি সময়ে রেখে গেলেন দুর্নীতির গভীর-অগভীর ক্ষত। এ ক্ষতে পচন ধরবে যে কোনো সময়। প্রসঙ্গটি বাংলাদেশ ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট  অথরিটি (বিআইডব্লিউটিএ) ও সদ্য বিদায় নেয়া চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেকের। তিনি বাংলাদেশ নৌবাহিনী থেকে প্রেষণে এসেছিলেন নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিষ্ঠান বিআইডব্লিউটিএ তে।

২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি তিনি প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে প্রেষণে নিযুক্ত হন। এ পদে তিনি চাকরি করেন ২ বছরেরও বেশি সময়। গত ৫ মার্চ তিনি ফেরত গেছেন নিজ দফতর বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে। তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন ইমেজধারী কর্মকর্তা কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা। তবে সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেকের দুর্নীতির যে নজির স্থাপন করে গেছেন তা শুধু বিআইডব্লিটিএ’র ভাবমূর্তিকেই ভূলুণ্ঠিত করেনি। ডুবিয়েছেন একটি সুশৃঙ্খল চৌকষ সশস্ত্রবাহিনীকেও। যা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীনই শুধু নয়-নিঃসন্দেহে গ্লানিকরও। 

বিআইডব্লিটিএ’র বিগত চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক নিজ বাহিনীতে ফিরে গেছেন বটে। কিন্তু ফেলে রেখে গেছেন বিতর্কিত এবং কলঙ্কসময় অতীত। নিয়োগ দুর্নীতি, বিভিন্ন প্রকল্পের কার্যাদেশ প্রদান, সনদ ইস্যু, অভ্যন্তরীণ বিভেদকে উসকে দেয়াসহ কি অভিযোগ নেই তার বিরুদ্ধে? তার দুর্নীতি এতোটাই লাগামহীন হয়ে পড়েছিলো যে, চেয়ার আসীন থাকা অবস্থায়ই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও উচ্চমহলের হস্তক্ষেপ প্রভাবে এখনও মামলাটি রুজু হয়নি। তবে মামলা একবার কমিশনের অনুমোদন লাভ করলে সেটি কোনো না কোনো সময় রুজু হওয়ার নজির রয়েছে দুদকে ভুরি ভুরি। বর্তমান সরকারের পূর্ববর্তী মেয়াদের পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে সরকারি পাটকল বিক্রির অভিযোগ অনুসন্ধান হয়েছিলো ২০১৫ সালে। অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিলের পর সেটির

ভিত্তিতে তৎকালিন কমিশন মামলা রুজুর অনুমোদন দেয়। কিন্তু অদৃশ্য কারণে প্রভাবশালী ওই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে তখন আর মামলাটি দায়ের হয়নি। কমিশনের স্যাংশন লাভের আড়াই বছর পর পরবর্তী কমিশন এসে মামলা দায়ের করে। মামলাটি এখন বিচারাধীন। কমিশন অনুমোদন দেয়ার বহু পরে মামলা দায়ের হয়েছে-এমন অনেক নজির রয়েছে সংস্থাটির

ভেতরই। পক্ষান্তরে কমিশন মামলা রুজুর পক্ষে সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন দেয়ার পর একই কমিশন সেটি ‘রিভিউ’ কিংবা পুনর্বিবেচনা করেছে-এমন দৃষ্টান্ত সম্ভবত একটিও নেই। তবে মামলার সিদ্ধান্ত হওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত ব্যক্তিগত শুনানির ব্যবস্থা কমিশন আইনেই রয়েছে। সে ক্ষেত্রে অনেক অনুসন্ধানেরই গতিপথ ঘুরে যেতে পারে। অধিকতর অনুসন্ধান কিংবা পুন:অনুসন্ধানে পাঠিয়ে মামলা রুজুর বিষয়টি উল্টিয়ে নথিভুক্তি বা ‘পরিসমাপ্ত’ করার আইনি বিধানও রয়েছে। কিন্তু মামলা রুজুর পক্ষে কমিশন একবার অনুমোদন দিলে এবং

পরবর্তীতে পুনরায় কমিশন সভা করে ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তাতে আইনগত ঝুঁকি থেকেই যায়। সংক্ষুব্ধ যে কোনো ব্যক্তি একই বিষয়ে একই কমিশনের দুই ভিন্ন সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে আইনি বাধ্যবাধকতায় পড়ে কমিশনের সামনে মামলা রুজু ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকে না।

বিআইডব্লিউটিএ’র সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেকসহ সংশ্লিষ্ট ১৩ জনের বিরুদ্ধে দুদক মামলার অনুমোদন (স্মারক নং- ০০.০১.২৬০০.৬০৩.০১.২৩৩.২১) দেয় গতবছর ২৭ সেপ্টেম্বর। এজাহার অনুমোদনের পর কমিশনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চিঠি দেন ডেস্ক অফিসার উপ-পরিচালক (অনুসন্ধান ও

তদন্ত-১) মো: জাহিদ হোসেন। এর আগে উপ-সহকারি পরিচালক মো: আলিয়াজ হোসেন অভিযোগ অনুসন্ধান শেষে মামলার সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন দাখিল করেন। কিন্তু মামলা রুজুর জন্য উপ-পরিচালক শাহীন আরা মমতাজের টেবিলে যাওয়ার পর রহস্যজনক কারণে থেমে যায় মামলা রুজুর প্রক্রিয়া। অনুমোদনের পর ৬ মাস অতিবাহিত হলেও দায়ের হয়নি সেই মামলা। এমন নজির কমিশনের ইতিহাসে বিরল। 

দুদক সূত্র জানায় কমোডর গোলাম সাদেকসহ সংশ্লিষ্ট ১৩ জনের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯ ধারাসহ ১৯৪৭ সনের ২নং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় মামলা রুজুর সিদ্ধান্ত দেয় কমিশন। অনুসন্ধান প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, বাজার মূল্যেও চেয়ে কম

মূল্যে ঘাট ইজারা দিয়ে গোলাম সাদেকসহ সংশ্লিষ্ট ১৩ ব্যক্তি সরকারের পৌনে ৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। এ কারণে গোলাম সাদেকসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা রুজুর সিদ্ধান্ত হয়। অন্যরা হলেন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের সদস্য (পরিচালক পরিকল্পনা) মো: দেলোয়ার হোসেন (যুগ্ম সচিব), পরিচালক প্রশাসন ও মানবসম্পদ মুহাম্মদ আবু জাফর হাওলাদার, বন্দর ও পরিবহন বিভাগের পরিচালক কাজী ওয়াকিল নওয়াজ, অতিরিক্ত পরিচালক মো: সাইফুল ইসলাম (বর্তমান পরিচালক), যুগ্ম পরিচালক (বন্দর) জুলফা খানম ও উপ-পরিচালক (ইজারা) মো: মোস্তাফিজুর রহমান, তিন ইজারাদার মোহাম্মদ এজাজ আহমেদ সোহাগ, সাকিব আহমেদ ইমন মো: রফিকুল ইসলাম খান।

এছাড়া অনুসন্ধান প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক তিন উপ-পরিচালককেও আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন, শেখ মো: সেলিম রেজা, মো: কবির হোসেন, মোহা. মাসুদ পারভেজ।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহনের কর্তৃপক্ষ (বিডাইডব্লিওটিএ) আওতাধীন আরিচা নদী বন্দরের নিয়ন্ত্রণাধীন নব্যসৃষ্ট ‘নগরবাড়ী-কাজিরহাট নরদেহ নদী বন্দরের’ আওতাধীন নগরবাড়ী/কাজিরহাট/নগাদহ বন্দর এলাকায় (এল.এস.সি) শুল্ক আদায় কেন্দ্র ঘাট পয়েন্ট ইজারা প্রদানে অনিয়ম করেছেন।

অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পরস্পর যোগসাজশে অসৎ উদ্দেশে ব্যক্তিস্বার্থে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য ক্ষমতা অপব্যবহার করে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাজার মূল্যের চেয়ে ৩ কোটি ৬৩ লাখ ৩৪ হাজার ৬৩৪ টাকা কমে ও ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাজার মূল্যের

চেয়ে ৩ কোটি ১৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯০২ টাকা কমে ইজারা দিয়ে সরকারের ৬ কোটি ৮০ লাখ ৯৩ হাজার ৫৩৬ টাকা আর্থিক ক্ষতি সাধনের অভিযোগ করা হয়েছে।

কমিশনের অনুমোদিত এজাহারে উল্লেখ করা হয়, অভিযুক্ত বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান গোলাম সাদেক প্রতিষ্ঠানটির প্রধান হিসেবে নিয়োজিত থেকে আমদানি-রপ্তানি/খালাসকৃত মালামালের পরিমাণ সংক্রান্ত তথ্য/ রেকর্ড পর্যালোচনা না করে ঘাটটির চলমান বাৎসরিক

ইজারা মূল্য ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা হলেও প্রাক্কলতি মূল্য নির্ধারণে গঠিত ৫ সদস্যের কমিটির মূল্যায়ন প্রতিবেদন ব্যতিরেকেই ২০২১-২০২২ অর্থবছরের ২ কোটি টাক ধরে ইজারা অনুমোদন করেন।

দুদকের অনুসন্ধানে বলা হয়, পূর্ণকালীন চুক্তিনামাধারী এ ইজারাধার না হওয়া সত্ত্বেও ঘাট পয়েন্টের জন্য ২০১১-২০১২ অর্থবছরে নবায়নের মাধ্যমে ইজারা প্রদান করা হয়। যেখানে ঘাট ইজারা দেয়ার পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি।

দুদকের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, কমোডর গোলাম সাদেকের দুর্নীতি সূর্যের আলোর মতোই জ্বাজ্জল্যমান। অপরাধের বহু দালিলিক প্রমাণ উঠে আসে অনুসন্ধানে। তাই এটিকে ধামাচা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। হয়তো বিলম্বিত করা যাবে। কিন্তু প্রমাণভিত্তিক দুর্নীতি কখনও পুরনো হয় না। তাই দুদককে আজ না হোক কাল মামলা করতেই হবে। এই

দুর্নীতির মামলাটি আপাত: ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে দুদকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে। এছাড়া দুদকের মধ্যম পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তারও নানাবিধ স্বার্থ রয়েছে এ মামলার পেছনে। তবে দুদকের শীর্ষ কর্মকর্তার স্বাভাবিক বিদায় আসন্ন। চলতি

বছর মাঝামাঝিতে তিনি অবসরে যাবেন। আর তখনই মামলাটি দায়ের করা হবে বলে জানায় সূত্রটি।

সূত্র আরও জানায়, শুধু পৌনে ৭ কোটি টাকা আত্মসাতই। এই মামলাটির গভীর তদন্ত হলে বেরিয়ে আসবে গোলাম সাদেকের পাহাড় সমান দুর্নীতির অন্যান্য প্রমাণও। তার নিয়োগ বাণিজ্য, কার্গো ভ্যাসেল লাইসেন্স ও ফিটনেস ইস্যু, ঘাট ইজারা, নদী খননসহ বিভিন্ন খাতের দুর্নীতির বহু প্রমাণ তিনি রেখে গেছেন। রয়েছে নামে বেনামে তার কোটি কোটি টাকার

বৈধ সম্পদ অর্জন এবং অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বিদেশ পাচারের অভিযোগ। এসব অভিযোগ নিয়ে দুদকের ২টি ডেস্কে পৃথক ২টি অনুসন্ধান এখনও চলমান বলে জানা গেছে।

 এ প্রসঙ্গে দুদকের উপ-পরিচালক শাহীন আরা মমতাজ আপন দেশ’কে বলেন, মামলাটি আমার টেবিলে নেই। বিআইডব্লিওটিএ-এর সাবেক চেয়ারম্যান শামসুদ্দোহা খন্দকারের বিরুদ্ধে মামলার একটি ফাইল ছিলো যা, ইতোমধ্যে চার্জশীট দেয়া হয়েছে। কমোডর গোলাম সাদেক সাহেবের ফাইলটি সম্পর্কে আমার জানা নেই। 

(প্রথম পর্ব) 

আপন দেশ/এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ