Apan Desh | আপন দেশ

ঈদ সংখ্যার সাহিত্য, সাহিত্যের ঈদ সংখ্যা

অলোক আচার্য

প্রকাশিত: ১০:৫০, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৩

ঈদ সংখ্যার সাহিত্য, সাহিত্যের ঈদ সংখ্যা

ফাইল ছবি

বাংলা সাহিত্য বিস্তারে বা শক্তিশালী সাহিত্য ক্রমধারায় ঈদ উপলক্ষে প্রকাশ করা বিশেষ সংখ্যাগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। ঈদ উপলক্ষে করা এই বিশেষ সংখ্যাগুলো বাংলা ভাষার একটি ঐতিহ্য। ঈদ সংখ্যা সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আজ থেকে কয়েক দশক আগেও এত বিপুল আয়োজনে ঈদ সংখ্যা প্রকাশিত হতো না। তবে ঈদ নিয়ে বিশেষ আয়োজন বরাবরই ছিল। রাজধানী ঢাকা থেকে প্রথম সারির গণমাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন জেলার পত্রিকাও ঈদে আলাদা করে বিশেষ সংখ্যা বের করছে। কোনো কোনো গণমাধ্যম একটি পাতাতেই সীমাবদ্ধ থাকছে আবার কোনো কোনো গণমাধ্যম আলাদা একটি সংখ্যা ব্যাপক কলেবরে বের করছে। ঈদ সংখ্যায় অন্তর্ভুক্ত থাকে ছোট গল্প, বড় গল্প, অণুগল্প, উপন্যাস, উপন্যাসিকা, কবিতা, ভ্রমণ, প্রবন্ধসহ আরো কিছু বিষয়। মোট কথা লেখায় বৈচিত্র্যের অভাব থাকে না ঈদ সংখ্যার আয়োজনে। কিন্তু সেই গুরুত্ব এখন কতটা শক্তিশালী এটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এর কতগুলো পাঠকের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। অথাব যদি প্রশ্ন থাকে যে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মেধাবী সাহিত্যিকদের কতজনকে এখানে লেখার সুযোগ পাচ্ছে। 

একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি খ্যাতনামা পত্রিকার ঈদ সংখ্যাতেই সাহিত্য জগতের স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের লেখাই বেশি প্রাধান্য পায়। ঈদ সংখ্যার প্রচারে সেই লেখাগুলোর হাইলাটইস থাকে। তবে সারা বছর যারা লিখছেন তাদের খুব কম সংখ্যক লেখকদেরই এসব আয়োজনে দেখা যায়। যদিও এখন পত্রপত্রিকার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং এর ধরনে বৃদ্ধির কারণে অনেক লেখক সুযোগ পাচ্ছে তবু ঈদ সংখ্যার বাইরে থাকছেন প্রতিবানসম্পন্ন লেখকদের অনেকেই। ঈদ সংখ্যা একটি বিশেষ আয়োজন এবং এখানে সকলকে জায়গা দেওয়া সম্ভব হয় না এটি সত্যি। ঈদ যেহেতু সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ফলে এই উৎসবে বিশেষ সবকিছুর প্রতিই যে পাঠকের আলাদা মনোযোগ থাকবে সেটিই স্বাভাবিক। যেমন-টিভি নাটক বা সিনেমার প্রতি দর্শকদের আগ্রহ থাকে। ঈদ উপলক্ষে মূলত দেশের বড় বড় সাহিত্যিকদের সাথে উঠতি তরুণ সাহিত্যিকদের মিশেলে এসব ঈদ সংখ্যা বের করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে দৈনিক পত্রিকা, অনলাইন গণমাধ্যম এবং ওয়েবম্যাগ। একসময় শুধু দৈনিকগুলো ঈদ সংখ্যা বের করতো। এখন অনলাইন মিডিয়া এবং ওয়েবম্যাগও ঈদ বিশেষ সংখ্যা বের করছে। এটি একটি ভালো দিক। 

অনেক গণমাধ্যম ঈদের এক বা দেড় মাস আগে ঈদ সংখ্যার জন্য লেখা আহ্বান করে। আবার অনেক পত্রিকা তা করে না। তাদের পছন্দমতো লেখকের কাছে লেখা চেয়ে নেয়। কেউ ঈদ সংখ্যায় লেখার জন্য সম্মানী পায় আবার কেউ পায় না। তবু ঈদ সংখ্যায় লেখা প্রকাশিত হওয়া আজকাল যেন অতি বিশেষ সম্মানের হয়ে উঠেছে! যেভাবেই হোক ঈদের এই বিশেষ সংখ্যাটি করা যে অতি কষ্টের সে কথা সত্যি। বিশেষ লেখা মানেই বিশেষ কিছু। ফলে যারা পাঠক তারা এই সংখ্যাগুলোর প্রতি একটু বেশিই মনোযোগী হয়। বলা যায়, বইমেলার পর এই আয়োজন বা সংখ্যাগুলো পাঠককে নতুন করে বইয়ে ফিরিয়ে আনে। যারা সত্যিকার অর্থেই পাঠক তারা এই সময়ের জন্যই অপেক্ষা করে। কিন্তু বাজারে যত সংখ্যক ঈদ সংখ্যা বের হয় তার কয়টি পাঠক কিনছে বা পড়ছে অথবা সেগুলোর কতগুলো বিক্রি হচ্ছে সে খোঁজ কে রাখছে! অথচ এসব সংখ্যায় লেখকের সবচেয়ে ভালো লেখাটিই থাকে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। 

ঈদ সংখ্যা কতজন পাঠকের কাছে পৌঁছাচ্ছে সেকথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে পাঠকের চাহিদার কথা। একটি বইমেলা শেষে বই কতজন কিনছে বা সেই বিক্রিত বই পাঠ হচ্ছে কিনা সেটিই তো প্রশ্নের মুখে রয়েছে। ঈদ সংখ্যার কত অংশ বিক্রি হচ্ছে সে তথ্য অবশ্য জানা যায় না। তবে ঐতিহ্যের ধারক হওয়ার কারণেই মনে হয় অনেকে বিশাল পরিসরে ঈদ সংখ্যা বের করেন। বহুদিন ধরেই বলা হচ্ছে যে পাঠক কমছে। বইয়ের প্রতি পাঠকের আগ্রহ কমছে। পাঠক বইয়ের চেয়ে হাতের মোবাইল ফোনের প্রতিই বেশি আগ্রহ দেখায়। এখানেও অনেক পাঠক পড়ছে। এমনকি ঈদের সংখ্যার কিছু অংশও এখানে পড়ার সুযোগ রয়েছে। যার লেখা এই বিশেষ সংখ্যায় আসছে তাদের কেউ কেউ তার লেখা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করছেন। এর ফলে অনেকেই সেখান থেকে তার প্রিয় লেখকের লেখা পড়ছে। বিশেষত কবিতার কথাই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গল্প বা উপন্যাস এখানে আসে না। হ্যাঁ, এটি ঠিক যে এটি পড়ে পাঠকের পড়ার তৃপ্তি মেটার কথা নয়, মিটেও না। কারণ পাঠক তৃপ্ত হন পুরো বই পাঠে। কিন্তু পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। আবার অনেক পাঠক তার পছন্দমতো কয়েকটি পত্রিকার ঈদ সংখ্যা কিনছে। 

আরও পড়ুন <> মোল্লা বাড়ির পিয়ারু হয়ে উঠেন কবি আল মাহমুদ

তারপর ধীরে সুস্থে তা পাঠে মনোযোগী হচ্ছে। ঈদ সংখ্যায় লেখা প্রকাশ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি তর্ক-বিতর্ক হতে। যার মূল বিষয়বস্তুই হলো ঈদ সংখ্যায় যাদের লেখা প্রকাশ পায় বা যাদের লেখা নিয়ে ঈদ সংখ্যা প্রকাশিত হচ্ছে তাদের বাইরেও অনেক ভালো লেখক আছেন যাদের লেখা ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়নি বা তাদের কেউ আবার ঈদ সংখ্যার জন্য লেখা পাঠায় না। যারা প্রতিষ্ঠিত লেখক তাদের কাছ থেকে লেখা চেয়ে নেওয়া হয় আর যারা সমসাময়িক ভালো লিখছেন বা নিয়মিতই যাদের লেখা পড়ছি তারা লেখা পাঠান এবং এর মধ্যে থেকে কারও লেখা থাকে আবার কারও লেখা থাকে না। তবে যদি সত্যি সত্যি ঈদ সংখ্যা পাঠকদের একটি বড় অংশের কাছে পৌঁছানো যেত তাহলে ভালো হতো। কারণ বইমেলায় একজন লেখকের বই আলাদা বিক্রি হয়। ফলে সেই লেখকের বা কবির লেখা পড়তে তার বই কিনতে হবে। আর ঈদ সংখ্যায় এসব লেখকের লেখা একসঙ্গে একটি মলাটে পাওয়া যায়। আয়োজনের বৈচিত্র্যও থাকে। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ভ্রমণ কাহিনী, রান্নাবান্নার রেসিপিসহ আরও অনেক কিছু থাকে। ফলে পাঠের তৃপ্তি একটু আলাদাই হয়। 

কিন্তু না থাকলেই এমনটি নয় যে সেই লেখক ভালো লেখেন না। আগেই বলেছি, ঈদ সংখ্যার জন্য প্রচুর লেখা জমা হয় এবং সেখান থেকে সেরা লেখাটি বাছাই করা সাহিত্য সম্পাদকের জন্য একটি কঠিন কাজ। আবারন যে লেখাটি আমার কাছে মানসম্পন্ন বলে মনে হচ্ছে তা তার কাছে মনে না হতেও পারে। ফলে কারও লেখা বাদ পরে যায়। আবার এমনও দেখা যায় যে লেখাটি একজন সাহিত্য সম্পাদকের কাছে প্রত্যাখাত হয়েছে তা অন্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ফলে ঈদ সংখ্যায় লেখা প্রকাশিত হলেই যে সেই লেখক যার লেখা প্রকাশিত হয়নি তার চেয়ে কম দক্ষ সেকথা নিশ্চিতভাবে বলা উচিত নয়। ঈদ সংখ্যা একটি বিশেষ সংখ্যা।

তাই এই সংখ্যায় লেখা প্রকাশিত হলে তা ঈদের আনন্দকে বাড়িয়ে দেয়। তবে এই নিয়ে অতি তৃপ্তিতে ভুগলে তা তার সাহিত্যের ভবিষ্যতকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। যারা নিয়মিত লিখছেন অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করছেন তারা সকলেই ভালো লেখক। আর ঈদ সংখ্যা কিনে পড়ছেন সেই পাঠকের সংখ্যা এখন কম। তারচেয়ে বরং নিয়মিত সাহিত্য পাতায় চোখ বুলানো পাঠকের সংখ্যা বেশি। এর মধ্যে ঈদ সংখ্যায় যারা প্রতিষ্ঠিত লেখকের লেখা যত বেশি প্রকাশ হচ্ছে সেই ঈদ সংখ্যা পাঠক সমাদৃত হচ্ছেও বেশি। নতুন লেখকরা যে সুযোগ পাচ্ছে না তা নয়, তবে তা হাতে গোনা। এর পেছনে কাজ করে ওই একটাই কারণ, তা হলো বাণিজ্যিক! সেটিও স্বাভাবিক। এতকিছুর পরেও ঈদ সংখ্যার সংস্কৃতি পাঠককে নতুন করে পড়ায় আগ্রহ করছে এবং লেখকদের তাদের সেরাটি লিখতেও উদ্বুদ্ধ করছে বছরের পর বছর।

আপন দেশ/আরএ

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়