Apan Desh | আপন দেশ

জাকারিয়া জাহাঙ্গীরের প্রেমকাব্য

রত্না চৌধুরী

প্রকাশিত: ১২:১৫, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩

জাকারিয়া জাহাঙ্গীরের প্রেমকাব্য

ফাইল ছবি

প্রেম, কাম, বিরহ- সাহিত্যের অন্যতম প্রধান উপজীব্য বিষয়। এ তিনটির সাথে নারী ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নারী ও প্রেম ব্যতীত সাহিত্য কল্পনাও করা যায় না। কবিহৃদয় সর্বদা প্রেমে আচ্ছন্ন থাকে। প্রেমহীন মানুষ কখনো কবি হতে পারেন না। কিন্তু এরমধ্যেও কেউ কেউ একটু বেশিই প্রেমময় হন। নারীর সৌন্দর্য, আবেগ, কামনাকে ভিন্ন দৃষ্টিতে আবিষ্কার করেন। বলছিলাম কবি জাকারিয়া জাহাঙ্গীরের কথা। যার তুলিতে, মন ও মগজে পরিপূর্ণ রোমান্টিকতা। সামাজিক প্রেক্ষাপটে নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে কষাঘাত এবং রাজনৈতিক কবিতায় স্পষ্টবাদিতা যেমন লক্ষ্যণীয়, তেমনি তার রোমান্টিক ঘরানার বা প্রেমের কবিতায় চোখ পড়লে আপনাকে একমুহূর্ত থমকে যেতে হবে।

জাকারিয়া জাহাঙ্গীরের তিনটি কাব্যগ্রন্থ এবং একটি প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলো হলো- মেহেদি পাতার রঙ (২০১৮), ভুল-পাওয়ারের চশমা (২০১৯) ও অস্পর্শ চাঁদ (২০২০) এবং প্রবন্ধগ্রন্থ বাইরে ভাইরাস ভেতরে ক্ষুধা (২০২১)। কবির কাব্যগ্রন্থগুলোতে সামাজিক অসঙ্গতির বিরুদ্ধে কষাঘাত এবং রাজনৈতিক কবিতা থাকলেও রোমান্টিক কবিতাগুলো আমাকে বেশি মুগ্ধ করে। কবি প্রেমের জন্য নিজেকে ভিক্ষুকরূপে ধরা দিয়েছেন। যেমনটা ‘মেহেদি পাতার রঙ’-এ লিখেছেন- ‘ভিক্ষা করি-ভালোবাসার রঙধনু/ দু’চোখের নীল, নীলাভ চোখের চাহনি।/কিংবা উষ্ণ ঠোঁটের আল্পনা।’ (প্রেম ভিখারী)। কবির কাছে প্রেমিকার রূপ পৃথিবীর সবচেয়ে সৌন্দর্যপূর্ণ। একই বইতে ধরা পড়েছে এমনই উপমা- ‘মাখনের মতো কোমল শরীর/সুবাসিত গোলাপের মতো ঠোঁট/অতলান্ত নদীর মতো চোখ/ আমার সারা গায়ে জ্বালিয়ে দেয় আগুনের লেলিহান শিখা।/এ যেন আগ্নেয়গিরির লাভা!/সে পরশ আমি সইতে পারি না...।’ (লেলিহান ভালোবাসা)

‘ভুল-পাওয়ারের চশমা’ বইয়ে লিখেছেনÑ ‘তুমি আগ্নেয়গিরি, রূপের আগুনে পুড়ি বারবার/হরিণীর নয়নবাঁকে খুন হই অনায়াসে...।’ (পুনর্জন্ম)

জীবন মানে বহতা নদী, ভাঙা-গড়ার ঢেউ। জীবনের বর্ণনা দিতে গিয়েও কবি খুঁজে পেয়েছেন নারী-সৌন্দর্যের সাদৃশ্য। ‘মেহেদি পাতার রঙ’ বইয়েই ‘জীবনের হালখাতা’ কবিতায় তিনি লিখেছেন- ‘জীবন যদি লাল ফিতে হতো/এলোকেশী গ্রাম্য মেয়ের চুলের গন্ধ নিতো।/জীবন যদি গাঢ় লিপস্টিক হতো/যুবতীর উষ্ণ ঠোঁটে সুখের রোমাঞ্চ পেতো।’ আগেই বলেছি, কবি প্রেমিকার কাছে প্রেমের জন্য ভিক্ষুক। কিন্তু কখনো তিনি প্রেমিকাকে দেবীর আসনে বসিয়ে তার চরণতলে ঠাঁই খুঁজেন। ভেবে অবাক হই কতটা আকুল তার ব্যাকুলতা ‘ভুল-পাওয়ারের চশমা’ বইয়ের এই লাইনগুলোÑ ‘তোমার শ্বেতশুভ্র, কোমল পদযুগল চুম্বন করে/দেবী নামে ডেকেছিলাম,/আমার মৃদুস্পর্শে প্রকম্পিত সমুদ্রের মতো উথলে ওঠে বলেছিলেÑ/‘নৃশংস ভালোবাসা দাও, কাছে নাও হিংস্রতায়, প্রেমে হও বন্য’।/ তোমার কথা রাখতে পারিনি, সসম্মানে বলেছিলাম-/‘আমি দেবতা হতে আসিনি,/এসেছি দেবীর চরণে ঠাঁই নিতে’। (অভিলাষী পত্রালাপ)

একই বইয়ের আরও দু’টি লাইনে প্রেমিকার জন্য ছুটে চলার আকুলতা দেখুন, যেখানে ক্লান্তি কখনো স্পর্শ করে না কবিকে- ‘ভালোবাসি ব্যস্ত শহর, শুধু তোমার বাস তাই/তুমিময় ঘ্রাণ নিয়ে ফিরি, দেখা পাই না পাই!’ (অন্নপূর্ণার শহর)

এই আকুলতার উদযাপনও কবির ভিন্নরকম। পিপাসায় কাতর হলেও কবি পেতে চান প্রেমিকারই স্পর্শ। ‘অস্পর্শ চাঁদ’ বইতে যেমনটা তিনি লিখেছেন- ‘মিছেমিছি চোখের ক্ষুধাতে জাগাও আমারও ক্ষুধা!/তবে যে জলে সাঁতরে মরো তুমি বারেবারে/সে জলটুকু খাইয়ে দাও তৃষিত মোরে...।’ (পিপাসার আর্তনাদ)

প্রেম ও কাম- একটি অন্যটির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। প্রেমহীন কাম অনর্থক। প্রেমে কাম থাকুক বা থাকুক, কামে প্রেম অবশ্যম্ভাবী। তবে কাম প্রেমেরই পূর্ণতা। কবির ভাষায়- ‘পুরুষ যতক্ষণ না কামুক হয়, ততক্ষণ সে প্রেমিকও হতে পারে না...’। ‘অস্পর্শ চাঁদ’-এ কবি কামের আহ্বানকে তুলে ধরেছেন শৈল্পিকভাবে- ‘তুমি এক অদ্ভুত রণাঙ্গন।/বিধ্বস্ত পরাজয়ের অতৃপ্ত নেশায়/বারবার ভেঙে দাও নিস্তব্ধ সৈনিকের ঘুম।/যুদ্ধ খেলার আদিম বাজিতে তাড়িয়ে দাও সন্ধির আহ্বান।/তোমার চিৎকারে-শীৎকারে জেগে উঠে শির,/এক-একটি রণঝঙ্কারে আমি হয়ে যাই মাতাল যোদ্ধা।’ (নুনের নদী)

নিয়মিত বিভিন্ন পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চোখ রাখার সুবাদে জাকারিয়া জাহাঙ্গীরের নতুন কিছু রোমান্টিক কবিতা চোখে পড়ছে। অধিকাংশ রোমান্টিক কবিতায় তিনি রূপসীর ঠোঁটকে শৈল্পিকরূপে আবিষ্কার করেছেন। তেমনই কিছু পঙক্তি যেমন- ‘অদ্ভুত বাজেট! সিগারেটের দাম বাড়লেওÑ/চুমুর উপর কো-ন-ও করারোপ করা হয় নাই/এ বাজেট আমার মনপুত হয়নি মোটেও.../প্রেমিকার ঠোঁটের মূল্য কি এতই কম মাননীয় অর্থমন্ত্রী!/ভেবেছিলাম, চুমুর কর শোধ করতে করতে-/ সুইস ব্যাংক, বিশ্বব্যাংক ফতুর করে দেবো...। (চুমুর কর)

‘গলা শুকিয়ে গেলে/তোমার ঠোঁটের কাছে যাই-/ওখানে সাতটি মহাসমুদ্র/চুমুতে তৃষ্ণা মিটাই...। (কেরু অ্যান্ড কোং)

‘চুমু শতভাগ ভিটামিন-ডি-/ভেজালমুক্ত বিষের চেয়েও দ্রুতগামী,/প্রেমপরিবাহী-পাইলেই অমরত্বের ঘ্রাণ।’ (ভিটামিন-ডি)

‘চলে যাবে?/যাও/যেখানে যতদূর/যেতে চাও.../শুধু/ তোমার ঠোঁট দুটো রেখে যেও।’ (পেট্রোলিয়াম জেলি)

‘তোমার হাতে হাত রেখে-/ আমি এককোটি বছর ধরে হাটতে পারি/তোমার চোখে চোখ রেখে-/দাঁড়িয়ে থাকতে পারি আরও এককোটি বছর/তোমার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে-/এককোটি বছরের জন্য নিরুদ্দেশও হতে পারি।’ (এককোটি বছর)

আমার চোখে বাইরে প্রচণ্ড গম্ভীর, ভেতরটা বাস্তবিকতায় ভরা। কিন্তু এতটা রোমান্টিকতা কোথায় থাকে কবির- তাই ভাবি। তবে সবমিলিয়ে তাকে রহস্যপুরুষই মনে হয় আমার কাছে। রূপসীর ঠোঁটেই যিনি চড়ুইভাতি পছন্দ করেন তিনিই কিনা লিখেন- ‘রূপসীর রূপ রূপকথার হাট/ভুলেও ওদের ঠোঁটে সওদা করতে যাবেন না।’ (কবিতা: মধ্যসত্বভোগী ঠোঁট)

যদিও কোনো লেখককে তার লেখা দিয়ে ব্যক্তিগত জীবন বিচার করা যায় না, তবে কিছুটা আঁচ করা যায়। জাকারিয়া জাহাঙ্গীর ‘অস্পর্শ চাঁদ’ কাব্যগ্রন্থে তারই লেখা ‘মোহাবিষ্ট ক্যাকটাস’ কবিতায় স্পষ্ট করেছেন তার রহস্যময়তা- ‘স্বপ্ন ছুঁতে আটলান্টিক পেরিয়ে এসেছো/অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে, মেটাতে চেয়েছো আজন্মের লালসা/নিছক বোকার মতো যাকে ধরেছো, সে এক মোহাবিষ্ট ক্যাকটাস।’ কবি সত্যিই মোহাবিষ্ট। রহস্য যতই থাক- মোহ দিয়ে আচ্ছন্ন রাখুন জগতকে, সুন্দরীদের হৃদয়ে বেঁচে থাকুন হাজার বছর।

আপন দেশ/আরএ

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়