Apan Desh | আপন দেশ

ভূগর্ভের পানি শেষের পথে!

সৈয়দ মুহাম্মদ আজম

প্রকাশিত: ১৫:৫৭, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

আপডেট: ১৬:০৪, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

ভূগর্ভের পানি শেষের পথে!

পানির স্তরের নাগাল পেতে মাটির গভীরে বসানো শ্যালো মেশিন। ছবি: সংগৃহীত

তৃতীয় দফার হিট অ্যালার্ট চলছে। প্রতিদিনই বাড়ছে তাপমাত্রা। সুখবর নেই। গত এক সপ্তাহে হিটস্ট্রোকে প্রায় ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তীব্র তাপদাহে ওষ্ঠাগত প্রাণ। বৃষ্টির দেখা নেই। খাল, বিল, নদী-নালা যেন মরুচর। ভূগর্ভের পানি দ্রুত নেমে যাচ্ছে নিচে। অগভীর-গভীর নলকূপ থেকে প্রয়োজনীয় পানি উঠছে না। সেচের পানি সংকটে বেকায়দায় কৃষক। ৫৪ বছর পর আরও ভয়াবহ চিত্র হলো- এ স্বল্পতার ধাক্কা লেগেছে সুপেয় পানিতেও। দক্ষিণাঞ্চলের ভূগর্ভে নোনা পানির অনুপ্রবেশ বাড়ছে।  

বিশেষজ্ঞরা শঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ অসীম নয়। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে দেশের ২১ শতাংশের বেশি ভূমি পানির নিচে স্থায়ীভাবে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পানি পেতে এবং ভূমিধস ঠেকাতে এখনই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

ক্রমেই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানি। দেশের বিভিন্ন জেলায় টিউবওয়েলের পানি উঠছে না। সুপেয় পানি সংকটের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। এ বছর ভূগর্ভস্থ পানি নেমে যাওয়ার কেন্দ্রীয় হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন জেলার গৃহস্থ, কৃষক ও জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, ৩০ থেকে ৩৫ ফুট নিচে পানির স্তর নেমে গেছে। এ পরিস্থিতিকে ভবিষ্যতের জন্য ‘বড় হুমকি’ হিসেবে দেখছেন তারা।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পরিস্থিতি মোকাবেলায় এখনই ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে, তা না হলে চরম বিপর্যয় দেখা দেবে। এ থেকে রক্ষা পেতে ভূগর্ভের পানির ব্যবহার কমাতে হবে। ভূগর্ভে পানির অনুপ্রবেশ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। জলাধার ও জলাশয়ের পরিমাণ বাড়াতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির সরবরাহ বাড়াতে প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি বৃষ্টির পানি ধরে রাখার টেকসই প্রযুক্তিগুলোর উন্নয়নে জোর দিতে হবে।

সূত্র থেকে জানা গেছে, দেশে কৃষিকাজে প্রায় ১৮ লাখ টিউবওয়েল ব্যবহার করা হয়। সারাদেশে প্রায় ১৩ লাখ টিউবওয়েল স্থাপন করেছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ। এর বাইরে যেসব অগভীর নলকূপ ব্যবহার করা হয়, তার মধ্যে ৫৫ শতাংশ অকেজো (পানি পাওয়া যায় না)। বিষয়টি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকেও।

যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দারা পানির অভাবে বিক্ষোভ করছেন। ছবি: এসকে এনামুল হক

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, প্রতি ১০ বছরে দিনাজপুর জেলায় পানির স্তর প্রায় ১০-১৫ ফুট নিচে নামছে। গড়ে প্রতিবছর ৭ থেকে ৮ ফুট নিচে নেমে যাচ্ছে। রাজবাড়ীতে পানির স্তর ৩০ থেকে ৩৫ ফুট, কুষ্টিয়ায় ২৭ থেকে ৩৪ ফুট, যশোরে ৩৪ ফুট, জয়পুরহাটে ৪৩ থেকে ৪৪ ফুট নিচে নেমেছে। চুয়াডাঙ্গায় বর্ষা মৌসুমেও ১০০-১৪০ ফুটের মধ্যে পানির স্তর পাওয়া যাচ্ছে না।

এদিকে রাজধানী ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের পরিসংখ্যান বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৯৬ সালে ঢাকায় পানির স্তর ছিল ২৫ মিটার, যা পরবর্তীতে ২০০৫ সালে ৪৫ মিটার নিচে নামে, ২০১০ সালে ৬০ মিটার ও সর্বশেষ ২০২৩ সালে এসে যা ৭৫ মিটার নিচে নেমে গেছে। ২০৫০ সালের দিকে যা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ১২০ মিটারে নেমে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন>> ক্যাম্পাসের ‘অন্ধকার রীতি’ ঘুচবে কবে?

জাতিসংঘের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, অধিক পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনে শীর্ষ তালিকায় এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ১০ দেশ স্থান পেয়েছে। যার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এবং গবেষকরা কয়েক দশক আগেই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন।

নাসার মতে, পৃথিবীর ৩৭টি বৃহৎ পানির স্তরের মধ্যে ২১টির পানি ফুরিয়ে যাচ্ছে। এ স্তরগুলোর অবস্থান ভারত ও চীন থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের সীমানার মধ্যে। নাসা ১৩টি পানির স্তরকে আখ্যায়িত করেছে চরম সংকটাপন্ন স্তর হিসেবে, যেগুলো প্রায় শুকিয়ে গেছে। পানির স্তর নিচে নামার বিপদ থেকে নদনদীর দেশ বাংলাদেশও মুক্ত নয়।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে বিশুদ্ধ খাবার পানির সরবরাহ করা হচ্ছে। ছবি: আপন দেশ

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তীব্র খরা ও বৃষ্টিপাত না হওয়া বরেন্দ্র অঞ্চলে পানিসংকটের মূল কারণ। খরায় পুকুর, খাল, বিল, নদীর পানি শুকিয়ে গেছে। এতে পানির সংকট দীর্ঘ হচ্ছে।

এ বিষয়ে পরিবেশবিদ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) অধ্যাপক শ্রীপতি সিকদার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, একটা সময় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার এত পরিমাণে ছিল না। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিও হচ্ছে অনিয়মিত। গাছপালা কমেছে, তাপমাত্রা বেড়েছে। সব ঠিকঠাকমতো না হওয়ায় পানির প্রাপ্যতা কমে গেছে। একই কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।

ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার যথাসম্ভব কমিয়ে আনার ব্যবস্থা করা জরুরি জানিয়ে এ পরিবেশবিদ বলেন, কৃষিকাজে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়িয়ে শুধু পানীয় পানি ভূগর্ভ থেকে সংগ্রহ করতে হবে। খাল-বিল, নদী-নালা, জলাশয়গুলো দখল নয়, বরং সংস্কার করে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের বিষয়ে আইনের বাধ্যবাধকতা জরুরি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কাজী মতিন আহমেদ বলেন, কাদামাটির স্তরগুলো বালির স্তরগুলোর ঠিক বিপরীত আচরণ করে। কাদার স্তরে (যার পুরুত্ব ৬০ ফুট পর্যন্ত) কোনো অব ডিপ্রেশন তৈরি হলে ভূমিধস হতে পারে। ভূগর্ভস্থ পানির রিজার্ভ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ অসীম না। সরকারকে অবশ্যই জাতীয় অগ্রাধিকার বিবেচনায় এর ব্যবস্থাপনা করতে হবে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

আপন দেশ/এসএমএ/এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়