Apan Desh | আপন দেশ

চিত্তের চিত্ত হরণ করেছে তালগাছ

যশোর প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ০৯:৪২, ৪ মে ২০২৪

আপডেট: ০৯:৪৩, ৪ মে ২০২৪

চিত্তের চিত্ত হরণ করেছে তালগাছ

ছবি : সংগৃহীত

বর্ষার এক তুমুল বৃষ্টির দিনে চায়ের দোকানে বসেছিলেন চিত্তরঞ্জন দাস। পাশে দেখলেন, একজন পত্রিকা পড়ছেন। চিত্তরঞ্জন পত্রিকায় তালগাছের ছবি দেখে কৌতূহলী হলেন।

সেই ভদ্রলোক চিত্তরঞ্জনকে বললেন, আমেরিকার এক বিজ্ঞানী বলেছেন, তালগাছের অনেক গুণ। সবচেয়ে বড় কথা মাথা উঁচু এ গাছটি বজ্রপাতকে দুর্বল করে দেয়।

সেই কথা মনে ধরে চিত্তরঞ্জনের। চিত্তরঞ্জন ঠিক করলেন, তালের বীজ লাগাবেন বিলের রাস্তার ধারে।

শুরু করলেন তা দিয়েই। কিছুদিনের মধ্যে হাজারখানেক বীজ সংগ্রহ করে তা লাগিয়ে দিলেন প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ ধোপাদী-মশিয়াহাটী সড়কের দুই ধারে। এভাবে প্রথম বছর প্রায় আড়াই হাজার বীজ লাগিয়েছিলেন তিনি। সে ২০০৮ সালের কথা।

তালগাছ লাগানোর ‘বাতিক’ আর ছাড়েনি চিত্তরঞ্জনকে। গত ১৬ বছরে তিন লাখের কাছাকাছি (দুই লাখ ৮৮ হাজার) তালের বীজ বুনেছেন যশোরের অভয়নগরের আটটি ইউনিয়ন, নওয়াপাড়া পৌর এলাকা ও মণিরামপুরের ৪২টি ছোট-বড় সড়কের দুই ধারে। ৫৬ হাজার খেজুরগাছের বীজও রোপণ করেছেন তিনি।

তালগাছপ্রেমী চিত্তরঞ্জন দাসের বাড়ি অভয়নগর উপজেলার ধোপাদী গ্রামের দক্ষিণপাড়ায়। বৃক্ষপ্রেমী মানুষ হলেও কৃষিকাজে জীবিকার পুরো ব্যবস্থা না হওয়ায় বাড়তি আয়ের জন্য চিত্তরঞ্জন মাঝেমধ্যে গাছ কিনে চেরাই করে বিক্রি করেন।

আরেকটি কারণেও তালগাছ লাগিয়ে খুব তৃপ্ত চিত্তরঞ্জন। আর তা হলো বাবুই পাখিদের ফেরা। চিত্তরঞ্জন বললেন, ‘তালগাছের ছায়ায় বসে মানুষ গল্প করে, কৃষকরা ভাত খায় বা বজ্রবৃষ্টির সময় আশ্রয় নেয়— এসব দেখে খুব ভালো লাগে। তবে তালগাছ ছিল না বলে এত বছর ধরে এলাকায় বাবুই পাখির খুব একটা দেখা মিলত না। এখন সে পাখিরা আবার ফিরছে। ওদের দেখে মন ভরে যায়।

চিত্তরঞ্জন বলেন, ‘আমি তো গরিব মানুষ। লেখাপড়া জানি নে। গাছগুলো মানুষকে ছায়া দেয়। বজ্রপাত ঠেকায়। ফল দেয়। অক্সিজেন দেয়। যাদের টাকা আছে তারা মানুষের জন্য অনেক কিছু করে। কিন্তু গাছ লাগানো ছাড়া তো মানুষের উপকার করার অন্য উপায় জানা নাই আমার!’

শুধু তালের বীজ রোপণ করেই ক্ষান্ত দেন না চিত্তরঞ্জন দাস। নিয়মিত গাছগুলোর পরিচর্যাও করেন। কোমরে গামছা বেঁধে প্রায়ই সকালে বিভিন্ন গ্রামের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন সাইকেলে। সঙ্গে থাকে কোদাল, পানির বোতল ও দা। চারার নিচে আগাছা হলে তুলে ফেলেন। বৃষ্টিতে গোড়া থেকে মাটি সরে গেলে জমি থেকে মাটি নিয়ে তা ভরে দেন। 

আরও পড়ুন <> তাপপ্রবাহ আরও দুই দিন থাকবে

তালের বীজ কিনতে চার টাকার মতো খরচ হয় চিত্তরঞ্জনের। অনেকে ফ্রি দেন। নিজের আয়ের একটা অংশ খরচ করেন এর পেছনে। 

এখন যশোরের সীমানা পেরিয়ে দেশের অন্যান্য জেলায় এই কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে দিচ্ছেন চিত্তরঞ্জন। গত বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা এবং পিরোজপুরের কাউখালীতে ১০ হাজার তালবীজ লাগিয়েছিলেন। কাজে সন্তুষ্ট হয়ে সেবার তাকে দুই জায়গা থেকে ২০ হাজার করে মোট ৪০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

এমন পুরস্কার পেয়ে খুব খুশি চিত্তরঞ্জন। সেটিই ছিল তার জীবনে পাওয়া প্রথম পুরস্কার। ওই পুরস্কারের টাকার অর্ধেক খরচ হয়েছিল। বাকি টাকার সঙ্গে নিজের ৩০ হাজার মিলিয়ে এবার মোট ৫০ হাজার টাকার তালগাছের মাথা (গাছের তাল আর পাতা) কিনেছেন। এ বছর আরো ২০ হাজার টাকার বীজ কিনবেন বলে জানালেন তিনি।

মাত্র তিন বছর বয়সে মাকে হারানো চিত্তরঞ্জন বড় হয়েছেন বাবা-কাকার কাছে। অনটনের কারণে লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি। ২১ বছর বয়সে হারিয়েছেন বাবার ছায়াও। এখন তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে ৬৭ বছর বয়সী চিত্তরঞ্জনের সংসার। ৩০ বছর আগে দোচালা টিনের ঘর তুলেছিলেন। মরচে ধরে জায়গায় জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে সেই টিন। সেকালের শক্তপোক্ত জিনিস বলেই হয়তো এটুকু টিকে আছে। বর্ষায় ঘরের ভেতরে পানি পড়ে। কিন্তু টাকার অভাবে টিন বদলাতে পারছেন না।

স্বামী পরিত্যক্তা একটি মেয়েও এখন তার পরিবারে থাকেন। এসব জানিয়ে চিত্তরঞ্জন আক্ষেপের সুরে বললেন, ‘জীবনটা আমার দুঃখের সাগর। সহযোগিতা পেলে অন্তত ঘরটা ঠিক করে শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম।’

চিত্তরঞ্জনের বিষয়ে সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিকাশ রায় কপিল বললেন, ‘এ যুগে তার মতো সাদা মনের মানুষ বিরল। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে তার রোপণ করা অসংখ্য তালগাছ এখন দাঁড়িয়ে আছে। অভাবী এই মানুষটা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ভালো হতো।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কে এম আবু নওশাদ বলেন, ‘বৃক্ষপ্রেমিক চিত্তরঞ্জন দাসকে সরকারিভাবে সহযোগিতা করার ইচ্ছা রয়েছে। এর মধ্যেই তার পরিবারকে কিছু খাদ্যপণ্য ও উপহারসামগ্রী দেয়া হয়েছে। চলতি মৌসুমে অভয়নগরে ১০ লাখ খেজুরবীজ রোপণের প্রক্রিয়া চলমান। প্রাথমিক পর্যায়ে বীজ কেনার জন্য তাকে পাঁচ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে।’

আপন দেশ/এমআর

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

জনপ্রিয়