Apan Desh | আপন দেশ

খাদ্য উৎপাদনে শঙ্কা বাড়লো

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১০:৫২, ১২ এপ্রিল ২০২৩

আপডেট: ১০:০০, ১৩ এপ্রিল ২০২৩

খাদ্য উৎপাদনে শঙ্কা বাড়লো

ফাইল ছবি

আগাম ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ বেড়ে গেছে সারের দাম। কেজিতে পাঁচ টাকা। মাত্র নয় মাসের ব্যবধানে চার ধরনের সারের দাম আরেক দফা বাড়ানো হলো। বাড়তি দাম কার্যকর হয়েছে সোমবার (১০ এপ্রিল) থেকেই। 

এতে করে বছরে সরকারের প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি কমবে। তবে এ টাকা গুনতে হবে কৃষককেই। কৃষকের উৎপাদিত ফসলেরও ওপর প্রভাব েপড়বে। বেড়ে যাবে খাদ্যপণ্যের দাম। পকেট কাটা যাবে ভোক্তাদের।  

এদিকে সরকার বলছে অতিরিক্ত ভর্তুকির চাপ সামাল দিতেই এ দাম বৃদ্ধি। 

ডিজেল, বিদ্যুৎ, বীজসহ সব কৃষি উপকরণের ঊর্ধ্বমুখী দরের কারণে ফসল উৎপাদনে কৃষকের যখন হিমসিম অবস্থা, তখন বোরো মৌসুমে আবারো সারের দর বাড়ার ঘোষণায় শঙ্কায় রয়েছেন কৃষকরা। সরকারের এমন সিদ্ধান্ত কৃষকের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সেচ ও পরিবহন খরচ বাড়ার সঙ্গে সারের এই বাড়তি দর কৃষককুলকে চাপে ফেলবে। খরচ বাড়ার কারণে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বেড়ে যাবে কৃষিপণ্যের দাম।

দেশে বার্ষিক চাহিদার বিপরীতে মোট উৎপাদিত চালের ৫৫ শতাংশের বেশি আসে এ মৌসুমে। বোরো উৎপাদনের ওপর সারা বছরের চালের বাজারের স্থিতিশীলতা নির্ভর করে। কৃষক ও কৃষি গবেষকরা জানান, বেশিরভাগ স্থানেই ধান পাকতে শুরু করেছে। এ সময়ে খুব বেশি সারের ব্যবহার নেই। ফলে এ মৌসুমে কৃষকের ওপর চাপ না বাড়লেও ভুট্টা, সবজিসহ অন্যান্য ফসলে খরচের চাপ বাড়বে। এই মুহূর্তে সারের দাম বাড়ানোর প্রভাব না পড়লেও পরবর্তী সব মৌসুমেই এই বাড়তি খরচ কৃষকের ঘাড়ে চাপবে, যা কৃষককে উৎপাদনে নিরুৎসাহিত করতে পারে বলে মনে করছেন গবেষকরা।

অবশ্য সরকার বলছে, কৃষকের ওপর চাপ পড়লেও উৎপাদন কমবে না। আর অর্থনীতিবিদ ও কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, সারের মূল্যবৃদ্ধির পশাপাশি যেন কোনোভাবে অপর্যাপ্ত না হয় কিংবা ঘাটতি যেন না পড়ে সেদিকে নজর দিতে হবে। কৃষক ফসল উৎপাদনে যেন সার কম না পায়, সে জায়গা নিশ্চিত করতে হবে। 

কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, দাম কিছুটা বৃদ্ধির ফলে কৃষকদের মাত্রাতিরিক্ত সার ব্যবহারের প্রবণতা কমবে। অপরদিকে দাম ভালো পেলে কৃষকরা তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের ১০ এপ্রিলের এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি মন্ত্রণালয় সোমবার সারের মূল্যবৃদ্ধির এই আদেশ জারি করে এবং ওই দিনই পুনঃনির্ধারিত এ মূল্য কার্যকর হয়েছে।

সারের দাম বৃদ্ধির আদেশে বলা হয়েছে, কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ইউরিয়ার বর্তমান দাম ২২ টাকার পরিবর্তে ২৭ টাকা, ডিএপি ১৬ টাকার পরিবর্তে ২১ টাকা, টিএসপি ২২ টাকার পরিবর্তে ২৭ টাকা এবং এমওপি ১৫ টাকার পরিবর্তে ২০ টাকা পুনঃনির্ধারণ করা হয়।

একইভাবে ডিলার পর্যায়েও প্রতি কেজি ইউরিয়ার বর্তমান দাম ২০ টাকার পরিবর্তে ২৫ টাকা, ডিএপি ১৪ টাকার পরিবর্তে ১৯ টাকা, টিএসপি ২০ টাকার পরিবর্তে ২৫ টাকা এবং এমওপি ১৩ টাকার পরিবর্তে ১৮ টাকা পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের বর্তমান দাম ৪৮ টাকা, ডিএপি ৭০ টাকা, টিএসপি ৫০ টাকা আর এমওপি ৬০ টাকা। এর ফলে পাঁচ টাকা দাম বৃদ্ধির পরও সরকারকে প্রতি কেজি ইউরিয়াতে ২১ টাকা, ডিএপিতে ৪৯ টাকা, টিএসপিতে ২৩ টাকা এবং এমওপিতে ৪০ টাকা ভর্তুকি দিতে হবে।

দিনাজপুরের সোনারগাঁওয়ের সবজি ব্যবসায়ী আবদুর রাজ্জাক বলেন, সবজি চাষ করে সংসার চলে। সারের যে দাম বেড়েছে তাতে বস্তায় ২৫০ টাকা বাড়বে। এর আগের বছর বস্তায় বেড়েছে ৩০০ টাকা। যদি বছর বছর সারের দাম বাড়ে তাহলে ক্ষেত্ করা যাবে না। তবে সারের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি সারের সরবরাহ ঠিক থাকে আর ফসলেরও দাম বাড়ে তাহলে সমস্যা হয় না। কিন্তু আমরা কষ্ট করে উৎপাদন করি দাম পাই না। এভাবে চলতে থাকলে আবাদ কমিয়ে দিতে হবে। প্রতিবছর লোকসান দিতে পারবো না।

কৃষকরা বলছেন, চলতি আমন মৌসুমে উৎপাদন ব্যয় উঠবে কিনা-তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বেশি সমস্যায় আছেন বর্গাচাষিরা। তারা বলছেন, সারের দাম বৃদ্ধি এবং অনাবৃষ্টিসহ শ্রমিক ব্যয় ও আনুষঙ্গিক যে ব্যয় হবে, তাতে লোকসান হবে। এর সঙ্গে তাদের নিজেদের শ্রমের মূল্য যুক্ত করলে লোকসানের পাল্লা আরও ভারী হবে। 

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এই মুহূর্তে সরকার দেশে উৎপাদিত সারের থেকে আমদানিকৃত সার দিয়ে চাহিদা মেটাচ্ছে। গ্যাসের সংকটের কারণে সার কারখানাগুলোতে পর্যাপ্ত গ্যাস দেয়া যাচ্ছে না। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে সারের ঘাটতি রয়েছে। সেটি আমদানি করে মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস ও সারের মূল্য বেশি। একই সঙ্গে সরকারের রিজার্ভে টানাপোড়ন রয়েছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী সার আমদানি করা যাচ্ছে না। এদিকে ডলার সংকট অন্যদিকে রাজস্ব আহরণে ঘাটতি। এমন পরিস্থিতিতে সরকার সারে যে ভর্তুকি দেবে, সেই পরিস্থিতিও নেই। সে সব বিবেচনায় সারের মূল্যবৃদ্ধি না করে সরকারের কোনো উপায় ছিল না।

আরও পড়ুন <> রাসায়নিক সারের দাম কেজিতে বাড়লো ৫ টাকা

তিনি বলেন, কৃষকের জন্য হতাশাজনক হবে তখন যখন মূল্য বাড়ানোর পরও যদি পর্যাপ্ত সার না পাওয়া যায়। তবে অভিযোগও আছে চাহিদা অনুযায়ী সার সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা যাচ্ছে না। কারণ নানা কারণে পর্যাপ্ত সার আমদানি করতে পারছে না। আর উৎপাদন ও সরবরাহ ঠিক রাখতে সার আমদানি করতেই হবে সরকারকে। এজন্য রিজার্ভ থেকে যতটা খরচ করা যায়, সেটি সরকারকে করতে হবে। আর মূল্যবৃদ্ধি করে রাজস্ব মেটানোর চেষ্টা করা হবে।

সিপিডির এই গবেষণা পরিচালক বলেন, দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। যেহেতু কৃষকদের ব্যয় বাড়বে। বোরোসহ সামনে যে ফসলের মৌসুম রয়েছে সেগুলোরও ব্যয় বাড়বে। ফলে সারের বাড়তি মূল্যে প্রভাব পড়বেই। তবে আমি মনে করি, সারকে বাড়তি মূল্য দিয়ে আমদানি করতে হলেও সারের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। কৃষকও বাড়তি মূল্য দিয়ে সার কিনতে প্রস্তুত থাকবেন। যদি তার জন্য যথেষ্ট সার সরবরাহ করা যায়। মূল্যবৃদ্ধির পশাপাশি সারের সরবরাহ কোনোভাবে অপর্যাপ্ত না হয় বা ঘাটতি না পড়ে। কৃষক ফসল উৎপাদনে যেন সার কম না পায় সে জায়গায় নিশ্চিত করতে হবে। না হলে সারের সংকট হলে উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সেটি কৃষক এবং ভোক্তার জন্য দুর্ভাবর্নার কারণ বেশি হবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পণ্যের দামে প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে কৃষি পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এ ছাড়া দাম বাড়বে কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন শিল্প পণ্যের। সামগ্রিকভাবে যা মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলবে। অর্থাৎ এমনিতে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। সেটি আরও বাড়বে। বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনীতির যে অবস্থা সেখানে ভর্তুকি বাড়ানো কঠিন।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ এম আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়া ও বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শর্ত মেনে বাংলাদেশকে জ্বালানি তেল, সারসহ বিভিন্ন পণ্যের ভর্তুকি কমানো ও দাম বাড়াতে হচ্ছে। সারের দর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর প্রভাবে কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ যে পরিমাণে বাড়বে, এর একটা হিসাব করা উচিত ছিল। সেই সঙ্গে বাড়তি এই খরচ উঠিয়ে আনার পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা কৃষককে দেয়া উচিত। সারের দাম বাড়ানোর আগে বিষয়টি দেখা যায়নি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ খান বলেন, প্রয়োজনে অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সময় কমিয়ে কিংবা সাপ্তাহিক ছুটি বাড়িয়ে বিদ্যুতে ভর্তুকি কমিয়ে কৃষিতে সেই ভর্তুকি দিয়ে হলেও সারের দর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা উচিত।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নয় মাসের মাথায় আবারো সারের দাম বাড়ানো মোটেই যৌক্তিক হয়নি। বৈশ্বিক খাদ্য সংকট চলাকালে দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হলে সবার আগে আমাদের পর্যাপ্ত সার সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। দাম বাড়লে অনেক কৃষক উৎপাদন খরচ কমাতে আগের চেয়ে কম সার ব্যবহার করবে। এতে ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।  

কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, দাম বাড়ানোর কারণে কৃষকের ওপর চাপ পড়বে, তবে উৎপাদন কমবে না। আমরা চাইব, বীজ বা অন্যভাবে কৃষকের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে। আমি চাইনি কোনোভাবেই সারের দাম বাড়ুক। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে শক্ত অবস্থানে ছিল যে, দাম বাড়াতেই হবে। প্রধানমন্ত্রীও বলেছিলেন, সারের দাম না বাড়াতে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত বাড়াতেই হলো।

তিনি বলেন, কিন্তু দাম যা বেড়েছে, সেটিও বৈশ্বিক সারের যে দাম বেড়েছে সে তুলনায় বাড়েনি। এখনো সরকারকে সারে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিতে হবে। তবে বৈশ্বিক দাম কমে আসলে সারের দাম সমন্বয় করা হবে। তবে বোরো ধানের আগ পর্যন্ত সারের চাহিদা বেশি থাকে এরপর সারের চাহিদাও কমে আসবে। তাই এই দামে খুব সমস্যা হবে না।

আপন দেশ/আরএ

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ

জনপ্রিয়