Apan Desh | আপন দেশ

এফএওর প্রতিবেদন

খাদ্যের তিন-চতুর্থাংশের উৎপাদক গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ৮০ শতাংশই দরিদ্র

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশিত: ১২:০১, ২৮ আগস্ট ২০২৩

আপডেট: ১৭:০১, ২৮ আগস্ট ২০২৩

খাদ্যের তিন-চতুর্থাংশের উৎপাদক গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ৮০ শতাংশই দরিদ্র

ফাইল ছবি

বিশ্বে প্রতিবছর যে পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন হয় তার তিন-চতুর্থাংশের উৎপাদক গ্রামীণ জনগোষ্ঠী। যদিও ওই জনগোষ্ঠীর ৮০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। গত ১৮ আগস্ট ‘ট্রান্সফরমিং অ্যাগ্রিফুড সিস্টেমস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাসে ঘাটতি আছে। ঝড় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘন ঘন হচ্ছে। তাপমাত্রা স্থিতিশীল নয় এবং যথাসময়ে ঋতু আসছে না। খাদ্য উৎপাদনকারীদের এই জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করতে হবে।

বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক ৪০০ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে বলা হয়, আটটি দেশজুড়ে (বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা এবং থাইল্যান্ড) এই বঙ্গোপসাগর ছড়িয়ে আছে। দরিদ্র এই জনগোষ্ঠী খাদ্য ও জীবিকার জন্য উপসাগরের ওপর নির্ভরশীল। তবু বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক সম্পদের ক্রমাগত অবক্ষয় এই উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। তার ওপর রয়েছে সামুদ্রিক দূষণ, বাসস্থান সংরক্ষণ ও দুর্যোগের মতো সমস্যাগুলো মোকাবিলা করা। ফলে কঠিন সময় পাড়ি দিতে হচ্ছে এই দরিদ্রদের। 

এফএওর প্রতিবেদনের সত্যতা খুঁজে পাওয়া গেল কক্সবাজার জেলার ঢেমুশিয়া চকরিয়ার কৃষক আলী আহমদের কথায়। তার পরিবারের দুই বেলা ভালোভাবে খাবার জোটে না। নিজের কোনো জমিও নেই। অন্যের জমিতে বর্গায় (অর্ধেক দেয়ার শর্তে) ফসল ফলান। বছরে আমন ও বোরোসহ দুটি ফসলে ৬০ মণ ধান পান। সেখান থেকে ভাগীদারকে অর্ধেক দিয়ে মোটামুটি ৩০ মণের মতো ধান নিজের ঘরে তোলেন, যা দিয়ে দুই মেয়ে ও এক ছেলেসহ পাঁচজনের সংসার চলে না।

আলী আহমদ বলেন, ‘লবণাক্ত জলের কারণে অন্য ফসল ফলানো যায় না। গত বছর ঢলের পানিতে ফসল নষ্ট হয়ে যায়। এবারো আমন ধানের জালা (বীজতলা) নষ্ট হয়ে গেছে। পরিবার নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানোর অবস্থা নেই আমাদের। কয়েক দিন আগে সরকারের পক্ষ থেকে দুই কেজি আলু, আধা কেজি মসুর ডাল দিয়েছে। কোনো কোনো পরিবারকে ১০-১৫ কেজি চালও দেয়া হয়। আমরা সাগরে কখনো কখনো মাছ ধরতে যাই ২০০-৩০০ টাকা মজুরিতে। এরকম দুঃখ-কষ্টের মধ্যে সংসার চালাতে হচ্ছে।’

একই উপজেলার কৃষক নুরুল আবছার বলেন, পাঁচ ছেলেমেয়েসহ সাতজনের সংসার তার। বছরে ৯০-১০০ মণের মতো ধান ওঠে চাষ করে। ভাগে পড়ে ৪৫-৫০ মণের মতো ধান। যা বিক্রি করে শ্রমিকসহ অন্যান্য ব্যয়ও নির্বাহ করতে হয়। নিজের পরিবারের ভরণপোষণ করতে হয়। তাই চাষাবাদের সঙ্গে অন্য কোনো কাজও করতে হয়। শুধু তারা নন, সাগর উপকূলের বেশিরভাগ মানুষেরই একই অবস্থা।

তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে ধানের বীজ ও কিছু সার দেয়া হয়। আমরা নিজেরা ফসল ফলাই, কিন্তু তার সুফল ভোগ করতে পারি না। সাগর উপকূলের মানুষের এ অবস্থা অনেক বছরের।

কৃষি এবং পরিবেশের সমালোচনামূলক সম্পর্ক মোকাবিলায় কাজ করছে গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (জিইএফ) এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। ভবিষ্যতের জন্য বিশ্বের প্রধান উদ্দেশ্য কী হতে পারে, সে সম্পর্কে এফএও-র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য খাদ্য উৎপাদন এবং কৃষিকে আলোচনার একটি বড় অংশ হতে হবে।

আরও পড়ুন <> ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে সমন জারি

প্রতিবেদনে বেশকিছু পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে, নীতি এবং কর্মের মাধ্যমে খামারের বাইরে কর্মসংস্থান বাড়ানো, খাদ্য ও কৃষিতে বিনিয়োগ করা, সম্পদ ব্যবহারের দক্ষতা সর্বাধিক করা, খাদ্যের ক্ষতি এবং বর্জ্য কমানো, বর্জ্যকে পুনর্ব্যবহারের জন্য রূপান্তর করা এবং মূল প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে যাতে খাদ্য ব্যবস্থাকে উন্নত করে সে বিষয়ে বিশ্ব মঞ্চে আরও মনোযোগ দেয়া।

কৃষিজীব-বৈচিত্র্যের ৭৫ শতাংশ ক্ষতির জন্য দায়ী খাদ্য উৎপাদন। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের নয় দশমিক সাত বিলিয়ন জনসংখ্যাকে খাওয়ানোর জন্য আরও ৫০ শতাংশ বেশি খাদ্যের প্রয়োজন হবে। তখন এমন জনগোষ্ঠী হবে আরও নগরায়ণকেন্দ্রিক এবং তার খাদ্য পছন্দের হবে চাহিদাযুক্ত। বিশ্বের জনগোষ্ঠী এমনিতেই যথেষ্ট চাপে রয়েছে। কেননা ৬৯১ থেকে ৭৮৩ মিলিয়ন মানুষ বর্তমানে ক্ষুধার্ত স্তরভুক্ত।

এফএওর প্রতিবেদন সম্পর্কে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আইনুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ফসল কম উৎপাদন হচ্ছে। আবার উৎপাদিত ফসলের দামও কৃষক পাচ্ছে না। তারা ফসল ফলিয়ে যতটুকু পায় তাও আবার ঋণ শোধের জন্য বিক্রি করে দিচ্ছে। সেসব কিনে সিন্ডিকেট করা হচ্ছে। ১০ কেজি ধানও কৃষকের কাছ থেকে কীভাবে নিয়ে যাওয়া যায়, সেই ফন্দির পথ তৈরি করছে সিন্ডিকেট। এতে ফসল ফলিয়েও গ্রামের মানুষ দারিদ্র্যের কোপানল থেকে বের হতে পারছে না।

তিনি বলেন, অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের নোবেল জয়ের মূলমন্ত্র ছিল, উৎপাদন বেশি হলেও সঠিক বণ্টনের অভাবে দরিদ্রতা বিরাজ করছে। অথচ কল্যাণ রাষ্ট্রের কাজই হচ্ছে জনগণের দায়িত্ব নেয়া। আমরা চাই গ্রামের প্রান্তিক মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বৃদ্ধিসহ স্থায়ী কিছু কার্যক্রম করা হবে। কৃষকরা যেন ফসলের ন্যায্যমূল্য পায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

ড. আইনুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে নিত্যপণ্যের দরের ঊর্ধ্বগতি আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। নিম্ন আয়ের মানুষের পুষ্টির অন্যতম উৎস হচ্ছে ডিম ও মসুর ডাল। অথচ এসব বর্তমানে নাগালের বাইরে। এতে পুষ্টিহীন জাতি তৈরি হচ্ছে। এই পরিস্থিতি দেশকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ভয় হয়, আগামী দিনের জনগোষ্ঠী পুষ্টিহীন, মেধাহীন হয়ে উঠবে।

আপন দেশ/আরএ

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

জনপ্রিয়