Apan Desh | আপন দেশ

ডেসকো এখন বড়কর্তাদের স্বজন পুনর্বাসন কেন্দ্র, জাল সনদেও সমস্যা নেই!

আফজাল বারী

প্রকাশিত: ২০:১৬, ১৩ নভেম্বর ২০২৩

আপডেট: ০১:১৯, ১৪ নভেম্বর ২০২৩

ডেসকো এখন বড়কর্তাদের স্বজন পুনর্বাসন কেন্দ্র, জাল সনদেও সমস্যা নেই!

ছবি: আপন দেশ

ঘটনাস্থল ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানী লিমিটেড (ডেসকো)। অনিয়ম-দুর্নীতির শীতলগর্ভে রূপ নিয়েছে। সংস্থাটি এখন উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সন্তান, জামাতা, ভাই-বোন, ভগ্নিপতি, ভাতিজাসহ বেকার স্বজনদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

চাকরির বয়সসীমা লঙ্ঘন, জাল সনদ, প্রত্যয়নপত্র কোন দুর্নীতি নেই ডেসকোতে। এখানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা মিলেমিশে নিয়োগ বাণিজ্যে লিপ্ত। চাকরিবিধিমালা শুধুই কাগুজে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশও এখানে কাজে আসছে না। 

অনিয়মের কথা জিজ্ঞাসা করতেই মুচকি হাসি দিয়ে ডেসকোর একাধিক লোক বলেন, ‘সাংবাদিক ভাই আমাদের ডেসকো এখন পুনর্বাসন কেন্দ্র, স্বজন কোটা সৃষ্টি হয়েছে, টাকা উড়ছে টেবিলে টেবিলে, আপনি আর কি লিখবেন? লিখলেইবা কি, কে দেখবে, কে ব্যবস্থা নেবে...’।

অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানিতে (ডেসকো) চলছে রমরমা নিয়োগ বাণিজ্য। এ নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িত রয়েছেন খোদ সংস্থাটিরই উর্ধ্বতন কিছু কর্মকর্তা। চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে এবং প্রভাব খাটিয়ে কর্মকর্তারা নিয়োগ দিচ্ছেন তাদের আত্মীয়-স্বজনদের। হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।

এরই ধারাবাহিকতায় ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী মো. কাওসার আমীর আলীর পুত্র এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রনালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের জনৈক সচিবের নিকট আত্মীয়কে সম্প্রতি সহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এমনকি প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে নিয়োগের যে সংখ্যা উল্লেখ রয়েছে তার প্রায় দ্বিগুন প্রার্থীকে পদায়ন করা হয়েছে। এর আগেও ২০১১ সালে তৎকালীন কর্মকর্তারা একই পদ্ধতিতে নিয়ম ভেঙে নিজেদের স্বজন নিয়োগ দেন।

ডেসকো’র চাকরিবিধির ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের কোনো নিকট আত্মীয়কে নিয়োগ দেয়া যাবে না। কে শোনে কার কথা। চাকরিবিধির তোয়াক্কা না করে সংস্থাটিতে অনেক কর্মকর্তাই প্রভাব খাটিয়ে নিজ সন্তান, মেয়ে জামাতা, ভাই, বোন, ভগ্নিপতি, ভাতিজাসহ নিকট আত্মীয়কে নিয়োগ দিচ্ছেন।

আরও পড়ুন<<>> কার তদন্ত কে করে? পেট্রোবাংলায় পিতার ক্ষমতায় জাল সনদে পুত্রদের চাকরি

এদিকে ১২ মার্চ প্রকাশিত ডেসকো’র এক (ম্যামো নম্বর: ২৭.২৪.০০০০.০১৬.১১.০০১.২৩.৯২২) নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ৬টি দফার ১ম টিতে ৭ম গ্রেডে ৮ জন সহকারী প্রকৌশলী নিয়োগের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু চাকরি প্রত্যাশী প্রার্থীরদের পদায়নে অফিস আদেশের তালিকায় ১৪ জন সহকারী প্রকৌশলীর (সিএস/সিএসই/ইসিই) নাম দেখা যায়। যা নিয়ে তোলপাড় চলছে। 

বিষয়টি নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ম্যানেজেবল হলে সংস্থাগুলো নিয়োগ পরীক্ষা নিজেরাই সম্পন্ন করে। যখন প্রার্থীর সংখ্যা বেশি হয় তখন তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে এগুলো করা হয়। আর যখন কম হয় তখন সংস্থা নিজেরাই এসব কার্যক্রম করে থাকেন। সরকারী সিদ্ধান্ত হয়েছে এখন পারত পক্ষে কেউ তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পরীক্ষা নিচ্ছে না।

বিজ্ঞপ্তিতে ৮ জন সহকারী প্রকৌশলী নিয়োগের কথা উল্লেখ করে তাতে ১৪ জনের উন্নতি দেয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সার্কুলারে হয়তো বলা থাকে সংখ্যা কম-বেশি হতে পারে। যোগ্য প্রার্থী পাওয়া গেলে এমন বিবেচনা করা হয়।

ডেসকো পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক মো. রোকন-উল-হাসান এ ব্যাপারে বলেন, ডেসকো’র বোর্ড মিটিং-এ এসব বিষয় আলোচনা উঠানো হয় না। যার ফলে এ বিষয় কিছু জানি না। বিজ্ঞপ্তিতে ৮জন সহকারী প্রকৌশলী নিয়োগের উল্লেখ থাকলেও পদায়ন করা হয়েছে ১৪ জনেরও বেশি এটা কতটুকু বিধিসম্মত এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এসব বিষয় ডেসকো’র এমডি ভালো বলতে পারবেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডেসকো’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী মো. কাওসার আমীর আলীর ছেলেকে এবং বিদ্যুৎ বিভাগের একজন সচিবের নিকট আত্মীয়কে চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে সহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ডেসকো এমডি’র ছেলে রাইদ আমিরকে (আইডি নম্বর: ২৪৮৭) আইসিটি বিভাগে এবং বিদ্যুৎ সচিবের নিকট আত্মীয় মো. ইমরান হোসেনকে (আইডি নম্বর: ২৩৬৪) প্রকল্প পরিচালক (ঢাকা পওয়ার সিস্টেম এক্সপানশন এন্ড স্টোদেনিং প্রজেক্ট ইন ডেসকো এরিয়া) এর দফতরে পদায়ন করা হয়েছে।

সংস্থাটিতে অতীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এমআইএসটি কিংবা বুয়েট দ্বারা নিয়োগ পরীক্ষা নেয়া হতো। গত এক যুগের চলমান তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পরীক্ষা নিচ্ছে না ডেসকো কর্তৃপক্ষ।

 আরও জানুন <<>> বেস্ট হোল্ডিংসের ভয়ঙ্কর জালিয়াতি! শেয়ার বাজারে আসছে

ডেসকোর একজন পরিচালক (নির্বাহী) জানান, বেশ কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন ধরনের ইন্টারভিউ কিংবা পরীক্ষা ডেসকোর স্বচ্ছতা বজায় রাখতে  তৃতীয় পক্ষ বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এমআইএসটি বা বুয়েটের মাধ্যমে নেয়া হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে অদৃশ্য কারণে ১২ মার্চ প্রকাশিত (ম্যামো নম্বর: ২৭.২৪.০০০০.০১৬.১১.০০১.২৩.৯২২) নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পরীক্ষা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে নেয়া হলো না তা প্রশ্নযোগ্য। এ নিয়োগে আবার বিদ্যুৎ সচিবের আত্মীয় ও ডেসকো এমডির ছেলের চাকরি হওয়ায় এই বিতর্কে আগুনে ঘি ঢালার মতো হয়েছে। সবকিছু নিয়মানুযায়ী হলেও পরীক্ষা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে না নেয়ায় সন্দেহটা হওয়া স্বাভাবিকই। 

ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী মো. কাওসার আমীর আলীকে দফায় দফায় ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। যেকারণে তার বক্তব্য যুক্ত করা সম্ভব হয়নি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের একই পদ্ধতিতে ২০১১ সালের শেষ দিকে ডেসকো’র মিরপুর জোনের তৎকালীন উপ-মহাব্যবস্থাপক এবং বর্তমানে নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) জাকির হোসেনের আপন ভাইকে গুলশান বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের অফিস সহকারী পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ওই সময় তৎকালীন ব্যবস্থাপক (বর্তমানে কানাডা প্রবাসী) নজিবুল আলম খন্দকারের ভগ্নিপতি দবির উদ্দিনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল উত্তরার সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে। এই কর্মকর্তার শ্যালক ইকবাল হোসেনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল টঙ্গীর সহকারী ব্যবস্থাপক পদে। এছাড়া তৎকালীন জেনারেল ম্যানেজার (প্রকল্প) প্রকৌশলী নূর মোহাম্মদের ভাতিজি জামাতা জয়নাল আহমেদকে স্টোর কিপার, ভাতিজা হারুণকে এমএলএসএস পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল।

ডেসকো’র ডেভেলপমেন্ট এন্ড প্রজেক্টের প্রধান প্রকৌশলী ও তৎকালীন উপ-মহাব্যবস্থাপক (সংগ্রহ) শরিফুল ইসলামের ভাই আরিফুল ইসলামকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল পল্লবীর সহকারী ব্যবস্থাপক পদে। এই শরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে মালামাল কেনাকাটায় বিস্তর দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আপন দেশের কাছে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শরিফুল ইসলাম।

আরও পড়ুন<<>> লুট হচ্ছে ডাক বিভাগের অর্থ, ধরা পড়লেও বিচার হয় না

তৎকালীন পরিচালক (সংগ্রহ) মোস্তফা কামালের আপন ভাই ও ভাতিজাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে ডেসকো সূত্রে জানা গেছে। সূত্রটি জানায়, এরকম অন্তহীন অনিয়ম রয়েছে নিয়োগ প্রক্রিয়ায়। তৎকালীন সময়ে সহকারী ব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ পেতে একজন আবেদন করলে তাকে নিয়োগ দেয়া হয় উপ-ব্যবস্থাপক পদে। এরকম কারবারের প্রমাণ পেয়েছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

এদিকে ডেসকো’র এক বোর্ড সদস্যের শ্যালক সাদেক মো. টিপুকে নিয়োগ দেয়া হয় চাকরিবিধি ভঙ্গ করে। কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ছাড়াই সাদেক মো. টিপুকে ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে ডেপুটি ম্যানেজার পদে নিয়োগ দেয়া হয়। বেতন নির্ধারণ করা হয় ৫৬ হাজার টাকা। ওই পদে নিয়োগের বয়সসীমা ৩৫ বছর। কিন্তু নিয়োগকালে সাদেক মো. টিপুর বয়স ৪১ বছর। এছাড়া চাকরি নেয়ার জন্য গ্রামীণ ফোনের ম্যানেজার (এইচআইডি) পদে চাকরির ভূয়া অভিজ্ঞতা সনদ জমা দেন তিনি।

তৎকালীন সংসদীয় কমিটির তদন্তে অভিজ্ঞতার সনদটি ভূয়া বলে প্রমাণিত হয়েছে। তৎকালীন সংসদীয় কমিটির এক সদস্য তার অভিজ্ঞতার সনদ জাল প্রমাণিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

জানা গেছে, ২০১১ সালের ৯ মে  বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের দুর্নীতি তদন্তের জন্য ৬ নম্বর সাব-কমিটি করা হয়। এতে আহ্বায়ক করা হয় ওমর ফারুক চৌধুরীকে। সদস্য করা হয় ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস (বর্তমান ঢাকা দক্ষিন সিটি মেয়র) ও প্রয়াত ইসরাফিল আলম এমপিকে।

আপন দেশ/এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়