Apan Desh | আপন দেশ

পদ্মা সেতুর সুফল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতে

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০৯:২৭, ২৫ জুন ২০২৩

আপডেট: ১১:০৬, ২৫ জুন ২০২৩

পদ্মা সেতুর সুফল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতে

ফাইল ছবি

পদ্মা সেতু একটি স্বপ্ন। বিশ্ব দরবারে আমাদের মাথা উচুঁ করে দাঁড়ানোর সাহস। পদ্মা সেতু দেশের গর্ব। এ সেতু সমৃদ্ধ করছে দেশের অর্থনীতিকে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের জীবনধারা বদলে দিয়েছে এই সেতু।

রাজধানী থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় একবছর আগেও যেতে পার হতে হতো ফেরি। দুই ঈদে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে যানজট লেগেই থাকতো, এতে প্রচণ্ড ভোগান্তি পোহাতে হতো জনসাধারণকে। বিপদ ছিল শীতেও, ঘন কুয়াশায় সারারাত বন্ধ থাকতো ফেরি। এ ছাড়া বর্ষায় ছিল লঞ্চ দুর্ঘটনার শঙ্কা। সব শঙ্কা আর দুর্ঘটনার পথ মাড়িয়ে পদ্মা সেতু চালুর পর বৃহত্তর যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া, বরিশাল আর ফরিদপুরের ২১ জেলার মানুষ ১ থেকে ৪ ঘণ্টার পৌঁছে যাচ্ছেন রাজধানীর বুকে।

২০২২ সালের ২৫ জুন উদ্বোধন করা হয় পদ্মা সেতু। এই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে মাওয়া প্রান্ত দিয়ে টোল দিয়ে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতু পার হন এবং এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণের ২১টি জেলার সঙ্গে সড়কপথে যোগাযোগ উন্মোচিত হয়। সেতুটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয় পরের দিন ২৬ জুন। সেই হিসাবে রোববার (২৫ জুন) পদ্মা সেতুর এক বছর পূর্ণ হলো।

পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত। দুই স্তর বিশিষ্ট ইস্পাত ও কংক্রিট নির্মিত এই সেতুর ওপরের স্তরে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরে একটি একক রেলপথ রয়েছে। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় তৈরি সেতুটি ৪১টি স্প্যান নিয়ে গঠিত, প্রতিটি স্প্যান লম্বায় ১৫০ দশমিক ১২ মিটার বা ৪৯২ দশমিক পাঁচ ফুট এবং চওড়ায় ২২ দশমিক পাঁচ মিটার বা ৭৪ ফুট। সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার বা তিন দশমিক ৮২ মাইল। এটি বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু। ১২০ মিটার বা ৩৯০ ফুট গভীরতাযুক্ত বিশ্বের গভীরতম পাইলের সেতু এটি। সেতুটি চালু হওয়ার পর বাংলাদেশের জিডিপি এক দশমিক দুই শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাপান থেকে আগত জরিপ বিশেষজ্ঞদের একটি দল পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) কাছে ঢাকা-ফরিদপুর সড়ক নির্মাণের জন্য একটি সম্ভাব্যতা প্রতিবেদন জমা দেয়। সড়কটি নির্মাণের অংশ হিসেবে তারা পদ্মা নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পদ্মা নদীর উপর সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার সুযোগ পাননি।

জানা গেছে, কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে অবস্থান করছে দেশের শীর্ষ অবকাঠামো পদ্মা সেতু। সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের দিন থেকে দেশের সব গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি সেতু এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন র‌্যাব, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা। অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা পুরো সেতু এলাকায় সেনা সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছেন। সেতুর ওপরে এবং নিচে উভয় স্থানেই এখন নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা। সেতুর ওপরে ও নিচে, নদী এবং এর আশপাশের সড়ক, সড়কের বাইরেও বসানো হয়েছে ক্লোজ সার্কিট (সিসি টিভি) ক্যামেরা। সরকারের একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ বর্তমান সরকারের একটি বড় সাফল্য।

ফেরি সংকটে অথবা আবহাওয়াজনিত জটিলতা, অথবা যানজটে পড়ে পদ্মা নদী পার হতে না পেরে তরমুজ বোঝাই শতাধিক গাড়ি আটকে পড়ার কাহিনী কারও অজানা নয়। শুধু তরমুজই নয়, মাদারীপুর থেকে আনা কলাই শাক, শরীয়তপুর থেকে আনা নানা ধরনের সবজি, ফরিদপুর থেকে আনা খেজুরের রস, বরিশাল ও পটুয়াখালী থেকে আনা তরমুজ, বাঙ্গি, আমড়া ও মুরগির ডিমবাহী ট্রাকও পদ্মার পাড়ে আটকে থাকতো, ঘণ্টা পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন। ফলে এসব পচনশীল পণ্য গরমে নষ্ট হয়ে যেতো। যা ফেলে দিতে বাধ্য হতেন ব্যবসায়ীরা। আবার কেউ কেউ এসব পণ্য কম দামে বিক্রি করে দিয়ে লোকসানের পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে বাড়ি ফিরতেন খালি হাতে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এমন পরিস্থিতির অবসান হয়েছে বলে স্বস্তিতে আছেন পদ্মার ওপারের কৃষিজীবী মানুষের।

তারা জানান, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর আগে সেই অবস্থা আর নেই। ওপারের ২১ জেলার কৃষিতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বাড়ছে চাষাবাদ। বাড়ছে কৃষিনির্ভর খাদ্যসামগ্রীর উৎপাদন। জমির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী হচ্ছে সেসব কৃষিপণ্যের চাষাবাদ। উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারজাত সহজ হয়েছে। পরিবহন ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় ক্রেতাও মিলছে আগের তুলনায় বেশি। চুক্তি ভঙ্গ হওয়ার সুযোগ নেই। ফলে কৃষিতে ব্যাপক পরিবর্তনে সাফল্য দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত এক বছরে পদ্মা সেতুতে টোল আদায় হয়েছে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার বেশি। সেতু বিভাগের একটি দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। ওই সূত্র জানায়, ২০২২ সালের ২৬ জুন ভোর ৬টা থেকে শুরু হওয়া পদ্মা সেতুতে চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত নয় মাসে ৬০৩ কোটি টাকা টোল আদায় হয়েছে। এর পরের (এপ্রিল-মে ও জুনের প্রথম ২০ দিন) তিন মাসে টোল আদায়ের পরিমাণ প্রায় ২০০ কোটি টাকা। 

অপরদিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ এ পর্যন্ত চার কিস্তিতে মোট ঋণের ৬৩২ কোটি ৯০ লাখ ৯৭ হাজার টাকা পরিশোধ করেছে। সূত্র আরও জানিয়েছে, সেতু কর্তৃপক্ষ আলাদাভাবে ঋণের প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তির মোট ৩১৬ কোটি ৯০ লাখ ৯৭ হাজার টাকা এবং তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তির ৩১৬ কোটি টাকার চেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দিয়েছে। প্রথম দফায় দুই কিস্তির টাকা পরিশোধ করা হয়েছে চলতি বছরের ৫ এপ্রিল। তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তির অর্থের চেক হস্তান্তর করা হয়েছে গত ১৯ জুন। এ পর্যন্ত পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থ বিভাগ থেকে নেয়া ঋণের মোট চার কিস্তির অর্থ পরিশোধ করেছে সেতু বিভাগ।

ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে, দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা কোরবানির পশুবাহী ট্রাকগুলো সেতু পার হয়ে ঢাকার দিকে ছুটছে। পশু নিয়ে হাটে যেতে আগের মতো কোনো দুশ্চিন্তা বা উৎকণ্ঠা দেখা যায়নি ব্যবসায়ীদের মধ্যে। কারণ, দিন-রাত যেকোনো সময়েই পদ্মা পার হচ্ছেন তারা।

পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তের টোল প্লাজা সূত্রে জানা গেছে, কোরবানির পশুবাহী ট্রাক পদ্মা সেতু পার হচ্ছে, যার সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছেই। সংখ্যায় বেশি হলেও টোল প্লাজায় কোনো যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে না।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, পদ্মায় সেতু চালু হওয়ার পর কোরবানির পশু নিয়ে ঢাকায় যেতে কোনো ভোগান্তি নেই। কিন্তু সেতু চালুর আগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরিতে ওঠার অপেক্ষায় ঘাটে বসে থাকতে হতো। কখনো ফেরি পার হতে না পেরে ফিরে যেতে হতো। দীর্ঘ সময় ঘাটে আটকে থেকে গরমে গরু মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে অনেক।

প্রসঙ্গত, পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচ করা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। এসব খরচের মধ্যে রয়েছে— সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি। বাংলাদেশের অর্থ বিভাগের সঙ্গে সেতু বিভাগের চুক্তি অনুযায়ী— সেতু নির্মাণে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দেয় সরকার। এক শতাংশ সুদ হারে ৩৫ বছরের মধ্যে সেটি পরিশোধ করবে সেতু কর্তৃপক্ষ। ২০০৫ সালে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য প্রাথমিক প্রাক্কলন ধরা হয়েছিল ১২ হাজার কোটি টাকা। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় পৃথিবীর অন্যান্য তুলনীয় সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের নিরিখে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সর্বমোট নির্মাণ ব্যয় ১০ হাজার কোটি টাকায় সীমিত রাখার পরামর্শ প্রদান করেন। ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একনেকের সভায় পদ্মা সেতুর চূড়ান্ত প্রাক্কলন ১০ হাজার ১৬১ কোটি অনুমোদন করা হয়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে প্রাক্কলন ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ অনুমোদিত প্রাক্কলনের পরিমাণ ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা, যা মূল প্রাক্কলনের তুলনায় ২০ হাজার ৩২ কোটি টাকা বেশি। বলা হয়, বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়াই প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার মূল কারণ।

তথ্য বলছে, মার্কিন ডলারের হিসাবে ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সড়ক-রেল সেতুর নির্মাণ ব্যয় ১১ বছরে এক দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে তিন দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। চীনের ছয় দশমিক চার কিলোমিটার দীর্ঘ উফেনসাং ইয়াংজি সড়ক-রেল সেতু ২০২০ সালের ডিসেম্বরে চালু করা হয়। পদ্মা সেতুর সঙ্গে তুলনীয় এই সেতু নির্মাণে সময় লেগেছে চার বছর এবং ব্যয় হয়েছে এক দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলার; যা পদ্মা সেতুর এক-তৃতীয়াংশের তুলনায়ও কম।

পদ্মা বহুমুখী সেতুর মূল সেতুর জন্য চীনের মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনকে নিযুক্ত করা হয়। চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন নদী শাসনের কাজ করে। দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ করে বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেড।

আপন দেশ/আরএ

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়