Apan Desh | আপন দেশ

শীতে জবুথবু দেশ, সূর্যের দেখা নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১০:০০, ১৪ জানুয়ারি ২০২৪

আপডেট: ১৩:১৮, ১৪ জানুয়ারি ২০২৪

শীতে জবুথবু দেশ, সূর্যের দেখা নেই

ছবি : সংগৃহীত

প্রতিদিনই নামছে তাপমাত্রা। বাড়ছে হাঁড় কাঁপানো শীতের তীব্রতা। শনিবার (১৩ জানুয়ারি) ছিল মৌসুমের শীতলতম দিন। মৃদু শৈত্যপ্রবাহ ১৩টি জেলায় ছড়িয়ে পড়লেও সারা দেশেই হিমেল হাওয়া আর ভারি কুয়াশায় কনকনে শীত জেঁকে বসেছে। আগামীকাল সোমবার (১৫ জানুয়ারি) পৌষ শেষ হতে যাচ্ছে। 

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে সূর্যের মুখ দেখা যায়নি শনিবার। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে গত চারদিন সূর্য অদৃশ্য।

শীতে অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। শিশু ও বৃদ্ধরা ঠাণ্ডাজনিত নানা রোগ নিয়ে ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালে।

ঘন কুয়াশার কারণে সড়ক, নৌ ও আকাশপথে চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে কৃষির। আবহাওয়া অফিস বলছে, শীতের মধ্যেই বৃষ্টির সম্ভাবনাও রয়েছে। ‘হাড় কাঁপানো’ এমন শীত ঢাকাবাসী দেখেনি অনেক দিন।

দিনাজপুর আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার সূত্রে জানা যায়, রোববার (১৪ জানুয়ারি) জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে আট দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা সারাদেশের মধ্যেও সর্বনিম্ন। বাতাসের আদ্রতা ৯০ শতাংশ ও গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় দুই কিলোমিটার।

এর আগে শনিবার এই জেলার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল আট দশমিক আট ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ সময় বাতাসের আদ্রতা ৯৭ শতাংশ এবং গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় চার কিলোমিটার ছিল।

গত কয়েকদিন ধরেই দিনাজপুর জেলায় নিম্নমুখী তাপমাত্রা বিরাজ করছে। এর মধ্যে গত বুধবার জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১১ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, বৃহস্পতিবার ১১ দশমিক শূন্য ডিগ্রি এবং শুক্রবার সর্বনিম্ন ১০ দশমিক শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।

শনিবার নওগাঁর বদলগাছীতে আট দশমিক নয় ডিগ্রি, সৈয়দপুরে নয়, রাজশাহীতে নয় দশমিক ছয় এবং পাবনার ঈশ্বরদীতে নয় দশমিক সাত ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। আর দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল টেকনাফে ২৬ দশমিক চার ডিগ্রি সেলসিয়াস। শনিবার ঢাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৩ দশমিক সাত ডিগ্রি, আর সর্বোচ্চ ১৮ দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস। 

আরও পড়ুন <> নতুন মন্ত্রীদের প্রথম অফিস আজ

আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, দিনাজপুর, রাজশাহী, ঈশ্বরদী, বদলগাছী, সৈয়দপুর, তেঁতুলিয়া, চুয়াডাঙ্গা, কুমারখালী ও রংপুর বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। শৈত্যপ্রবাহের কবলে রয়েছে আট জেলা। এমন অবস্থা আরও কয়েক দিন থাকতে পারে। মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত কুয়াশা থাকতে পারে। 

আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক বলেন, ‘অনেক জেলায় শৈত্যপ্রবাহ না থাকলেও প্রচণ্ড শীতে সারাদেশে জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। আরও দিন দুয়েক কুয়াশা থাকবে। এর পর আস্তে আস্তে তাপমাত্রা বাড়বে।’

শীতের তীব্রতা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ‘সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য কমে এলে শীতের তীব্রতা বাড়তে শুরু করে। যেমন ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১৮ দশমিক পাঁচ ও সর্বনিম্ন ১৩ দশমিক সাত ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ, তাপমাত্রা বাড়া ও কমার ব্যবধান মাত্র পাঁচ ডিগ্রি। এ কারণে শীতের তীব্রতা বেশি অনুভূত হচ্ছে। এই পার্থক্য যখন ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে আসে, তখনই ঠাণ্ডা বাড়তে থাকে। আর পার্থক্য পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে এলে ঠাণ্ডা প্রকট থেকে প্রকটতর হয়। যাকে বলে, হাড় কাঁপানো শীত। ঢাকার অবস্থা এখন সে রকমই।’

তিনি বলেন, ‘জানুয়ারির পুরোটা শীতের অনুভূতি থাকবে। তবে ১৬ থেকে ১৮ জানুয়ারির মধ্যে দেশজুড়ে অস্থায়ী দমকা হাওয়া ও ঝড়ো বাতাসসহ বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। ২০ জানুয়ারির পর আবার মৃদু বা মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ শুরু হতে পারে।’

ঘন কুয়াশার কারণে শনিবার নীলফামারীর সৈয়দপুর বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ ছিল ছয় ঘণ্টা। এতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, ইউএস-বাংলা ও নভোএয়ারের সাতটি ফ্লাইটের ঢাকাগামী চার শতাধিক যাত্রী দুর্ভোগে পড়েন। ঘন কুয়াশার জন্য ভারতের মুম্বাই থেকে আসামের গৌহাটিগামী ইনডিগো এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট এদিন ঢাকায় জরুরি অবতরণ করে। পরে অবশ্য সেটি গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। 

আরও পড়ুন <> দিনাজপুরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা, শিশির পড়ছে বৃষ্টিরূপে

গ্রামাঞ্চলে তীব্র শীতে কষ্ট পাচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র না থাকায় অনেকেই আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। আবার কেউ কেউ স্বল্পমূল্যে শীতবস্ত্র কিনতে পুরোনো পোশাকের দোকানে ভিড় জমাচ্ছেন।

দিনাজপুরে কুয়াশার দাপটে যেন সূর্য উধাও। সকাল ১০টা পর্যন্ত যানবাহন চলেছে হেডলাইট জ্বালিয়ে। এই শীতে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষ। সদর উপজেলার শেখপুরা এলাকার কৃষক সিরাজুল ইসলাম জানান, শীত ও কুয়াশায় তাঁর ক্ষেতের আলুগাছ মরে যাচ্ছে। কৃষক পরিমল সরকার বলেন, ‘তীব্র শীতের কারণে বোরোর বীজতলায় চারা গজাচ্ছে না। আর যেগুলো গজিয়েছে, সেগুলোও লাল হয়ে মরে যাচ্ছে।’ সদর উপজেলার অটোরিকশাচালক ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘সকালে অটো নিয়ে বের হয়েছি। কিন্তু রাস্তায় লোকজন কম। দুপুর হতে না হতেই আবার কুয়াশা নামে, সঙ্গে ঠাণ্ডা বাতাস।’

শীতে কাহিল রংপুরের মানুষ। দিনরাত থাকছে কনকনে ঠাণ্ডা। রাতভর থাকছে কুয়াশা। দিনেও যান চলাচল করছে হেডলাইট জ্বালিয়ে। এখানেও শ্রমজীবীরা পড়েছেন চরম দুর্ভোগে। সন্ধ্যার পর হাটবাজার, রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। জরুরি প্রয়োজন কিংবা জীবিকার তাগিদ ছাড়া কেউ ঘর থেকে তেমন বের হচ্ছেন না। আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে খেটে খাওয়া মানুষ। রংপুরে আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধের সংখ্যাও বাড়ছে। শনিবার রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ৪০ জনকে চিকিৎসা নিতে দেখা যায়। তাদের বেশির ভাগই খড়কুটো জ্বালিয়ে উষ্ণতা নিতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হন।

পঞ্চগড়েও কনকনে শীতে দুর্ভোগে পড়েছেন কৃষি শ্রমিক, চা শ্রমিক ও দিনমজুররা। কুড়িগ্রামের রাজারহাটে ঘন কুয়াশা ও তীব্র শীতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। এখানে বাড়ছে শীতের তীব্রতা। বিপাকে পড়েছেন দিনমজুর, অতিদরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষ। সদর উপজেলার কাঁঠালবাড়ীর সারডোব গ্রামের মহিরন বেওয়া (৬৮) বলেন, ‘হামরা গরিব মানুষ, চরের মাঝত থাকি, কাইও আইসে না।’ এখন পর্যন্ত একটি কম্বলও পাননি বলে জানান তিনি। এই গ্রামের কৃষক নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘তিন-চার দিন থাকি গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মতো শীত পড়ছে, আমনের বীজতলা প্লাস্টিক দিয়ে ঢাকি রাখছি যাতে নষ্ট না হয়।’

আরও পড়ুন <> তীব্র শীতে বিপর্যস্ত জনজীবন, থাকবে আরও দু-তিন দিন

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মুশফিকুল আলম হালিম বলেন, ‘নির্বাচনের আগে সরকারিভাবে বরাদ্দ ৪ হাজার কম্বল বিভিন্ন স্থানে বিতরণ করা হয়েছে। এই মুহূর্তে কম্বল মজুত নেই।’

কনকনে ঠাণ্ডা আর ঘন কুয়াশায় লালমনিরহাটের মানুষের জীবনে নেমে এসেছে দুর্ভোগ। বিশেষ করে নদীতীরবর্তী ও চরাঞ্চলের লোকালয়ের মানুষ ঠাণ্ডায় কাঁপছে।

ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘জেলায় শীতের তীব্রতা অনেক বেশি। সরকার থেকে পাওয়া ৩৬ হাজার কম্বল বিতরণ করা হচ্ছে। আরও কম্বলের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বার্তা পাঠানো হয়েছে।’

শীতের তীব্রতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যাপক হারে বাড়ছে শীতজনিত রোগ। সর্দি-কাশি, জ্বর, নিউমোনিয়া, টনসিলাইটিস, ব্রঙ্কিওলাইটিস, সাইনোসাইটিস, অ্যাজমা, চর্মরোগ, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়াসহ শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু থেকে বয়স্ক সব বয়সের মানুষ। সবচেয়ে  বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে যারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। প্রতিটি হাসপাতালে শীতজনিত রোগীর চাপ বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, বয়স্ক ও শিশুদের শীতে প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়া উচিত নয়। শিশুদের শীতের পোশাক পরিধান করাতে হবে। সামান্য অবহেলার কারণে শিশুদের মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে বিশেষজ্ঞরা বলেন, গ্রামাঞ্চলে অনেকে শীতের জন্য গোসল করে না। নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকে। এসব কারণে এ রোগের সংক্রমণ বেশি হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এমিরেটস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, শীতকালে বয়স্ক লোকদের এজমা, গলায় ব্যর্থ, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, টনসিল ও গিরায় গিরায় ব্যথা হয়। শীতে বৃদ্ধ ও শিশুদের প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না যাওয়াই ভালো। জরুরি প্রয়োজন হলে শিশুদের শীত নিবারণের কাপড় পড়ে বাইরে যাওয়া উচিত। শীতজনিত রোগে বেশি শারীরিক অসুস্থ বাড়তে থাকলে শিশু চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।  

আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, আজ রোববার সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা সামান্য বাড়লেও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। আগামীকাল সোমবার দিন ও রাতের তাপমাত্রা দুটিই কিছুটা বাড়তে পারে। মঙ্গলবার আবার কিছুটা কমতে পারে দিনের তাপমাত্রা।

আগামী কিছুদিন মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারা দেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। কোথাও কোথাও কুয়াশা দুপুর পর্যন্ত থাকতে পারে। কুয়াশার কারণে বিমান চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন এবং সড়ক যোগাযোগ সাময়িকভাবে ব্যাহত হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।

আপন দেশ/এমআর

মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

জনপ্রিয়