পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসা বিজিপি সদস্যরা, ছবি সংগৃহীত
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে চলছে তুমুল লড়াই। জান্তা সরকারের সঙ্গে বিদ্রোহী সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মির রক্তক্ষয়ী এ সংঘর্ষে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সীমান্ত এলাকায়।
মর্টার শেল ও বিরামহীন গোলাগুলির শব্দে ঘুম নেই সীমান্তের কয়েক হাজার বাসিন্দার। তুমব্রু কোনারপাড়া, ভাজাবনিয়া ও বাইশফাঁড়ি সীমান্তে শত শত পরিবার যে যেভাবে পারছে, নিরাপদে আশ্রয়ে ছুটছে। দোকানপাট ও ঘরবাড়ি বন্ধ করে অন্তত চার হাজার মানুষ অন্যত্র চলে গেছে। সীমান্তজুড়ে বিরাজ করছে আতঙ্ক। বন্ধ রাখা হয়েছে পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসা।
আরাকান আর্মির সঙ্গে সংঘর্ষের পর দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ৯৫ জন সদস্য অস্ত্রসহ পালিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছেন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ।
সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারি) সকালে বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘর্ষের জেরে এখন পর্যন্ত দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির ৯৫ জন সদস্য অস্ত্রসহ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) তাদের নিরস্ত্রীকরণ করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়েছে। এ ব্যাপারে পরবর্তী কার্যক্রম চলমান।
এর আগে রোববার (৪ ফেব্রুয়ারি) বিজিবির এ কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, রোববার ভোর থেকে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির সদস্যরা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া শুরু করেন। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্ত এলাকা দিয়ে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেন।
নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলিতে তিন বাংলাদেশি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। মর্টার শেল ও গুলি থেমে নেই। কয়েক হাজার মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছেন। কিছু লোক এপারে ঢুকে বিজিবি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন। উৎকণ্ঠায় রয়েছে সীমান্তের লোকজন।
তুমব্রু সীমান্তের মসজিদের ইমাম খোরশেদ আলম কাওয়াসারী বলেন, গেল শনিবার ভোর থেকে ব্যাপক মর্টার শেল ও গুলি চলছে। কয়েক ধাপে মিয়ানমার থেকে বেশ কিছু মানুষ বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। তাদের পরনে ছিল বিজিপির পোশাক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বিজিবি সদস্য বলেন, শনিবার বিকাল থেকে মিয়ানমারের ভেতরে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়। সীমান্ত সুরক্ষিত রাখতে এ সময় বিজিবি কঠোর অবস্থান নেয়। এ অবস্থায় রোববার ভোরে বিজিপির কিছু সশস্ত্র সদস্য বাংলাদেশে ঢোকে।
আরও পড়ুন <> ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তে আতঙ্ক, বাংলাদেশি গুলিবিদ্ধ
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন বলেন, তুমব্রু সীমান্তে ব্যাপক মর্টার শেল ও গোলাগুলি চলছে। আমরা শুনেছি, বেশ কয়েকজন বিজিপি সদস্য এপারে বিজিবির কাছে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে কতজন, সেটি এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। আমরা জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে সীমান্তে ঝুঁকিতে থাকা লোকজনকে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বলেছি। সব সংস্থা মিলে আমরা সীমান্ত পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছি।
রোববার সকালে তুমব্রু সীমান্তে বিজিবির কাছাকাছি পশ্চিম গুনাপাড়ায় নিজ বাড়ির উঠানে বসে ছিলেন প্রবীণ ধর। হঠাৎ মিয়ানমারের ছোড়া গুলিতে তিনি আহত হন। দুপুরে পশ্চিম পাহাড়পাড়ার মো. শামসু ও কোনাপাড়ার দিল মোহাম্মদের স্ত্রী আহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ প্রবীণ ধরের জামাতা সুরিৎ কুমার বলেন, ‘সকালে মিয়ানমারের ছোড়া গুলিতে আমার শ্বশুর গুলিবিদ্ধ হন। মনে হচ্ছে, যুদ্ধের মধ্যে আছি। আমরাও পরিবার নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাচ্ছি।’
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, ‘রোববার সীমান্তের ওপারে ব্যাপক গুলিবর্ষণের পাশাপাশি হেলিকপ্টার থেকে ফায়ার হচ্ছে। ভয়ে গ্রাম ছাড়ছে মানুষ।’
ঘুমধুম ইউনিয়নের মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে যুদ্ধাবস্থার কারণে বাজারপাড়া, হিন্দুপাড়া, কোনাপাড়া, মধ্যমপাড়া ও পশ্চিমকুল এলাকার কয়েক হাজার মানুষ বাড়িঘর ছেড়েছে। তুমব্রু সীমান্তের বাসিন্দা মো. শাহাজান মিয়া বলেন, ‘সীমান্তে রাতদিন আতঙ্কে দিন কাটছে। অনেকে আবার ঘর থেকে বের হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতি জীবনে দেখিনি।’
দুটি ছাগল নিয়ে অটোরিকশায় উখিয়ার দিকে আশ্রয় নিতে চলে যাচ্ছিলেন নির্মল ধর। তিনি বলেন, ‘আমরা পরিবার নিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছি। এখানে গোলাগুলির কারণে টেকা যাচ্ছে না। প্রতিদিন গোলাগুলি হচ্ছে। এপারে অনেকের ঘরে গুলি পড়ছে।’
ঘুমধুম ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য দিল মোহাম্মদ ভুট্টু বলেন, ‘রাত ৩টার পর থেকে ওপারে দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি চলছে। ভয়ে গ্রামের লোকজন পাশের এলাকায় চলে যাচ্ছে। আমার বাড়ির আঙিনায়ও একটি মর্টার শেল পড়েছে।’
স্থানীয় বাসিন্দা সুমী পাল বলেন, ‘পরিবারের সবাইকে নিয়ে তুমব্রু বাজারে এসে অবস্থান করছি। সীমান্ত এলাকার মাঠে অনেকের পাকা ফসল। এখন সেই ফসল আনতেও ভয় লাগছে।’
পালিয়ে আসা মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীরা অস্ত্র ও গুলি বিজিবির কাছে জমা রেখেছে জানিয়ে ৩৪ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল আবদুল্লাহ আল মাশরাফি বলেন, ‘বেশ ক’জন মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাংলাদেশ সীমানায় সশস্ত্র অবস্থায় চলে আসে। তাদেরকে কর্ডন করে এনে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা হয়েছে।’
নাইক্ষ্যংছড়ির স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে আরাকান আর্মির তীব্র লড়াই চলছে। মিয়ানমার সীমান্তের ওপার থেকে গুলির তীব্র শব্দ নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে ভেসে আসে। নাইক্ষ্যংছড়ি ও টেকনাফ সীমান্তের ওপারে বিজিপির সিংহভাগ চৌকি আরাকান আর্মির দখলে চলে গেছে। কয়েকটি চৌকি দখলে নেয়ার জন্য উভয়ের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলছে। মিয়ানমার সীমান্তের ওপার থেকে আসা একটি গোলা বাইশফাঁড়ি এলাকার নুরুল কবীরের বাড়িতে এসে পড়ে। এতে মুহূর্তেই তার বাড়িতে আগুন ধরে যায়। গোলার আঘাত ও আগুনে বাড়ির কেউ হতাহত হননি। ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা এসে আগুন নিভিয়ে ফেলেন। চাষাবাদসহ অন্য কাজ করতে না পারায় স্থানীয় কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়েছে।
আরও পড়ুন <> মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশ অর্ধশত ছাড়াল
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ত্রিরতন চাকমা জানান, মিয়ানমার সীমান্তে দুই বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় কয়েকটি বিদ্যালয় বন্ধ রাখা হয়েছে।
এদিকে চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ‘চলমান ইস্যুতে বিজিবি কাজ করছে। আমরা বিজিবির সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করছি।’
অন্যদিকে রোববার সচিবালয়ে নিজ দফতরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আমরা কোনো যুদ্ধে জড়াতে চাই না। যুদ্ধ চাইও না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সব সময় সে নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। তবে আমরা সব সময় তৈরি আছি।
তিনি বলেন, আমরা মিয়ানমার সীমান্তে শক্তি বৃদ্ধি করেছি। আমরা পুলিশকে বলে দিয়েছি, কোস্টগার্ডকেও আমরা নির্দেশনা দিয়েছি। যাতে কোনোভাবেই কেউ আমাদের সীমানায় অনুপ্রবেশ করতে না পারে। সে ব্যাপারে আমরা খুব সতর্ক রয়েছি। যুদ্ধ কতদিন চলে আমরা জানি না। কিন্তু সীমান্ত পার হয়ে কাউকে আসতে দেব না। বিজিবিকে আমরা সেই নির্দেশনাই দিয়েছি।
আত্মরক্ষার্থে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী বাংলাদেশে ঢুকলে তাদের ধরে আবার ফেরত পাঠানো হবে বলেও জানিয়েছেন আসাদুজ্জামান খান।
গত ২৭ অক্টোবর অপারেশন ১০২৭ নামে জান্তাবিরোধী অভিযান শুরু করে আরাকান আর্মি। এর পর থেকে তারা উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যের বেশির ভাগ এলাকা দখল করে নিয়েছে। এর মধ্যে ২০টি শহর এবং চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ পথ রয়েছে।
চীনের মধ্যস্থতায় মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে হামলা বন্ধ রেখেছিল আরাকান আর্মি। অবশ্য অপারেশন ১০২৭-এর আওতায় ১৩ নভেম্বর থেকে উত্তর রাখাইন ও পাশের চিন রাজ্যের পালেতোয়ায় বড় ধরনের আক্রমণ চালিয়ে আসছে আরাকান আর্মি।
এ ছাড়া কাচিন প্রদেশ ও সাগায়িং অঞ্চলে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য শক্তিশালী কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি (কেআইএ) ও পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেসের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আরাকান আর্মি।
আপন দেশ/এমআর
মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।