Apan Desh | আপন দেশ

জুতা, রাজার নাতী বনাম বাফুফের সালাউদ্দিনের নজর

আফজাল বারী

প্রকাশিত: ২৩:০৩, ৩ মে ২০২৩

আপডেট: ২১:৫০, ৪ মে ২০২৩

জুতা, রাজার নাতী বনাম বাফুফের সালাউদ্দিনের নজর

কার্টুন: সংগৃহীত

গল্প দিয়েই শুরুটা করি আজকের ইস্যুটি। এক রাজা মেয়ের বিয়ে দিলেন আরেক রাজার ছেলের সাথে। তাদের ঘরে এলো একটি সন্তান। দুই রাজার রাজ্যে খুশির বন্যা। মিষ্টি বিতরণ। ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠল শিশুটি। এক সময় হামাগুড়ি দিতে লাগল। শিশুটিকে খেলাধুলার জন্য সোনা দিয়ে গড়া নানান খেলালনা দেয়া হলো।

ওই খেলনার প্রতি শিশুটির আগ্রহ নেই। হামাগুড়ি দিয়ে হাতে নেয় জুতা। শিশুর হাত থেকে জুতা কেড়ে নিলে কান্নাকাটি শুরু করে। আর থামানো যায় না। বিষয়টি রাজার মনে খটকা দিল। গণক ডাকা হলো। রাশি গণনা করে ফলাফল না দিয়ে গণক মাথা নিচু করে রইলেন। রাজার ধমকের পর গণক বললেন, রাজা মশাই অভয় দিলে বলব। হ্যাঁ সূচক অভয়ে গণক জানালো শিশুটি মুচির বংশধর। রেগে রাজা হুকুম দিলেন গণকের গর্দান বিচ্ছিন্ন করতে। 

এদিকে গণকের বাক্য সঠিক কিনা জানতে বেয়াই রাজাকে (বরের বাবা) দাওয়াত করলেন রাজা মশাই। তার মেয়ের ঘরের জুতা প্রেমিক নাতির কাণ্ড ও গণকের উক্তির কথা শেয়ার করলেন। ওই রাজা নেপথ্য জানাতে একদিন সময় নিলেন। ওদিনই তার উজিরকে ডেকে ঘটনা শুনলেন...। পরদিন রাজা গেলেন তার (ছেলের বাবা) বেয়াইয়ের দরবারে। বললেন, হ্যাঁ বেয়াই, ঘটনা সত্য। 

আমি ছিলাম নিঃসন্তান। আঁটকুড়া রাজার অভিশাপ থেকে মুক্তিপেতে একটি সন্তান এনে দিতে ওইদিন উজিরকে ১২ ঘণ্টা সময় দিয়েছিলাম। সেদিনই আমার রাজ্যে একমাত্র মুচির ঘরেই সন্তান জন্ম নিয়েছিল। মুচির সন্তানই আমি লালন করেছি। যে কারণে আপনার-আমার নাতীর নজর জুতার দিকে।

গল্পের সেই রাজার নাতীর নজরের সাথে অনেকটাই মিল পাওয়া যায় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের। 

দুর্বৃত্তের দৃষ্টিতে সাংবাদিকরা ভালো হবার কোনো কারণ নেই। তাই বিভিন্ন সময় সাংবাদিকরা মানসিকভাবে কটুবাক্যতীরে বিদ্ধ হন। শারিরীকভাবে আক্রান্ত এমনকি খুনের শিকারও হন। হাজারো ঘটনা থাকলেও ‘জুতাপ্রেমি’ সমালোচকের দেখা মিলেনি। তবে এবার তার চামড়ার মুখ ও সাংবাদিকের বাবার জুতা ইস্যুতে ভাসছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। শিরোনাম হচ্ছে সংবাদ মাধ্যমে।

মঙ্গলবার (২ মে) বাফুফের নির্বাহী কমিটির দীর্ঘ সভার পর আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের আগে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় মাইক্রোফোনের সামনে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘জার্নালিস্ট এখানে ঢুকতে গেলে তাদের বাপের ছবি দিতে হবে। কন্ডিশন হলো, বাপের একটা ফটো পাঠাবে জুতা পরা। ঠিক আছে? এটা ম্যান্ডেটরি। আমার তো এখানে বাপের জুতা পরা ছবি থাকতে হবে।’

এ সময় সালাউদ্দিনের পাশে ছিলেন বাফুফের সিনিয়র সহসভাপতি সালাম মুর্শেদী, সহসভাপতি আতাউর রহমান ভূঁইয়া, কাজী নাবিল আহমেদ, মহিউদ্দিন আহমেদসহ অন্যরা। 

গত ১৪ এপ্রিল আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে ফিফা বাফুফের সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে। এই ঘটনার আগে থেকেই দেশের ফুটবলের অনিয়ম নিয়ে সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিবেদন হচ্ছে। কিন্তু সাংবাদিকেরা ‘মিথ্যা সংবাদ’ করেন বলে প্রায়ই ক্ষোভ ঝাড়েন কাজী সারাউদ্দিন। সেই ধারাবাহিকতায় নিজেদের মধ্যে কথোপকথনে তার ওই মন্তব্য, যেটি রেকর্ড হয়ে যায় তার সামনে থাকা সাংবাদিকদের রেকর্ডারে।

এদিকে বাফুফে থেকে পাঠানো এক ভিডিও বার্তায় দুঃখ প্রকাশ করে কাজী সালাউদ্দিন বলেছেন, ‘একটা নিউজ আমি দেখছি, যেখানে সাংবাদিকদের আঘাত করার জন্য একটা কথা বলেছি। প্রকৃত কথা হলো, আমি সাংবাদিকদের কষ্ট দেয়ার জন্য বলিনি। আমি নাবিলের (কাজী নাবিল আহমেদ) সঙ্গে একটা বিষয় নিয়ে জোক করছিলাম। সেটা যে কেউ টেপ (রেকর্ড) করছিলেন, সেটা আমি জানি না। আমি এই কথায় যদি কাউকে কষ্ট দিয়ে থাকি, দুঃখ দিয়ে থাকি, তাহলে আমি খুবই দুঃখিত।'

এরপর তিনি যোগ করেন, ‘আমি ক্ষমা চাই। কারণ, আমি উদ্দেশ্যমূলক কিছু বলিনি। এটি আমাদের ব্যক্তিগত একটা জোক ছিল। ওখানে যে টেপ (রেকর্ড) ছিল, সেটিও আমি জানি না। কাউকে যদি কষ্ট দিয়ে থাকি, তাহলে অবশ্যই আমি দুঃখিত।’ 

কাজী সালাউদ্দিনের সঙ্গে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে বাফুফে সহসভাপতি কাজী নাবিল আহমেদ রসিকতা করে ইংরেজিতে আন্ডারওয়্যার সম্পর্কিত একটি মন্তব্য করেন। বুধবার নাবিল আহমেদও দুঃখ প্রকাশ করলেন। বাফুফের প্যাডে নাবিল আহমেদ স্বাক্ষরিত দুঃখ প্রকাশ পত্রে বলা হয়, ‘গত ২ মে বাফুফে নির্বাহী কমিটির সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনের পূর্বে একটি অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে। সেখানে আমার সব সময়ের সহযাত্রী সম্মানিত সাংবাদিক ভাইদের নিয়ে করা আমার একটি মন্তব্যে তারা ভীষণ মর্মাহত হয়েছেন। এ মন্তব্যের জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। এ ধরনের মন্তব্য করা কোনোভাবেই আমার উচিত হয়নি। আমি নিজেও দীর্ঘদিন ধরে সংবাদপত্র শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এ সেক্টরে আমাদের পারিবারিক সম্পর্কের বিষয়টি সবার জানা। এ মন্তব্য আমার ওপরও এসে পড়ে। তাই আপনাদের কেমন লাগছে সেটি আমি অনুভব করতে পারছি।’

এদিকে বেঁফাস মন্তব্যের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এনিয়ে চলছে তুমুল সমালোচনা। কাজী সালাউদ্দিনের প্রতি ফুটবলপ্রেমিদের যতো বেশি মাত্রায় শ্রদ্ধা ছিল এখন তার চেয়ে বেশি ঘৃণার পাচ্ছেন। ইতোমধ্যে একেএকে অনেক বহিষ্কার ও প্রতিবাদের চিঠি আসছে তার বিরুদ্ধে। 

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে), ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে), ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) সহ একাধিক সাংবাদিক সংগঠন এ ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়েছে। কাজী সালাউদ্দিনকে বাফুফে থেকে বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছে সংগঠনগুলোর নেতারা।

সাংবাদিকদের বাপের জুতা পরা ছবি নিয়ে ফুটবল ফেডারেশনে আসতে হবে- বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দীনের এমন বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বিএফইউজে-বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শহীদ উল আলম চৌধুরী ও মহাসচিব দীপ আজাদ।

বিবৃতিতে অবিলম্বে কাজী সালাউদ্দিন পদত্যাগ দাবি করেন। দেশের ফুটবল সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তির এ ধরনের বক্তব্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ নয়। শুধু সাংবাদিক সমাজ নয়, তাদের পরিবারকে জড়িয়ে এই বক্তব্য দেয়ার পর বাফুফে সভাপতির মানসিক অবস্থা নিয়ে দেশবাসী সন্দিহান বলে উদ্বেগ প্রকাশ করে।

বুধবার (৩ মে) বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির (বিএসপিএ) সম্মানসূচক সদস্যপদ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। বিএসপিএর কার্যনির্বাহী কমিটির জরুরি সভায় বুধবার এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কিংবদন্তি খেলোয়াড় হিসেবে কাজী সালাউদ্দিনকে ২০১২ সালে সম্মানসূচক সদস্যপদ বিএসপিএ।

ওই পদ থেকে বহিষ্কারের বিজ্ঞপ্তিতে বিএসপিএ জানায়, ‘পরীক্ষিত ক্রীড়া সংগঠক, কিংবদন্তি খেলোয়াড় এবং মিডিয়া–সংশ্লিষ্ট ক্রীড়া সংগঠকদের অনারারি সদস্যপদ দেয়ার রেওয়াজ আছে এ সংগঠনের। এ ধারায় বিএসপিএ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সাবেক প্রধান ও বর্তমানে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালসহ অনেক ক্রীড়া ব্যক্তিত্বকে সম্মানিত করেছে অনারারি সদস্যপদ দিয়ে। একইভাবে কাজী মো. সালাউদ্দিনকে অনারারি সদস্যপদ দেয়া হয়েছিল। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে তার আচরণ, বক্তব্য সবকিছুই এই ঐতিহ্যবাহী ক্রীড়া সাংবাদিক সংগঠনের মতাদর্শের পরিপন্থী। তার কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য ক্রীড়া সাংবাদিকদের আত্মসম্মানে আঘাত হেনেছে।’

একই সঙ্গে ক্রীড়া সাংবাদিকদের নিয়ে বাফুফে সহসভাপতি কাজী নাবিল আহমেদের মন্তব্যেরও নিন্দা জানিয়েছে বিএসপিএ।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিএসপিএ বলেছে, ‘সাংবাদিকদের ওপর তাদের কতটা বিদ্বেষ, সেটা প্রকাশ পেয়েছে তাদের কথাবার্তায়। তারা শুধু সাংবাদিকদের নয়, তাদের পরিবার এমনকি সাংবাদিকদের মা-বাবাকে পর্যন্ত কটাক্ষ করতে ছাড়েননি। এটা পুরো সাংবাদিক সমাজকে ভীষণভাবে আহত করেছে।’

বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির (বিএসপিএ) সম্মানসূচক সদস্যপদ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। বিএসপিএর কার্যনির্বাহী কমিটির জরুরি সভায় বুধবার এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

আপন দেশ/আরএ

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

শীর্ষ সংবাদ:

মিরপুরে পুলিশ-অটোরিকশা চালকদের সংঘর্ষ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ভ্যাট বসলে মেট্রোরেলের সুনাম নষ্ট হবে: ওবায়দুল কাদের বান্দরবানের রুমায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে তিনজন কেএনএ সদস্য নিহত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তরুণদের উদ্যোক্তা হতে বললেন গুরুত্বপূর্ণ সফরে ঢাকায় আসছেন অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওং রাজধানীর আগারগাঁও ও মিরপুর ১০ নম্বরে অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, মেট্রো স্টেশনের প্রবেশপথে তালা পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছেন বাবর আলী ঢাকাসহ ১০ অঞ্চলের উপর দিয়ে ৬০ কিমি বেগে বজ্রবৃষ্টির শঙ্কা জো বাইডেনের ‘ড্রাগ টেস্ট’ করতে বললেন ডোনাল্ড ট্রাম্প লিওনেল মেসির ইন্টার মায়ামি হারাল ডিসি ইউনাইটেডকে