Apan Desh | আপন দেশ

শীতেও থাকছে ডেঙ্গুর প্রকোপ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১০:৩৩, ৪ নভেম্বর ২০২৩

আপডেট: ১০:৩৫, ৪ নভেম্বর ২০২৩

শীতেও থাকছে ডেঙ্গুর প্রকোপ

ফাইল ছবি

জলবায়ু পরিবর্তন, সাধারণ মানুষের অসচেতনতা আর মশক নিধনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় ডেঙ্গু জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হিসেবে দাঁড়িয়েছে। গত দুই যুগে মশাবাহিত রোগটি শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়েছে। এখন বছরজুড়ে বাড়াচ্ছে ভোগান্তি। 

চলতি বছর আক্রান্ত-মৃতের সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়েছে। এবার শীতের আগমনেও কমছে না ডেঙ্গু। শুক্রবার আরও এক হাজার ৩৫৭ নতুন রোগী সারা দেশের হাসপাতাল ভর্তি হয়েছেন। এ সময় মৃত্যু হয় আরও ১০ জনের। 

জনস্বাস্থ্যবিদ ও কীটতত্ত্ববিদদের মতে, চলতি মাসেও থাকতে পারে ডেঙ্গুর প্রকোপ। এরপর বৃষ্টিপাতের সঙ্গে মাথাচাড়া দিতে পারে ডেঙ্গুর বিস্তার। তাই ধারণা করা হচ্ছে, বছরজুড়েই থাকতে পারে ডেঙ্গুঝুঁকি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমের শুরু থেকে শুক্রবার পর্যন্ত সারা দেশে দুই লাখ ৭৬ হাজার ১৬৩ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও শুক্রবার পর্যন্ত এক হাজার ৩৮০ জনের মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে ৭৮৬ জন নারী আর ৫৯৪ জন পুরুষ। জানুয়ারিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৫৬৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬, মার্চে ১১১, এপ্রিলে ১৪৩, মে মাসে এক হাজার ৩৬, জুনে পাঁচ হাজার ৯৫৬, জুলাইয়ে ৪৩ হাজার, আগস্টে ৭১ হাজার ৯৭৬, সেপ্টেম্বরে ৭৯ হাজার ৫৯৮, অক্টোবরে ৬৭ হাজার ৭৬৯ এবং অক্টোবরে তিন দিনে ৪ হাজার ৯৮৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। 

স্বাস্থ্য অধিদফতর আরও জানায়, গত বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। এর আগের বছর ২৮ হাজার ৪২৯ এবং ২০২০ সালে এক হাজার ৪০৫ জন ভর্তি হন। ২০১৯ সালে এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ আর ২০১৮ সালে ১০ হাজার ১৪৮ জন ভর্তি হন।

চলতি বছর ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া এক হাজার ৩৮০ জনের মধ্যে জানুয়ারিতে মৃত্যু হয় ছয় জনের। ফেব্রুয়ারিতে মৃত্যু হয় দুই জনের। মার্চে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কোনো মৃত্যুর ঘটনা না ঘটলেও এপ্রিল ও মে মাসে দুই জন করে মারা যান। জুন মাসে এসে ভয়াবহ আকার ধারণ করে ডেঙ্গু। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়। জুলাইয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারান ২০৪ জন। আগস্টে ৩৪২ জনের মৃত্যু হয়। সেপ্টেম্বরে ৩৯৬, অক্টোবরে ৩৫৯ আর নভেম্বরের তিন দিনে আরও ৩০ জনের মৃত্যু হয়।

এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার মিলে সম্প্রতি ৩২৫ রোগীর তথ্য সেরোটাইপ বিশ্লেষণ করে। সেখানে দেখা যায়, ৬২ শতাংশ রোগী ডেন-২ আক্রান্ত। ২৯ শতাংশ ডেন-৩ আর ১০ শতাংশ রোগী ডেন-২ ও ৩ দ্বারা সংক্রমিত।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা সরকারের দেয়া হিসাবের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। যারা গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নিয়েছে, তাদের গণনায় ধরা হয়েছে। এর মধ্যে আবার সব হাসপাতালের তথ্য নেই। এতে মৃত্যুর হার অনেক বেশি দেখা গেছে।

তিনি বলেন, চিকিৎসাব্যবস্থা দ্বিকেন্দ্রিক না হওয়ার কারণে মৃত্যু বেশি হয়েছে। অর্থাৎ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বাইরে চিকিৎসায় ঘাটতি থাকায় মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হয়েছে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের যদি প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যেত তাহলে মৃত্যু আরো অনেক কম হতো। গুরুতর রোগীর সংখ্যাও কম হতো।

কীটতত্ত্ববিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, সম্প্রতি দেশে একটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এর প্রভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হয়। এতে জমে থাকা পানিতে ডেঙ্গুর লার্ভা জন্মায়। আমরা জানি, এডিস মশার আয়ুষ্কাল অন্তত ৪০ দিন। সেই হিসাবে ধারণা করা যাচ্ছে, আরও বেশ কিছুদিন ডেঙ্গু আমাদের ভোগাবে। এ ছাড়া অন্যান্য উৎস থেকে ডেঙ্গু পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ছে; যেমন ড্রাম, বালতি আর নির্মাণাধীন ভবনের জমিয়ে রাখা পানি। ফলে দেশের জলবায়ু পরিবর্তন ও সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ বছরজুড়েই ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকবে।

সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, গত মাসের শেষের দিকে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ের পর দেশের উপকূল ও এর আশপাশে বৃষ্টিপাত হয়েছে। বৃষ্টিপাতের পর দুই থেকে তিন সপ্তাহ ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকে। আক্রান্ত মানুষের মধ্যে ডেঙ্গুর উপস্থিত আরও অন্তত এক সপ্তাহ থাকে। এ হিসাব অনুযায়ী ধারণা করা হচ্ছে, আগামী মধ্য নভেম্বরের মধ্যে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা কমে আসতে পারে। তবে এর মধ্যে যদি আবার বৃষ্টিপাত হয় কিংবা ডিসেম্বর নাগাদ শীতের তীব্রতা শুরু না হয়, তাপমাত্রা যদি ৩০ থেকে ৩২ ডিগ্রির মধ্যে থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে, আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের মধ্যেই আছি।

তিনি বলেন, আরও কিছু চিন্তার বিষয় আছে। সারা দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে একটি সমন্বিত জরিপ ও গবেষণা দরকার। অতীতের চেয়ে এ বছর কোন কোন জেলায় বেশি ডেঙ্গু রোগী ও মৃত্যু ঘটেছে। এর নেপথ্যের কারণ কী? এসব নিয়ে সমন্বিত গবেষণা দরকার। নয়তো ডেঙ্গুর ভোগান্তি থেকে সহসা মুক্তি মিলবে না।

আপন দেশ/আরএ

শেয়ার করুনঃ