Apan Desh | আপন দেশ

মাউশিতে প্রকৌশলী-ঠিকাদার সিন্ডিকেট: অবকাঠামোর খবর নেই, চলছে অর্থ ছাড়

আফজাল বারী

প্রকাশিত: ২২:০৯, ৫ ডিসেম্বর ২০২২

আপডেট: ১২:০৮, ৭ ডিসেম্বর ২০২২

মাউশিতে প্রকৌশলী-ঠিকাদার সিন্ডিকেট: অবকাঠামোর খবর নেই, চলছে অর্থ ছাড়

ছবি: আপন দেশ ডটকম

হরিলুটে ভেস্তে যাচ্ছে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ‘৯টি সরকারি হাইস্কুল স্থাপন’ প্রকল্প। তেমন কাজ না হলেও এ প্রকল্প অফিসের নথিপত্রে অগ্রগতি ৩৫ শতাংশ। তদন্তে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিদর্শনে এমন তথ্যই পেয়েছেন। হেড অফিস থেকে ছাড় হয়েছে ৫ কোটি। ঠিকাদারের নামে কোটি টাকার বিল পরিশোধ দেখানো হয়েছে। ওই টাকায় গাজীপুরে প্রকৌশলী ও ঠিকাদার মিলে একটি ‘রিসোর্ট’ নির্মাণ করছেন বলে ইইডির দু’জন নির্বাহী প্রকৌশলীর দাবি। এসব হচ্ছে প্রভাবশালীদের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে।  

এ তথ্য পাওয়া গেছে বিভাগীয় পর্যায়ে নতুন ‘৯টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন’ প্রকল্পের কার্যক্রম পরিদর্শনে। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের (মাউশি) উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের একটি টিম এ প্রকল্পের আওতায় রংপুরে একটি বিদ্যালয় নির্মাণের প্রস্তাবিত স্থান পরিদর্শনে গিয়ে এ তথ্য জানতে পান। কিন্তু টাকা ছাড়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রকল্প কর্মকর্তা এবং নির্মাণ কাজের দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলীরা প্রভাবশালী হওয়ায় এ অনিয়ম ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। ইইডির পরিদর্শন দলের সদস্যরা এ বিষয়ে লিখিত প্রতিবেদন দেয়ার জন্য সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তার সম্মতি চাইলেও তা মেলেনি বলে একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন।

রংপুর সদরে নতুন ‘কামাল কাছলা মৌজা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়’এর জন্য ১০তলা একাডেমিক ভবন নির্মাণ হচ্ছে। এ অবমাঠামো নির্মাণের জন্য ঢাকার একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এসএসএল এসই এমএ জেভে ( হাউজ নং-১২৯, ফ্লাট নং এ-১, এসকে লেন, এলিফেন রোড ঢাকা।) কে গত ২৮ এপ্রিল কার্যাদেশ দেয়া হয়। এ নির্মাণ কাজের মোট দরপত্র মূল্য ধরা হয়েছে ২৩ কোটি দশ লাখ টাকার ৮ হাজার ৪৩২টাকা। মোট ৩৬ মাসে নির্মাণ কাজ শেষ করার কথা।

জানা গেছে, প্রকল্প কার্যালয় থেকে গত ২৬ জুন রংপুর অফিসের অনুকূলে (ইইডি) এক কোটি টাকা ছাড় করা হয়। পরবর্তীতে আরও প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ছাড় হয় প্রকল্প অফিস থেকে। তবে প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) টাকা ছাড়ের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। ইইডির প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরাও এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

কাজ না হওয়া সত্ত্বেও টাকা ছাড়ের বিষয়ে জানতে চাইলে ৯টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের পিডি অধ্যাপক রায়হানা তসলিম এ প্রতিবেদককে বলেন, রংপুরের ওই স্কুলটির জন্য ‘আমরা টাকা ছাড় করিনি।’

কিন্তু ইইডি কর্মকর্তারা টাকা ছাড়ের প্রমাণ পেয়েছে-এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পিডি বলেন, ‘অল্প কিছু টাকা দেয়া হয়েছে; কাজও এখন চলমান।’

এ বিষয়ে ইইডির রংপুর আঞ্চলিক অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল কালাম মো. আকতারুজ্জামান আপন দেশ ডটকমকে বলেন, আমরা হেড অফিস থেকে পাঁচ কোটি টাকা পেয়েছি। ঠিকাদারকে এক কোটি টাকা দিয়েছি। বাকি টাকা ‘ইইডির ট্রেজারি’তে আছে।

ইইডির দুই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রংপুরে একটি স্কুল স্থাপনে ‘ভুল ডিজাইনে ভুল ফাইল করা’ হয়েছে। তবে এ প্রকল্পের ডিজাইনের দায়িত্বে থাকা সংস্থার নির্বাহী প্রকৌশলী ও ডিজাইনার জয়নাল আবেদীন বলেন, “আমি কোনো ভুল ডিজাইন করি না। সেখানে (রংপুর) ‘ফাইলিংয়ে ভুল হয়েছে’।

অগ্রিম বিল পরিশোধের পরও নির্মাণ কাজ এগুচ্ছে না বিভাগীয় পর্যায়ে নতুন ৯টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থান প্রকল্পে। এ প্রকল্পের আওতায় রংপুরে দুটি স্কুল নির্মাণের কথা রয়েছে। তবে ছয় মাসে কাজ হয়নি ১০ লাখ টাকারও। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে সম্প্রতি ওই বিদ্যালয় স্থল পরিদর্শনে যান শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের (ইইডি) কয়েকজন প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা। সেখানে পৌছে জানতে পান টাকা আগাম ছাড় দেয়া হলেও নির্মাণ কাজ শুরুই হয়নি।

এরপর তারা বিষয়টি সংস্থার প্রধান প্রকৌশলীকে অবহিত করলে তিনি প্রকৌশলীদের ওপর ‘ক্ষোভ’ প্রকাশ করেন। ‘পরিদর্শনের এজেন্ডায়’ এই স্কুলের নাম না থাকায় ‘ক্ষোভ’ প্রকাশ করেন প্রধান প্রকৌশলী দেলেয়ার হোসেন মজুমদার। কারণ ইইডির ওই জোন অফিসের প্রধান এবং ওই কাজের ঠিকাদার-দুজনই ‘প্রভাবশালী’। এ অপকর্মের’ সঙ্গে প্রকল্প কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলে ইইডি কর্মকর্তাদের ধারণা।

২০১৮ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া ‘৯ স্কুল’ প্রকল্পটির প্রথম দফায় মেয়াদ ছিল ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। পরে মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এ হিসেবে আগামী সাত মাসে প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ করতে হবে। ৪৬৪ কোটি টাকার এ প্রকল্পে গত জুন নাগাদ প্রায় ১৬২ কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। এ হিসেবে আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়ায় ৩৫ শতাংশের মতো। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) অধীনে বাস্তবায়ন হওয়া এ প্রকল্পের প্রকৃত অগ্রগতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

প্রকৌশলী ও প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৯টি বিদ্যালয়ের মধ্যে অন্তত পাঁচটির অবকাঠামো নির্মাণ কাজই ‘সন্তোষজনক’ নয়। এগুলোতে কখনো কাজ হচ্ছে, কখনো বন্ধ থাকছে। ‘মনিটরিং’ হচ্ছে দায়সারা। এ কারণে আগাম বিল পরিশোধের পরও কাজ এগুচ্ছে না।

প্রকল্পটির অধীনে চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগীয় শহরে দুটি করে, ময়মনসিংহ বিভাগীয় শহর ও জয়পুরহাটে একটি করে এবং সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে একটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় নির্মাণের কথা রয়েছে।

এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগীয় শহরের দুটি বিদ্যালয়ের জমি নির্ধারণ করতেই দুই বছর চলে যায়। একটি বিদ্যালয় নির্মাণের জন্য অন্তত দুই একর জমির প্রয়োজন। একসঙ্গে জমি না পাওয়ায় শহরের দক্ষিণের দিকে পতেঙ্গায় দুটি বিদ্যালয় নির্মাণের জমি নির্ধারণ করা হয়। দুটি বিদ্যালয়ের মধ্যে একটির নির্মাণ কাজ শুরু হলে এগুচ্ছে কচ্ছপ গতিতে; আরেকটি কাজই শুরু হয়নি।

রাজশাহী শহরে দুটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য বোয়ালিয়ার ছোট বনগ্রাম এবং বড় বনগ্রাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে একটির কাজ শুরু হলেও অপরটির কাজ শুরু হয়নি।

এছাড়া জয়পুরহাটের বিদ্যালয়টির নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। রংপুর শহরের কামালকাস্তা এবং উত্তম এলাকায় সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় দুটি স্থাপনের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে উত্তম এলাকায় স্কুলের দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি।

ময়মনসিংহ শহরের ঢাকা বাইপাস এলাকায় জমি নির্ধারণ করা হয়েছে। নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে মাত্র। আর শ্রীমঙ্গলের বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের ভেতরে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করা হলেও কাজ এগুচ্ছে ধীর গতিতে।

৯টি বিদ্যালয়ের মধ্যে বিভাগীয় শহরের ৭টি বিদ্যালয় হবে ১০ তলাবিশিষ্ট এবং জেলা-উপজেলা শহরের দুটি হবে ৬ তলাবিশিষ্ট। বিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত সংখ্যক শ্রেণিকক্ষের পাশাপাশি আইসিটি ল্যাব, বিজ্ঞানাগার, লাইব্রেরি, মাল্টিপারপাস হল রুম, প্রধান শিক্ষকের কক্ষ, সহকারী প্রধান শিক্ষকের কক্ষ, অফিস কক্ষ, শিক্ষক কমনরুম, দর্শনার্থী কক্ষ ও মিড ডে মিল কক্ষ ও সেমিনার কক্ষ থাকবে।

এছাড়া বিএনসিসি, গার্লস গাইড কক্ষ, প্রাথমিক চিকিৎসা কক্ষ এবং ইন্টানেট সুবিধাসহ ল্যাপটপ, কম্পিউটার ও কম্পিউটার সামগ্রী, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, বই-পুস্তক, খেলাধুলার সরঞ্জাম, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র সুবিধাও রাখার কথা রয়েছে প্রকল্প দলিলে।

আপন দেশ ডটকম/ এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়