Apan Desh | আপন দেশ

জরায়ুর ক্যানসারের নকল ভ্যাকসিন তৈরির চক্র, হোতাসহ গ্রেফতার ৬

নকল ভ্যাকসিন নিয়ে উদ্বেগে ৬ হাজার নারী

আপন দেশ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১১:৩১, ২২ মার্চ ২০২৩

আপডেট: ১৭:০৩, ২২ মার্চ ২০২৩

নকল ভ্যাকসিন নিয়ে উদ্বেগে ৬ হাজার নারী

ছবি : আপন দেশ

দেশে জরায়ুর ক্যানসারের নকল ভ্যাকসিন তৈরির চক্রের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। দীর্ঘদিন বিভিন্ন ফাউন্ডেশনের নামে দিনে-দুপুরে মাইকিং করে অর্থের বিনিময়ে নারী ও কিশোরীদের প্রয়োগ করা হতো এই ভ্যাকসিন।  এই চক্রের হোতাসহ ছয় জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। রিমান্ডের পর তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। 

গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন, চক্রের হোতা হিমেল, সাইফুল ইসলাম শিপন, ফয়সাল আহম্মেদ, আল আমিন, নুরুজ্জামান সাগর ও আতিকুল ইসলাম। তাদের প্রত্যেককে রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

তারা নকল ভ্যাকসিন তৈরির কথা স্বীকার করে। তাদের দেয়া তথ্যে জানা যায়, রাজধানীর দক্ষিণখান ও কেরাণীগঞ্জে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হত এসব ভ্যাকসিন। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, তিন বছর ধরে দেশে জরায়ু ক্যানসারের ভ্যাকসিন সেরাভিক্স আমদানি বন্ধ। এ সুযোগটি কাএজ লাগিয়েছে চক্রটি। হেপাটাইটিস-বি ভ্যাকসিনের একটি অ্যাম্পুল খুলে অন্তত ১০টি জরায়ু ক্যানসারের নকল ভ্যাকসিন বানিয়ে বিক্রি করছিল চক্রটি। চোরাইপথে ভারত থেকে এই ভ্যাকসিন আনতে তাদের অ্যাম্পুলপ্রতি খরচ হয় ৩৫০ টাকা। একটি অ্যাম্পুল খুলে ১০টি অ্যাম্পুল বানানো হয়। পরে সেগুলোতে লাগিয়ে দেয়া হয় জরায়ু ক্যানসারের ভ্যাকসিন সেরাভিক্সের লেবেল। লেভেল লাগানোর পর প্রতিটি অ্যাম্পুল বিক্রি করা হয় আড়াই হাজার টাকা করে।

সম্প্রতি ঢাকার প্রায় ১৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষিকা, শিক্ষার্থীসহ ছয় হাজার নারীকে মাইকিং করে জরায়ু ক্যানসারের ওই ভ্যাকসিন দেয়া হয়। এভাবে প্রতারক চক্রটি কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

এতে করে উদ্বেগে ও স্বাস্থ্যহানির শঙ্কায় আছেন ওই নারী ও কিশোরীরা। ভুক্তভোগীসহ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন, ঢাকার মতো জায়গায় মাইকিং করে নামকরা ফাউন্ডেশনের নামে এতদিন ধরে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করল চক্রটি; অথচ কেউ দেখল না? স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাজ আসলে কী? 

জানা যায়, নকল এই ভ্যাকসিন নিয়ে কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। একজন ১৫ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার পর বাড়ি ফিরেছেন।

শিক্ষার্থীসহ প্রায় ছয় হাজার নারীকে নকল ভ্যাকসিন দেয়ার খবর প্রকাশের পর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। চিঠিতে ঔষধ প্রশাসন বা স্বাস্থ্য অধিদফতরের পূর্বানুমতি ছাড়া এ ধরনের ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রাম স্কুল-কলেজে না চালাতে অনুরোধ করা হয়েছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের অনুমতি ছাড়া স্কুল-কলেজে ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রাম আয়োজন থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।

ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ স্বাক্ষরিত চিঠির অনুলিপি দেয়া হয়েছে সব জেলা প্রশাসক, সিভিল সার্জন, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও সব জেলার ওষুধ প্রশাসনকে। তাতে বলা হয়েছে, সেরাভিক্স ভ্যাকসিন নকল পাওয়া গেছে। আন-রেজিস্টার্ড হেপাটাইটিস-বি’র ভ্যাকসিনের ভায়াল থেকে খালি ভায়ালে আংশিক ভরে সেরাভিক্স ভ্যাকসিনের লেবেল লাগিয়ে একটি চক্র নকল করছে। গত ১৮ মার্চ ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর মীরপুরের দারুসসালামের ডা. এ আর খান ফাউন্ডেশন থেকে নকল ভ্যাকসিনের আলামত পেয়েছে। গাজীপুর জেলার বিভিন্ন স্কুল-কলেজে নকল ভ্যাকসিনের প্রচারণা করা হয়েছে।

বিশ্বব্যাপী জরায়ু মুখের ক্যানসারের প্রবণতা কমলেও বাংলাদেশে নারীদের ক্যানসারের মধ্যে জরায়ু ক্যানসার দ্বিতীয় স্থানে আছে। গ্লোবোকন ২০২০-এর তথ্য মতে, প্রতিবছর আট হাজার ৬৮ জন নারীর জরায়ু ক্যানসার শনাক্ত হয় এবং পাঁচ হাজার ২১৪ জনের প্রতিবছর মৃত্যু হয়। বাংলাদেশে ১৫ বছর থেকে শুরু করে প্রায় পাঁচ কোটি ৪০ লাখ নারী জরায়ু ক্যানসার ঝুঁকির মধ্যে আছে। বাল্যবিবাহ, কম বয়সে বাচ্চা নেয়া, দুই বা তিনের অধিক বাচ্চা নেয়া, ধূমপান ইত্যাদি জরায়ুমুখের ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

রাজধানীর আজিমপুরের গভমেন্ট কলেজ অব এফলাইড উইমেন সায়েন্সের শিক্ষার্থী মারজান আক্তার মীম এই ভ্যাকসিন সরল বিশ্বাসে গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের বাসা মানিকদী। সেখানে মাইকিং করা হচ্ছিল, যারা জরায়ু ক্যানসারের ভ্যাকসিন নেননি তাদের স্বল্পমূল্যে দেয়া হবে। পাশাপাশি হেপাটাইটিস বি ’র ভ্যাকসিনও তারা দিচ্ছেন। এই শুনে আমি আর আমার ছোট বোন মানিকদী সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে জরায়ু ক্যানসারের ভ্যাকসিন নেই। আর আমার খালা নিয়েছেন হেপাটাইটিস বি’র ভ্যাকসিন। প্রথম ডোজ নেয়ার পর আমাদের তেমন কোন সমস্যা হয়নি। তবে দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার পর জ্বর এসেছিল। 

তিনি বলেন, জরায়ু ক্যানসারের ভ্যাকসিনের জন্য আমাদের কাছ থেকে আড়াই হাজার টাকা করে নিয়েছে। আর হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিনের জন্য খালার কাছ থেকে নিয়েছে ৩০০ টাকা। তারা আসলে মিরপুর দারুস সালামের ডা. এ আর খান ফাউন্ডেশন, দক্ষিণখানের আল নূর ফাউন্ডেশন ও চেরাগ আলীর পপুলার ভ্যাকসিনেশন সেন্টারের কথা বলছিল। যে কারণে আমাদের সন্দেহ হয়নি।

ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের (ডিবি) উপ-কমিশনার গোলাম সবুর বলেন, ঢাকার একটি জায়গায় ভ্যাকসিন দিতে আসা লোকদের আটকে রেখেছে নারীরা। ওই ভ্যাকসিন নিয়ে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এমন খবর পেয়ে আমরা সেখানে যাই। প্রাথমিকভাবে তাদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে আমরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করি। পরে জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করে এতদিন ধরে নকল ভ্যাকসিন দিয়েছে। তখন আমরা অনুসন্ধান শুরু করি। সর্বশেষ সোমবার এই চক্রের হোতা হিমেলকে আমরা গ্রেফতার করি। ঢাকার দক্ষিণখানে ও কেরানীগঞ্জে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এই ভ্যাকসিন বানানো হচ্ছিল। আমরা খুব শিগগিরই পুরো চক্রকে ধরে ফেলব।

পুলিশ কর্মকর্তা গোলাম সবুর বলেন, প্রায় ছয় হাজার নারীর কাছে জনপ্রতি তিনটি করে ১৮ হাজার অ্যাম্পুল ভ্যাকসিন বিক্রি করে চক্রের সদস্যরা। এর মাধ্যমে তারা হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা। গ্রেফতারকৃতরা স্বীকার করেছে, ঢাকা ও আশপাশের প্রায় ১৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভ্যাকসিনেশন ক্যাম্প করে নকল টিকা দেয়া হয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী, শিক্ষিকা ও অভিভাবকদের কাছে নকল ভ্যাকসিনের তিনটি করে ডোজ বিক্রি করেছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের ঢাকা বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন বলেন, একটি প্রতিষ্ঠানও আমাদের কাছ থেকে কোন অনুমতি নেয়নি। ফলে আমরা এসবের কিছুই জানি না।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, নকল ভ্যাকসিন দেয়া তো সরাসরি ফৌজদারি অপরাধ। যারাই এটি করে থাকুক তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ। কারণ নকল এই ভ্যাকসিনে যদি শুধু পানি ব্যবহার করে তাহলে খুব বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই। তবে মানসিক ক্ষতি ভয়াবহ। একজন নারী যখন জানবেন তিনি যে ভ্যাকসিন নিয়েছেন সেটি নকল, তাহলে কী পরিমাণ মানসিক চাপে তিনি পড়বেন সেটি তো বুঝতেই পারছেন। এ ব্যাপারে কঠোর মনিটরিং দরকার।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, একটি অপরাধী চক্র খোদ ঢাকা শহরে এভাবে ভ্যাকসিন দিয়ে বেড়ালো, সেটা কেউ দেখলো না! আমাদের স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাজ কী? তারা কোনোভাবেই এর দায় এড়াতে পারে না। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের এটি দেখার দায়িত্ব। যেহেতু তাদের জনবল নেই, ফলে স্বাস্থ্য অধিদফতর এটি। 

আপন দেশ/আরএ

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়