Apan Desh | আপন দেশ

সৃজনে কল্পনা, কল্পনায় সৃজন

আবু আফজাল সালেহ

প্রকাশিত: ১২:০২, ১২ মে ২০২৪

সৃজনে কল্পনা, কল্পনায় সৃজন

ছবি : সংগৃহীত

কল্পনা মানুষের অন্তর্লোকের এক অভিব্যক্তি। দেকার্ত বলেছেন, ভাবনাতেই মানুষের সত্তার পরিচয়- I imagine therefore I am. ভাবনা ও কল্পনার মধ্যে নিবিড় একটা সম্পর্ক রয়েছে। কল্পনা শুধু শিল্পসৃজনেই নয়, বিজ্ঞান বা অন্যান্য দৈনন্দিন কাজে লাগে। বিজ্ঞানীর কল্পনার পাখায় আবিষ্কার হয় অনেক কিছু, জীবনযাত্রাকে সুন্দর ও মসৃণ করতে কল্পনার প্রয়োজন। মানুষের সমস্ত কর্মপরিকল্পনা মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

মস্তিষ্ক প্রতিনিয়ত ইমেজ বা রূপকল্প উৎসারিত করে থাকে। স্বপ্নের ওপর চেতনমনের বা সত্তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। মস্তিষ্ক এলোমেলো রূপকল্প নির্গত করে। মাইকেল মধুসুদন দত্ত কল্পনাকে ‘দেবী সরস্বতীর একান্ত সহচর’ বলেছেন। এক সনেটে বলেছেন, ‘সেই কবি মোর মতো কল্পনাসুন্দরী যার মনঃকলমেতে পাতেন আসন’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ‘এ কথা একটা চিরসত্য যে, যাদের কল্পনাশক্তি আছে তার সৌন্দর্যকে নির্জীবভাবে দেখতে পারে না। তারা অনুভব করে যে, সৌন্দর্য যদিও বস্তুকে অবলম্বন করে প্রকাশ পায়, কিন্তু তা যেন বস্তুর অতীত, তার মধ্যে যেন একটা মনের ধর্ম আছে’ (লোকেন্দ্রনাথ পালিতকে লেখা চিঠি/বৈশাখ, ১২৯৯)। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘কবির কল্পনাসচেতন হৃদয় যতই বিশ্বব্যাপী হয় ততই তাহার রচনার গভীরতায় আমাদের পরিতৃপ্তি বাড়ে।’ (সাহিত্যের তাৎপর্য/সাহিত্য)।

কল্পনার ওপর বাস্তবের নিয়ন্ত্রণ যতটা শিথিল হয় কল্পনার ডানা ততই বাড়তে পারে, স্বতঃস্ফূর্ত হয়, আলাদা হয়। শিশুদের কৌতূহল বা বিশ্ময়বোধই  জ্ঞানী-জ্ঞানী ভাব দেখায়। কবি বা শিল্পী বা যেকোনো সৃষ্টিকর্তার জন্য কল্পনা গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়- বিশেষকরে সৃজন প্রক্রিয়ায়। সৃজনে কল্পনা ক্রমশ বিস্তার লাভ করে থাকে। সচেতন ভাবনার ক্ষেত্রে সব বাধা অতিক্রম করিয়ে দিতে পারে কল্পনা। প্রবল ইচ্ছেশক্তির সমন্বয়ে কল্পনা হয়ে ওঠে স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বয়ংক্রিয়। কল্পনাকে ব্যবহার যিনি যত করতে পারবেন বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন তার সৃজনকর্ম ততই বিস্তৃতি বা মহৎ হবে। এই কল্পনা কোথা থেকে আসে?- জীবনানন্দ বলেছেন, ‘পরমেশ্বরের কাছ থেকে’। জীবনানন্দ দাশ বলেন, ‘সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি; কবি-কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্য-বিকিরণ তাদের সাহায্য করছে। কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয়; নানারকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করার অবসর পায়।’ (প্রথম প্যারা, কবিতার কথা)

মনের মধ্যের ইমেজে সংঘটিত সমস্ত প্রক্রিয়াকে কল্পনা বলা হয়। এই প্রক্রিয়াটি সর্বোচ্চ মানসিক স্তরে একজন ব্যক্তির পার্শ্ববর্তী বিশ্বকে প্রতিফলিত করে। কল্পনা  একটি মানসিক প্রক্রিয়া-যার মাধ্যমে নতুন অনন্য চিত্র তৈরি করা হয়। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, বিভিন্ন ধরনের কল্পনা রয়েছে: সক্রিয় (স্বেচ্ছাসেবী), নিষ্ক্রিয় (অনিচ্ছাকৃত), বিনোদনমূলক, সৃজনশীল। কল্পনা আশেপাশের জ্ঞানের একটি প্রক্রিয়া। সৃজনশীল এবং কাজের প্রক্রিয়ায়, কল্পনা ব্যক্তিকে তার ক্রিয়াকলাপগুলো নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা করতে পারে। সেইসাথে তার বক্তৃতা, আবেগ, মনোযোগ এবং স্মৃতি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম করে। বাস্তবের ছবি তৈরি এবং ব্যবহার করতে সাহায্য করে। এটি একজন ব্যক্তির মনস্তাত্বিক অবস্থার উন্নতি করে, চাপ এবং বিষণ্নতা প্রতিরোধ করে। কল্পনাশক্তির সাহায্যে সে তার ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা করতে সক্ষম হয়। কল্পনা মানুষের মানসিকতার একটি বিশেষ রূপ, উপলব্ধি, স্মৃতি এবং চিন্তা প্রক্রিয়ার মধ্যে একটি স্থান দখল করে।

সৃজনশীল কল্পনা সক্রিয়-কল্পনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এটি সৃজনশীল  কার্যকলাপ, শিল্প, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিগত কার্যকলাপে নতুন চিত্র গঠনের সাথে জড়িত। এই চিত্রগুলি সৃজনশীল ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, জীবনের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি, শৈল্পিক শৈলীকেও প্রতিফলিত করে। একটি স্বপ্ন, ভবিষ্যতে যা কাক্সিক্ষত তার প্রতিনিধিত্ব হিসেবে। অনিচ্ছাকৃত স্বপ্নের বিপরীতে এটি অর্থপূর্ণভাবে তৈরি করা হয়েছে। একজন ব্যক্তি সচেতনভাবে তার চিন্তাগুলোকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যগুলো গঠনের জন্য নির্দেশ করে, এই লক্ষ্যগুলি অর্জনের জন্য কৌশলগুলো পরিকল্পনা করে এবং সেগুলিকে বাস্তব জীবনে অনুবাদ করে, স্বপ্ন দেখা সহায়ক হতে পারে। সৃজনশীলতা হলো কাজ এবং সমস্যা সমাধানের জন্য মৌলিকভাবে নতুন বা উন্নত পদ্ধতি তৈরি করার প্রক্রিয়া। এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে কল্পনা এবং সৃজনশীল প্রক্রিয়া খুব আন্তঃসংযুক্ত। কল্পনাকে এখানে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণার রূপান্তর এবং এর ভিত্তিতে নতুন চিত্র তৈরি করা। সৃজনশীল চিন্তাভাবনা এবং কল্পনার নিজস্ব নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, বিষয়ের নিজস্ব ধারণা এবং চিন্তার ওপর ভিত্তি করে সম্পূর্ণ নতুন অনন্য উপস্থাপনা তৈরি করা সম্ভব; যাতে স্রষ্টার ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করা হয়।

কল্পনার ক্রিয়া আর স্মৃতির গতি একত্রিত করে সুন্দর সুন্দর ইমেজ তৈরি করে থাকে। বাস্তব (জ্ঞাত রূপ) আর কল্পনা (অজ্ঞাত রূপ/স্মৃতি) মিলিয়েই এ কাজ চলে। সৃজনশীল কল্পনার বিকাশ তিনটি পর্যায়ে ঘটে। প্রথমটি একটি সৃজনশীল ধারণা। প্রথমে, স্রষ্টার মনে একটি অস্পষ্ট চিত্র উপস্থিত হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ‘ধারণা লালন’ জড়িত। একজন ব্যক্তি একটি  ধারণাকে বাস্তবে রূপান্তর করার কৌশল সম্পর্কে চিন্তা করেন, মানসিকভাবে এটিকে উন্নত করে। তৃতীয় পর্যায়টি ধারণার লালনকে সম্পূর্ণ করে এবং এটিকে জীবন্ত করে তোলা। 

দর্শনে একটি ধারণা রয়েছে, আমরা যা কিছু তৈরি করি তা কোথাও থেকে আসেনি। এটি ইতোমধ্যে বিদ্যমান জ্ঞান। কিন্তু টুকরো টুকরো শব্দ এবং অণুগুলো যেগুলো একসময় কারো মনে জড়ো হয়েছিল তা মিশে গিয়েছিল এবং সম্পূর্ণ নতুন রূপে মিলিত হয়েছিল। কল্পনার জীবন্ত আদেশ-যা মিলন ও মধ্যস্থতাকারী শক্তি, যার অন্তর্ভুক্ত-কারণকে ইন্দ্রিয়ের চিত্রে উপস্থাপন করা এবং ইন্দ্রিয়ের প্রবাহকে সংগঠিত করা হয়।  কোলরিজের সংজ্ঞা অনুসারে, ওয়ার্ডসওয়ার্থ কল্পনাকে reason in its most exalted mood (Prelude XIV) এবং the noblest faculty of our nature (Defense of Poetry) বলে অভিহিত করেছেন।

আপন দেশ/এমআর

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়