Apan Desh | আপন দেশ

মসলিন শাড়ির যুগ ফিরে এসেছে!

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১০:৪৮, ২৪ মার্চ ২০২৪

মসলিন শাড়ির যুগ ফিরে এসেছে!

ছবি : সংগৃহীত

ঐতিহ্যবাহী মসলিন শাড়ি তৈরি কখন শুরু তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে ধারণা করা যায় তা প্রায় ৩০০ বছরের  পুরনো। এই যুগে এসে মসলিন শাড়ি তৈরির দাবি করছেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ নোয়াপাড়া এলাকার আল আমিন তাঁতি। 

৩০০ থেকে ৪০০ কাউন্টের সুতা দিয়ে নানা ডিজাইনের মসলিন শাড়ি তৈরি করে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্রি করার দাবি করছেন তিনি।  শিগগির ৫০০ কাউন্টের সূক্ষ্ম সুতা দিয়ে মসলিন শাড়ি তৈরির কাজ শুরু করবেন তিনি। তবে এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে স্বীকৃতি পাননি এই তাঁতি। তবু মসলিন শাড়ি নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন তিনি। এদিকে মসলিন শাড়ির বৈশিষ্ট্য নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের কর্মকর্তারা। এসব নিয়ে আল আমিনের সঙ্গে বিরোধের কথাও জানিয়েছেন তারা।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার নোয়াপাড়া বিসিক জামদানি পল্লিতে বসবাস আল আমিন। এ পর্যন্ত নয়টি মসলিন শাড়ি তৈরি করেছেন বলে দাবি করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ দৃক গ্যালারির সিইও সাইফুল ইসলামের অনুপ্রেরণায় ও সহায়তায় অনেক তাঁতিকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। তবে কোনো তাঁতি সফল হতে পারেননি। ওই সময় সাইফুল ইসলাম ভাই আমার কাছে চিকন সুতা নিয়ে আসেন এবং মসলিন শাড়ি বোনার কথা বলেন। এরপর থেকে আমার চেষ্টা শুরু হলো। তবে সূক্ষ্ম সুতার কারণে শাড়ি বুনতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। এভাবে প্রায় ছয় মাস পেরিয়ে গেল। সুতা ছিঁড়ে যাওয়ার বিড়ম্বনায় আরও প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে গেল। এ ছাড়া আর্দ্রতার একটি বিষয় রয়েছে। রোদ উঠলে সুতা ছিঁড়ে যেত। এ কারণে ভোর থেকে সকাল ৯টা এবং বিকাল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত কাজ চলে অবিরাম। তবে এতো ঝামেলার কারণে অনেকে মসলিন শাড়ি তৈরির কাজ বন্ধ করার পরামর্শও দিয়েছিল। আমি ধৈর্য্য ধরে চেষ্টা চালিয়ে গেছি। অবশেষে আরও নয় মাস চেষ্টা চালিয়ে একটি মসলিন শাড়ি তৈরি করতে সফল হই। ৩০০ কাউন্টের সুতা দিয়ে শাড়িটি তৈরি করা হয়। সেই শাড়ি ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর শাহবাগের জাদুঘরে এক্সিবিশনে ঠাঁই পেয়েছে। সেখানে পুরষ্কারও পেয়েছি। ওই এক্সিবিশনে আসা দর্শনার্থীদের মাধ্যমে বহু শাড়ি তৈরির অর্ডার পেয়েছি। তবে এত অর্ডার নেয়া সম্ভব নয়। কারণ একটি মসলিন শাড়ি তৈরি করতে প্রায় নয় মাস সময় লেগে যায়। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় জাদুঘরে মাসব্যাপী মসলিন প্রদর্শনীতে প্রায় এক লাখের বেশি দর্শনার্থী এসেছিলেন। দুই শতাধিকের বেশি ছিলেন বিদেশি কিউরেটর। সেখানে মসলিনভিত্তিক ফ্যাশন শো, কর্মশালা ও সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সেই প্রদর্শনীতে আল আমিনের মসলিন শাড়ি প্রদর্শিত হয়েছিল। উৎসবের অর্থায়নে দৃকের সঙ্গে ছিল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও ব্র্যাকের আড়ং।

সারাদেশের মধ্যে আল আমিন একমাত্র মসলিন শাড়ি তৈরির কারিগর দাবি করে বলেন, বাংলাদেশের মধ্যে এখন আমি একমাত্র মসলিন শাড়ি তৈরির তাঁতি (কারিগর)। এ ছাড়া আর কেউ এই শাড়ি তৈরি করতে পারে না, কিংবা কেউ পারলেও তা করতে চায় না। এর কারণ এই শাড়ি তৈরি করতে অনেক ধৈর্য্যের প্রয়োজন। তা ছাড়া এত ঝামেলা করে কেউ শাড়ি বুনতে চায় না। 

তিনি জানান, কয়েকবছর আগে রূপগঞ্জে সরকারিভাবে মসলিন শাড়ি তৈরির প্রকল্প চালু হয়েছিল, নানা কারণে সাত-আট মাস আগে সেই প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। 

তিনি বলেন, বহির্বিশ্বে এই মসলিন শাড়ির অনেক চাহিদা। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড (যুক্তরাজ্য), ভারত ও সিঙ্গাপুরে এই মসলিন শাড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এসব দেশ থেকে অনেক অর্ডার পেয়েছি। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ভারতে একাধিক ও বাংলাদেশে একটি শাড়ি বিক্রি করা হয়েছে। এ ছাড়া সিঙ্গাপুরে শাড়ির বিক্রির কথা চলছে।

আসন্ন ঈদুল ফিতরের আগে ফ্রান্স ও লন্ডনে চারটি মসলিন শাড়ির ডেলিভারি দেয়া হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত নয়টি মসলিন শাড়ি তৈরি করেছি। ৩০০ থেকে ৪০০ কাউন্টের সুতা দিয়ে এসব শাড়ি তৈরি করা হয়েছে। ভারতের মুর্শিদাবাদ থেকে ৩০০ কাউন্টের সুতা ১৫ হাজার রুপি ও ৪০০ কাউন্টের সুতা ২০ হাজার রুপি দিয়ে কিনে আনা হয়। দৃক গ্যালারির সাইফুল ইসলাম সর্বপ্রথম এই সুতার সন্ধান দিয়েছিলেন। ফুটি কার্পাস তুলা থেকে এই সুতা তৈরি করা হয়ে থাকে।

আরও পড়ুন <> রমজানে ঘুমের সমস্যা সমাধানে করণীয়

জানা যায়, আল আমিনের হাতে তৈরি প্রতিটি শাড়ির দৈর্ঘ্য ছয় গজ এবং প্রস্থ ৪৭ ইঞ্চি এবং ওজন প্রায় আড়াইশ গ্রাম। শাড়ির ডিজাইন ও সুতার কাউন্টের ওপর নির্ভর করে দাম কম-বেশি হয়ে থাকে। তবে আনুমানিক প্রত্যেকটি শাড়ি তৈরিতে তিন থেকে চার লাখ টাকা খরচ হয়। এই খরচের টাকা দৃক গ্যালারির সিইও সাইফুল ইসলাম দিয়ে আসছেন। তবে শাড়ি বিক্রির সম্পূর্ণ টাকা তাকে দেয়া হয়। সম্প্রতি চারটি শাড়ির কাজ সম্পন্ন করেছেন। আসন্ন ঈদুল ফিতরের আগে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনে যাবে এসব শাড়ি। প্রতিটি শাড়ি পাঁচ-ছয় লাখ টাকায় বিক্রি হবে। ঈদের আগে প্রায় ২৫ লাখ টাকার মসলিন শাড়ি বিক্রি হবে বলে জানান আল আমিন।

মসলিন তৈরির কারিগর আল আমিনের বাড়ি ঘুরে দেখা গেছে, তার বাড়িতে ‘বেঙ্গল মসলিন কেন্দ্র’ নামে ছোট্ট একটি কক্ষে মসলিন কাপড়ের ইতিহাসসহ মসলিন কাপড়ের তৈরি রুমাল ও কাপড়ের প্রদর্শনী করা হয়েছে। এর পাশেই মসলিন ও জামদানি তৈরির কাজ চলছে।

বর্তমানে আল আমিন একমাত্র মসলিন শাড়ি তৈরির তাঁতি উল্লেখ করেন বিসিক জামদানি শিল্প নগরী ও গবেষণা কেন্দ্রের কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম। তিনি বলেন,  মসলিন শাড়ি শুধুমাত্র রূপগঞ্জে তৈরি করা হয়। এর মধ্যে সরকারিভাবে গড়ে ওঠা মসলিন শাড়ি তৈরির প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। তবে সেটি কেন বন্ধ হয়েছে তা বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড বলতে পারবে। আর এখন জামদানি বিসিক পল্লীতে বসবাসকারী আল আমিন নামে এক ব্যক্তি বেসরকারিভাবে মসলিন শাড়ি তৈরি করে। আমার জানা মতে, তিনি শুধু নারায়ণগঞ্জ জেলায় নয় সারা বাংলাদেশের মধ্যে একমাত্র মসলিন শাড়ি তৈরি করেন। তবে সরকারিভাবে সহযোগিতা করলে মসলিন শাড়ির ঐতিহ্য আরও প্রসার করা সম্ভব। তবে এটি কেন করছে না তা তাঁত বোর্ড বলতে পারবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ‘রূপগঞ্জে সরকারি প্রকল্পের অধীনে রিসার্চের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এতে তাঁতিসহ সাড়ে ৩০০ দক্ষ লোক তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩১৬ জন সুতা কাটার কর্মী এবং তাঁতি ও তার সহকারীসহ ৩৪ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। তারা সবাই এখন জামদানি শাড়ি তৈরির কাজ করছে। প্রকল্পের কাজ শুরু হলে তারা খুব শিগগিরই মসলিন শাড়ি তৈরির কাজ শুরু করবে।

মসলিন শাড়ি নিয়ে আল আমিনের সঙ্গে তাদের বিরোধ রয়েছে উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, দৃক গ্যালারির সাইফুল ইসলাম আমাদের রিসার্চ টিমের একজন সদস্য ছিলেন। আর মসলিন নিয়ে শুরু থেকে আল আমিন আমাদের সঙ্গে অনেক বিরোধিতা করেছেন। ওনি আমাদের রিসার্চের রেজাল্ট চেয়েছেন। আমরা তাকে দেইনি। সে যদি সত্যিকার অর্থে মসলিন তৈরি করতে পারতো তাহলে জিআই পেতো। মসলিন কাপড় তৈরি করতে তিনটি বৈশিষ্ট্য অবশ্যই থাকতে হবে। প্রথমত, ফুটি কার্পাস তুলা থেকে সুতা হতে হবে। দ্বিতীয়ত, হাতে চরকার তৈরি সুতা হতে হবে। তৃতীয়ত, পিট লুমে তৈরি হতে হবে। অথচ আল আমিন ভারত থেকে সুতা এনে মসলিন তৈরি করছেন। তবে সে ভালো মানের কাপড় তৈরি করছে।

অপন দেশ/এমআর

শেয়ার করুনঃ

জনপ্রিয়