Apan Desh | আপন দেশ

লবণের প্রভাব কাটিয়ে সবুজ ফসলের চাষাবাদ

খুলনা ব্যুরো

প্রকাশিত: ১০:১৮, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

লবণের প্রভাব কাটিয়ে সবুজ ফসলের চাষাবাদ

ছবি : সংগৃহীত

খুলনার দাকোপ ও বটিয়াঘাটা উপজেলার বেশিরভাগ জমিতে নোনাপানি ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষ হতো। কয়েক বছর আগে সামাজিক আন্দোলনের কারণে লবণপানিতে চিংড়ি চাষের ঘেরগুলো বন্ধ হতে শুরু করে। 

লবণের প্রভাব কাটিয়ে এলাকায় আবার ফিরতে থাকে সবুজ ফসলের চাষাবাদ। একসময়ের এক ফসলি আমন ধানের এলাকায় কৃষকের ভরসা হয়ে ওঠে সুস্বাদু তরমুজ। কম বিনিয়োগে দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ লাভ হওয়ায় দিনে দিনে নতুন নতুন কৃষক তরমুজ চাষে আগ্রহী হন। এখানকার কৃষকের কাছে তরমুজ হয়ে ওঠে স্বপ্নপূরণের ফসল। তারই ধারাবাহিকতায় এবার ৫৩টি স্লুইসগেট বন্ধ করে দিয়ে নতুন স্বপ্ন বুনছেন চাষিরা।

চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে দুই উপজেলার খালগুলোতে মিষ্টি পানি আছে। এখনো সমুদ্রের নোনাপানি প্রবেশ করেনি। এ অবস্থায় আশপাশের খালগুলোর ৫৩টি স্লুইসগেট বন্ধ করে দেয়া হয়। যাতে আগামী তিন মাস সমুদ্রের নোনাপানি স্লুইসগেট দিয়ে ঢুকে কৃষিজমিতে আসতে না পারে। এই সময়ের মধ্যে খালের মিষ্টি পানি সেচ দিয়ে স্বপ্নের ফসল তরমুজ ঘরে তুলবেন তারা।

চাষিরা জানিয়েছেন, একই পদ্ধতিতে গত পাঁচ বছর ধরে তরমুজ চাষ করে ভালো ফলন পেয়েছেন। অল্প সময়ে কম বিনিয়োগে দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ লাভ হওয়ায় তরমুজ চাষ করছেন। এর মধ্যে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছিল। এবারও রেকর্ড পরিমাণ জমিতে চাষাবাদের লক্ষ্য তাদের। তবে এবার সারের দাম বেড়েছে। এজন্য বেশি খরচ হবে। ২০২৩ সালে অনেক চাষি আগেভাগে তরমুজ চাষ করে লাভবান হয়েছেন। এজন্য এবার আগেভাগে চাষ শুরু করেছেন।

দাকোপ উপজেলার কৈলাশগঞ্জ, লাউডোব ও বটিয়াঘাটা উপজেলার কাতিয়ানাংলা এলাকায় দেখা গেছে, চাষিরা জমি তৈরি করে তরমুজের বীজ রোপণ করছেন। কেউ কেউ আগাম ফলন পাওয়ার আশায় আধুনিক পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করেছেন। দেড় থেকে দুই ইঞ্চি লম্বা হলেই চারাগুলো জমিতে রোপণ করছেন।

তরমুজ চাষে এলাকার মানুষের ভাগ্য ফিরেছে জানিয়ে দাকোপ উপজেলার নগেন দাশ ও মো. রাব্বি মিয়া জানিয়েছেন, এখন খালে মিষ্টি পানি থাকায় স্লুইসগেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যাতে চাষের শুরুতেই জমিতে মিষ্টি পানি দেয়া যায়। মিষ্টি পানিতে তরমুজ ভালো এবং সুস্বাদু হয়। নোনাপানি ঢুকলে সব নষ্ট হয়ে যায়। গত কয়েক বছর মিষ্টি পানিতে তরমুজ চাষ করে এই এলাকার মানুষ স্বাবলম্বী হয়েছেন।

দাকোপের সুদীপ মল্লিক বলেন, ‘এবার সারের দাম ও শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে। তাই কিছুটা দুশ্চিন্তায় আছি। তারপরও আগাম তরমুজ চাষ করছি। নোনাপানি ঠেকাতে খালের স্লুইসগেটগুলো আটকে দেওয়া হয়েছে। ফলে আগামী তিন মাস নোনাপানি ঢুকবে না। এই সময়ের মধ্যে সবার ফলন ঘরে উঠে যাবে।’

গত বছর শ্রমিকদের ঘণ্টায় মজুরি ছিল ৬০ টাকা উল্লেখ করে এই চাষি আরও বলেন, ‘এ বছর ৭০ টাকা করে দিতে হচ্ছে। এর সঙ্গে সারের বস্তায় ৩০০-৪০০ টাকা বেশি দিতে হয়। কিন্তু ডিলাররা চালানে সরকার নির্ধারিত দামই লিখে দেন। নগদ টাকা দেয়ার সময় বাড়তি টাকা দিতে হয় ডিলারদের। ফলে আমরা প্রমাণ দিতে পারি না। এ নিয়ে কথা বললে ডিলাররা সার দেন না। ফলে নিরুপায় হয়ে বেশি দাম দিয়ে কিনছি।’

তরমুজের ক্ষেতে কাজ করা দাকোপের দিনমজুর পুর্ণিমা মন্ডল বলেন, ‘এ বছর ঘণ্টায় ১০ টাকা বাড়িয়ে ৭০ টাকা নিচ্ছি। নারী-পুরুষের মজুরি সমান। গত বছর ঘণ্টায় ৬০ টাকা নিয়েছিলাম। এবার সব কিছুর দাম বেড়েছে। বিশেষ করে নিত্যপণ্যের দাম অনেক বেশি। সে হিসাবে মজুরি ১০ টাকা তেমন বেশি নয়।’

২০২১ সালে ১১ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করে নানা কারণে লোকসান দিতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন বটিয়াঘাটা উপজেলার মো. নুর ইসলাম শেখ। তিনি বলেন, ‘তবে ২০২২ সালে আগাম তরমুজ চাষ করে লাভবান হয়েছি। এজন্য এ বছরও আগাম চাষ করছি। ১২ থেকে ১৪ লাখ টাকার তরমুজ বিক্রির আশা করছি।’

এবার ১০ বিঘা জমিতে আগাম তরমুজ চাষ করেছেন একই উপজেলার চাষি মো. মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, ‘গত বছর রমজান মাস শেষ হওয়ার পর তরমুজের দাম কমে গিয়েছিল। ক্ষেতেই অনেক ফলন নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এজন্য এবার আগাম চাষ করছি। আশা করছি, লাভবান হবো।’

আরও পড়ুন <> ভিনদেশি সফেদা চাষে সফল হজরত

চাষিদের কাছ থেকে সারের দাম বেশি নেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানালেন দাকোপ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘দাকোপে ৯০ জন ডিলার আছেন। প্রত্যেকের দোকানে মূল্য তালিকা টানানো আছে। অতিরিক্ত দাম নিলে আমরা জানতে পারলে অবশ্যই ডিলারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো। চাষিদের মূল্য তালিকা অনুযায়ী দাম দিতে সক্রিয় থাকতে হবে। কেউ বেশি রাখলে আমাদের জানালেই ব্যবস্থা নেবো।’

নোনাপানি খালে ওঠা বন্ধ করতে ৫৩টি স্লুইসগেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে জানিয়ে এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ‘৮০-৯০ দিনের জন্য স্লুইসগেটগুলো বন্ধ থাকবে। এতে চাষিরা উপকৃত হবেন। এই পদক্ষেপের কারণে গত পাঁচ বছর ধরে তরমুজ চাষে সফলতা পাচ্ছেন চাষিরা। এ বছর দাকোপে সাত হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে তরমুজ চাষ হবে। গত বছর সাড়ে ছয় হাজার হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছিল।’

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘দাকোপ ও বটিয়াঘাটা উপজেলার স্লুইসগেটগুলো বন্ধ করে নোনাপানি ঠেকিয়ে তরমুজ চাষিদের উপযোগী করে দেয়া হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়ে চাষিদের স্বার্থে এই পদক্ষেপ নিচ্ছি আমরা। এতে তেমন কোনো সমস্যা হয় না।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর খুলনার উপপরিচালক কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘খুলনায় এ বছর ১২ হাজার ২২৫ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে কয়রায় দুই হাজার ২১০ হেক্টর, পাইকগাছায় ৪০০ হেক্টর, দাকোপে ৫০ হেক্টর ও বটিয়াঘাটায় ১০ হেক্টর। ইতোমধ্যে দুই হাজার ৬৮০ হেক্টর জমিতে আগাম তরমুজ চাষ হয়েছে। বেশিরভাগ চাষি ইতোমধ্যে বীজ রোপণ শুরু করেছেন।’

২০২১-২২ অর্থবছরে খুলনায় ১৩ হাজার ২৯০ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছিল জানিয়ে কৃষি কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন আরও বলেন, ‘সে বছর কিছু চাষি লোকসানে পড়েছিলেন। ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১২ হাজার ২২৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছিল। এর মধ্যে দাকোপে ছয় হাজার ৩২০ হেক্টর, বটিয়াঘাটায় তিন হাজার ১০০ হেক্টর, পাইকগাছায় এক হাজার ২৪৭ হেক্টর, কয়রায় এক হাজার ২০০ হেক্টর, ডুমুরিয়ায় ৩৫০ হেক্টর, তেরখাদায় তিন হেক্টর, রূপসায় তিন হেক্টর ও দৌলতপুরের এক হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছিল।’

আপন দেশ/এমআর

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়