Apan Desh | আপন দেশ

“ভারতের প্রমোদতরী ‘গঙ্গাবিলাস’ বিপন্ন করবে বাংলাদেশের ডলফিন”

আপন দেশ ডেস্ক

প্রকাশিত: ২৩:৫৪, ১৪ জানুয়ারি ২০২৩

আপডেট: ১৮:৩১, ১৫ জানুয়ারি ২০২৩

“ভারতের প্রমোদতরী ‘গঙ্গাবিলাস’ বিপন্ন করবে বাংলাদেশের ডলফিন”

সংগৃহীত ছবি

বিশ্বের দীর্ঘতম নদী-নৌবিহারে বিপন্ন হবে বাংলাদেশের গাঙ্গেয় ডলফিন। পরিবেশবিদ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণবিদেরা এনিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদী-ভিত্তিক এই পর্যটনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিপন্ন গাঙ্গেয় ডলফিনের প্রাকৃতিক আবাস। নৌবিহারের যাত্রাপথে মিঠাপানির স্তন্যপ্রায়ী এ প্রজাতিটির এধরনের একাধিক সংরক্ষিত প্রাকৃতিক আবাস রয়েছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শুক্রবার (১৩ জানুয়ারি)  বিশ্বের দীর্ঘতম নদী-ভিত্তিক নৌবিহারের (রিভার ক্রুজের) উদ্বোধন করেছেন। ভারতের উত্তর প্রদেশের বারাণসী থেকে গঙ্গা নদীতে যাত্রা শুরু করে– বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত নৌপথ পাড়ি দিয়ে– আবার ভারতের আসামে ডিব্রুগড়ে গিয়ে শেষ হবে এই নৌবিহার। খবর দ্য গার্ডিয়ানের

এই যাত্রাপথের মোট দৈর্ঘ্য তিন হাজার ২০০ কিলোমিটার। সময় লাগবে মোট ৫১ দিন। যাত্রাপথে পাড়ি দেবে মোট ২৭টি নদী। 

ভারত সরকার দেশটিতে নৌ-পর্যটনকে উৎসাহিত করছে। তারই অংশ এ নৌবিহার সেবা। উদ্বোধনকালে গঙ্গায় প্রমোদতরী শিল্পকে ভারতের পর্যটন খাতের এক 'মাইলফলক মুহূর্ত' বলেও উল্লেখ করেন মোদি। তবে পরিবেশবিদ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণবিদেরা এনিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, নদী-ভিত্তিক এই পর্যটনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিপন্ন গাঙ্গেয় ডলফিনের প্রাকৃতিক আবাস। 

বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অংশের ওপর দিয়েও চলাচল করবে এই প্রমোদতরী, যার মধ্যে আছে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবনও। এদেশে আরো বিপন্ন গাঙ্গেয় ডলফিনরা। জলজ এই স্তন্যপায়ী প্রাণী এদেশে স্থানীয়ভাবে 'শুশুক' নামেও পরিচিত। দেশের প্রধান নদীগুলোতে এখন তাদের দেখা যায় কালেভদ্রে। চট্টগ্রামের হালদা নদী এবং পদ্মা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্র ও এর শাখা নদীগুলোতে বিশ্বের মহাবিপন্ন প্রাণী মিঠাপানির গাঙ্গেয় ডলফিন (শুশুক) ও ইরাবতি ডলফিনের আবাসস্থল। কিন্তু, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কারণে এসব ডলফিন বিলুপ্তির পথে। 

সে তুলনায় ভারতে এদের সংরক্ষণের উদ্যোগ বেশ জোরালো। রয়েছে ডলফিনের জন্য সংরক্ষিত অঞ্চল। যেমন বারাণসী থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে গঙ্গা ও গোমতি নদীর সঙ্গমস্থল। এখানে গভীর পানি ও শান্ত স্রোত বিপন্ন ডলফিন প্রজাতিটির জন্য নিরাপদ আবাস তৈরি করেছে। গত অক্টোবরে ভারতের বন্যপ্রাণী কর্মকর্তারা এখানে বাচ্চসহ ডলফিনের একটি বড় ঝাঁক প্রত্যক্ষ করেন। তাদের ধারণা, দুই নদীর সঙ্গমস্থলে ৩৫-৫৯টি গাঙ্গেয় ডলফিন রয়েছে। অথচ যাত্রাপথে এদিক দিয়েই যাবে এমভি গঙ্গাবিলাস। 

নৌবিহারের যাত্রাপথে মিঠাপানির স্তন্যপ্রায়ী এ প্রজাতিটির এধরনের একাধিক সংরক্ষিত প্রাকৃতিক আবাস রয়েছে। এমন আরেকটি বিচরণক্ষেত্র হলো বিহারের 'বিক্রমশীলা গাঙ্গেয় ডলফিন অভয়ারণ্য'।  

দক্ষিণ এশিয়ায় মিঠা পানির ডলফিনের মাত্র দুটি প্রজাতি রয়েছে। এরই একটি হলো গাঙ্গেয় ডলফিন, প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম প্লাটানিস্টা গ্যাঞ্জেটিকা (Platanista gangetica)।  আরেকটি প্রজাতি হলো সিন্ধু নদীর- প্লাটানিস্টা মাইনর (Platanista minor),এদের প্রাকৃতিক নিবাস পাকিস্তান এবং উত্তর ভারতের বিয়াস নদী। এরমধ্যে পানিদূষণ, অতিরিক্ত পানি উত্তোলন ও চোরাশিকারের মতো নানান হুমকির মুখে রয়েছে গাঙ্গেয় ডলফিন। জেলেদের জালে জড়িয়েও অনেক সময় তাদের মৃত্যু হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে তাদের স্থানীয়রা অহেতুক হত্যা করে। তাই সংরক্ষিত প্রাকৃতিক আবাসগুলোকে রক্ষা করা এই প্রজাতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য অপরিহার্য বলে মনে করেন পরিবেশবাদীরা।

ভারতের একজন বিশিষ্ট প্রাণী সংরক্ষণবিদ হলেন রবীন্দ্র কুমার সিনহা। ১৯৯০ এর দশকে তার প্রচেষ্টার ফলেই গাঙ্গেয় ডলফিনের গুরুত্বপূর্ণ বিচরণক্ষেত্রগুলোকে সংরক্ষিত অঞ্চলের স্বীকৃতি দেয় সেদেশের সরকার। এই বিশেষজ্ঞ বলছেন, 'বর্তমানে একাধিক হুমকির মুখে রয়েছে এ ডলফিন। তার ওপর নৌবিহারের এ আয়োজন হবে আরো বিপজ্জনক'। 

তিনি জানান, সংরক্ষণ প্রচেষ্টার কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ভারতে সংখ্যায় বেড়েছিল গাঙ্গেয় ডলফিনেরা। পাশাপাশি পানি দূষণ কমানোর প্রচেষ্টাও এর পেছনে অবদান রাখে। বর্তমানে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রে তাদের জনসংখ্যা প্রায় তিন হাজার ২০০ এবং ৫০০টি। কিন্তু, নৌবিহার পর্যটন এই অর্জনকে নস্যাৎ করে দেবে বলে মনে করছেন তিনি। 

সিনহার ধারণা, এর ফলে চীনের বেইজি ডলফিনের পরিণতি হতে পারে গাঙ্গেয় ডলফিনের। প্রসঙ্গত, ইয়াংজি নদীর পানি অত্যধিক দূষণের কারণে ডলফিনের এই প্রজাতিটি হারিয়ে যায়। ২০০৬ সালে প্রজাতিটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। 

পানিতে শব্দকম্পন ব্যবহার করে একে-অন্যের সাথে যোগাযোগ, মাছ শিকার ইত্যাদি করে ডলফিন। ফলে তাদের জীবনপ্রক্রিয়া খুবই শব্দ-সংবেদনশীল। সিনহা বলেছেন, 'প্রমোদতরী চলাচলের ফলে উৎপন্ন শব্দে প্রচণ্ড নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তাদের ওপর। কারণ, তারা খুবই শব্দ-সংবেদনশীল প্রাণী'। 

বিষয়টির আরো ব্যাখ্যা দেন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান সেটেলমেন্টের ইকোহাইড্রোলজিস্ট জগদীশ কৃষ্ণমূর্তি। তিনি জানান, গাঙ্গেয় ডলফিনদের দৃষ্টিশক্তি এতটাই ক্ষীণ, যে তাদের 'প্রায় অন্ধ'ই বলা যায়। নদীর ঘোলা পানিতে চলাচল ও খাদ্য সন্ধানে তারা ইকোলোকেশন বা সন্ধানী শব্দতরঙ্গ ব্যবহার করে। 

'মালবাহী নৌযান, নৌবিহারের প্রমোদতরী এবং বিভিন্ন ধরনের মোটরবোটের চলাচলে নদীর পানিতে শব্দদূষণের মাত্রা বাড়ছে। মানবসৃষ্ট বা যান্ত্রিক শব্দতরঙ্গ ডলফিনের ইকোলোকেশনকে ব্যাহত করে তাদের জীবনধারণকে দুঃসাধ্য করে তুলছে'। 

২০১৯ সালের এক গবেষণায় ডলফিনদের শব্দতরঙ্গ শনাক্ত করতে বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করেন কৃষ্ণমূর্তিসহ আরো তিন গবেষক। এসময় তারা লক্ষ করেন, মোটরচালিত নৌযানের শব্দদূষণের ফলে গাঙ্গেয় ডলফিনদের শব্দতরঙ্গ প্রতিক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। 

আরও পড়ুন<<>> বিশ্বের দীর্ঘতম প্রমোদতরী গঙ্গা বিলাসের যাত্রা শুরু

যেমন নৌযানের টানা শব্দদূষণের কারণে তাদের আরো ঘন ঘন ইকোলোকেশন ব্যবহার করতে হয়। এতে শক্তিক্ষয় হয় এবং এক পর্যায়ে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে, যা আবার ডলফিনের খাদ্য সন্ধানের আচরণ বদলে দেয়। তখন হারানো শক্তি পুনরুদ্ধারের তাদের আরো বেশি বেশি খেতে হয়। আবার চলাচলের সময় ইকোলোকেশন তরঙ্গ নৌযানের শব্দে দীর্ঘক্ষণ ব্যাহত হলে, নৌযানের সাথে তাদের ধাক্কা লাগার ঘটনা ঘটে। অনেক সময় তারা প্রপেলারের জড়িয়ে মারাত্মক আহত হয়ে মারা যায়।

এর আগে ২০০৯ সালে বারাণসী থেকে কলকাতা পর্যন্ত চালু করা হয় নৌবিহার পর্যটন। তবে সম্প্রতি ভারতের অভ্যন্তরীণ জলপথগুলো উন্নয়নে গঙ্গা নদীতে 'জলমার্গ বিকাশ প্রকল্প' বা 'ন্যাশনাল ওয়াটারঅয়ে-১' নামক একটি প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে বিশ্বব্যাংক। এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রাপ্ত সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে নদীপদে পর্যটন ও মালবাহী যান চলাচল বৃদ্ধি করেছে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি- বিজেপি সরকার। তাদের দাবি, 'পরিবেশ-বান্ধব উপায়ে' এই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। 

এমভি গঙ্গাবিলাস প্রমোদতরীর পরিচালক প্রতিষ্ঠান- অন্তরা ক্রুজেস। প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং ডিরেক্টর কাশিফ সিদ্দিকী জানান, এমভি গঙ্গাবিলাস এতটা জনপ্রিয়তা লাভ করেছে যে, আগামী দুই বছরের জন্য সব টিকেট বিক্রি হয়ে গেছে। তার দাবি, 'আমরা সরকারি বিধিমালা মেনে সব ধরনের পরিবেশত সতর্কতা পালন করছি'। 

এই নৌবিহারের প্রচরণায় বলা হয়েছে, 'সুপ্রাচীন এই নদীপথকে সম্ভ্রভ জানাতে টেকসই নীতিকে কেন্দ্রে রেখে গঙ্গাভিলায় দূষণ রোধ ও শব্দ নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তিকে যুক্ত করা হয়েছে। 

গঙ্গার ন্যাশনাল ওয়াটারঅয়ে-১ এবং ব্রহ্মপুত্রে ন্যাশনাল ওয়াটারঅয়ে-২ নদীপথে প্রায় ১০০টি প্রমোদতরী সেবা পরিচালিত হচ্ছে। এই সংখ্যা ১০ গুণ বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়েছে ভারত সরকার।

পরিবেশবিদরা বলছেন, এই হারে নৌপর্যটন বাড়লে, নদীর প্রাকৃতিক বাস্তসংস্থানের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। 

ইতোপূর্বে বারাণসীর কাছে গঙ্গা নদীর কচ্ছপদের জন্য ৭ কিলোমিটার বিস্তৃত একটি সংরক্ষিত অঞ্চলকে অভয়ারণ্য তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। সমালোচকরা বলছেন, নৌপথের (বাণিজ্যিক) উন্নয়নের জন্য এই এলাকাটি উন্মুক্ত করে দিতেই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। 

মোটরচালিত নৌযানের শব্দদূষণের ফলে গাঙ্গেয় ডলফিনদের চলাচল ও মাছশিকার ব্যাহত হয়। গঙ্গায় ন্যাশনাল ওয়াটারঅয়ে-১ নৌপথে প্রমোদতরীগুলোর চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত গভীরতা নিশ্চিত করতে ড্রেজিং করাও হচ্ছে। ড্রেজিং এর উচ্চ শব্দের বিরূপ প্রভাব নিয়েও উদ্বিগ্ন পরিবেশবিদেরা। 

যদিও ভারতের অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল কর্তৃপক্ষের এক পরিবেশগত পর্যলোচনা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ড্রেজিংয়ের শব্দদূষণের ফলে মাছ, ডলফিন ও কচ্ছপদের আচরণে 'উল্লেখযোগ্য প্রভাব হয়তো পড়বে না'। আর তাদের মৃত্যু ঝুঁকিও আশঙ্কা করা হচ্ছে না, কারণ জলজ এসব প্রাণী 'সাধারণত ড্রেজিং যেখানে করা হচ্ছে, সেখান থেকে দূরে চলে যায়'।  

তবে বিহার রাজ্যের গঙ্গা পুনরুজ্জীবন, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সুনীল কুমার চৌধুরী বলছেন, 'সাগরের চেয়ে নদীর ভূচিত্র অনেকটাই সীমিত, তাই ড্রেজিংয়ের সময় ডলফিনদের খুব বেশি দূরে চলে যাওয়ার মতো জায়গাও নেই'। 

পুনে-ভিত্তিক ম্যানহাটন অধ্যয়ন কেন্দ্র ভারতে পানি ও জ্বালানি নীতি নিয়ে গবেষণা করে। এর একজন গবেষক আভিল ভার্মা জানান, পরিবেশগত নিরাপত্তাকে পাশ কাটিয়ে সরকার 'সহজে ব্যবসাবাণিজ্যের' সুযোগ করে দেওয়াকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। 

"বর্তমানে যদি সতর্কতামূলক সংরক্ষণ নীতিমালা উপেক্ষিত হয়, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে (জীববৈচিত্র্যের) টেকসই হবে না নদীপথগুলো। বাস্তুসংস্থান ও গাঙ্গেয় ডলফিনদের বিপন্ন করে গঙ্গায় 'ইকো-ট্যুরিজমের' প্রচার করা যৌক্তিক নয়'- বলে মতপ্রকাশ করেন তিনি। 

আপন দেশ ডটকম/ এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়