Apan Desh | আপন দেশ

সন্তানের দেখা সাংবাদিকের জীবন ও সংবাদপত্রের মালিক

মো. শাহরু মোস্তাকিম

প্রকাশিত: ১৪:২৬, ১৭ মার্চ ২০২৪

আপডেট: ১৪:৫২, ১৭ মার্চ ২০২৪

সন্তানের দেখা সাংবাদিকের জীবন ও সংবাদপত্রের মালিক

ছবি: সংগৃহীত

আজ ১৭ মার্চ প্রখ্যাত ভাওয়াইয়া শিল্পী, সাংবাদিক সফিউল আলম রাজার পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৯ সালের ১৭ মার্চ রাজধানীর মিরপুর পল্লবীতে নিজ কার্যালয় কলতান সাংস্কৃতিক একাডেমিতে ঘুম থেকে চিরঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমান ক্ষণজন্মা ভাওয়াইয়ার এ রাজকুমার। কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলায় জন্ম নেয়া সফিউল আলম রাজা শ্রোতা-দর্শকের কাছে ‘ভাওয়াইয়া রাজা’, ‘ভাওয়াইয়া রাজকুমার’ ও ‘ভাওয়াইয়ার ফেরিওয়ালা’ নামে পরিচিত ছিলেন।

তার মৃত্যুবার্ষিকীতে তার সন্তান বাংলাদেশের সাংবাদিকতার স্বরূপ, সাংবাদিক সংগঠন, এর নেতাদের প্রকৃত চরিত্র ও সংবাদপত্র মালিকদের আসল চেহারার আংশিক উন্মোচন করেছেন—

আজ আমি একজন শিল্পীর কথা বলতে যাচ্ছি, একজন সাংবাদিকের কথা বলতে যাচ্ছি, সেই শিল্পীকে-সাংবাদিককে আমার অনেক কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। তিনি হলেন ক্ষণজন্মা প্রতিভাধর সংগীত শিল্পী, ‘ভাওয়াইয়ার যুবরাজ’-খ্যাত সফিউল আলম রাজা। তিনি একাধারে সাংবাদিক, ভাওয়াইয়া গবেষক ও বিখ্যাত ভাওয়াইয়া শিল্পী ছিলেন।
 
সফিউল আলম রাজার ক্যারিয়ারের আদ্যোপান্ত অনেকেরই জানা। দেশের প্রথম সারির পত্রিকাগুলোতে কাজ করেছেন দীর্ঘ সময়। যুগান্তর পত্রিকাতেই চাকরি করেছেন দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময়। তিনি সর্বশেষ অনলাইন নিউজ পোর্টাল প্রিয় ডটকমের প্রধান প্রতিবেদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পেশাগত জীবনেও তিনি সাংবাদিকতায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুরস্কার, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার, ডেমোক্রেসি ওয়াচ হিউম্যান রাইটস অ্যাওয়ার্ড, ইউনেস্কো ক্লাব অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড, ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ডসহ অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। 

বাংলাদেশ বেতারের ‘বিশেষ’ ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘প্রথম’ শ্রেণির শিল্পী। এছাড়া তিনি দেশের সব ক’টি চ্যানেলে নিয়মিত সংগীত পরিবেশন করছেন। ২০০৮ সালে রাজধানীতে ‘ভাওয়াইয়া’ গানের দল প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া ২০১১ সালে রাজধানীর পল্লবীতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ভাওয়াইয়া স্কুল’। একই এলাকায়, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ‘কলতান সাংস্কৃতিক একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে একাধারে অনেকগুলো বাদ্যযন্ত্র, চিত্রাঙ্কণ ও সংগীত চর্চার জন্য বিভাগ খোলা হয়েছিলো; যার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে।

এতক্ষণ যা কিছু বলা হলো তার সবই প্রায় ইন্টারনেটে পাওয়া যায় এমন তথ্য। কিন্তু আজ অজানা কিছু কথা সবাইকে বলে যেতে চাই। সবাইকে জানাতে চাই একজন প্রকৃত শিল্পপ্রেমীর জীবন কতটা নিদারুণ আজকের এ বাংলাদেশে। 

আমি সফিউল আলম রাজার ছেলে। বাবা হিসেবে তার আদর-ভালোবাসা পাওয়ার সুযোগ হয়েছে কম। কেননা তিনি ছিলেন আনমনা আর কাজ পাগল। কাজের চেয়ে বেশি প্রিয় তার কাছে আমি হয়ে উঠতে পারিনি কখনোই! আমার যতদূর মনে পড়ে ২০০৫ সালে তিনি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন। পরবর্তীতে ২০১৫ বা ২০১৬ সালে তিনি আবার ডিআরইউ নির্বাচনে অংশ নেন, কিন্তু এবার আরও বড় পদে, সাধারণ সম্পাদক পদে।

রাজনীতিতে কখনোই না জড়ানো সৎ ও নির্ভীক এ সাংবাদিক বুঝতে পারেননি, অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানেও রাজনীতির ছায়া থেকেই যায়। তাইতো সকলের প্রিয়, এক নামে চেনা ভাওয়াইয়ার রাজা সেই নির্বাচনে হেরে যান। তার নির্বাচনে পরাজয়ে আমি অতটা বিচলিত ছিলাম না, কারণ তখনো আমি স্কুলে পড়ি, কোথাকার জল কোথায় গড়াচ্ছে তা আমার বোধের বাইরে ছিল।

আমি শুধু এতটুকু জেনেছিলাম কে বা কারা আমার বাবাকে বলেছিলেন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে, কিন্তু তিনি বলেছিলেন নির্বাচনে দাঁড়ানোটা তার অধিকার। এ থেকেই মোটামোটি সমস্যার শুরু। আমার বাবার অফিসে কী যেন জটিলতা চলতে লাগলো। দীর্ঘদিন আমি শুধু এটিই জানতাম যে জটিলতা চলছে কোনো। কিন্তু একপর্যায়ে জানতে পারলাম কোনো এক অজানা (আমার অজানা) কারণে তাকে অফিস থেকে কাজ দেয়া হচ্ছে না, মাস শেষে বেতন আসছে না আবার তাকে ছাঁটাইও করা হচ্ছে না। 

এ গেল একটি প্রসঙ্গ। আরেকটি ব্যাপার ছিল, শিল্পকলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক হিসেবে লিয়াকত আলী লাকী দায়িত্বে ছিলেন। তার সম্পর্কে বা তার কোনো কাজ সম্পর্কে আমার পিতা কোনো একটি রিপোর্ট করেছিলেন বা করতে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় কর্মরত। এমতাবস্থায় তাকে একদিন যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মরহুম নুরুল ইসলাম বাবুল সাহেব ডাকেন এবং অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন ও হুমকি দেন। সম্ভবত আমার বাবা তখন ওই রিপোর্টে আর কাজ করেননি। 

যুগান্তরের বিরুদ্ধে এখনো শ্রম আদালতে আমার বাবার করা মামলাটি অনিষ্পত্তি অবস্থায় রয়েছে। মৃত্যুর পূর্বে তিনি সাংবাদিক নেতাদের প্রতি আহ্বান করেছিলেন, অনুরোধ করেছিলেন- যেন তার অধিকার আদায়ে সহায়তা করা হয়। যাহোক, সকল অনুনয়-মিনতি, সবই গেল বিফলে, সকলকে কাঁদিয়ে ২০১৯ সালের ১৭ মার্চ তিনি পরলোকগমন করেন।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি এ মানুষটি নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য- একজন সাংবাদিক ও দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে, আর বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ভাওয়াইয়া গানের ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য- একজন ভাওয়াইয়া সংগীতজ্ঞ ও শিল্পানুরাগী হিসেবে। আমার বা আমার পরিবারে বা তার নিজের বিলাসিতা অথবা আরাম আয়েশের পেছনে অর্থ ব্যয়ের সুযোগ যখন হাতছানি দিচ্ছিল, তখন তিনি ভাওয়াইয়া স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন, যেখানে এক বছরের ফ্রি কোর্স করানো হতো। সার্টিফিকেটও দেয়া হতো। এ ধরনের মহৎ উদ্যোগ বাংলাদেশে এ প্রথম। এ থেকেই প্রমাণিত হয় তার সংগীতপ্রেম, শিল্পপ্রীতি কতটা গাঢ়!

আমার মা একজন সমাজকর্মী। বিভিন্ন এনজিওতে সম্মানের সঙ্গে, সততার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার মায়ের। কিন্তু ঢাকা শহরে মধ্যবিত্ত পরিবারের কতটা আয় কতটা ব্যয়, কীভাবে প্রতিটি সংসার চলে তা আপনারা ভালোই জানেন এবং বোঝেন! বাবার মৃত্যুর পূর্বেই আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর থেকেই আমি টিউশনি করতাম, কখনো নিজের হাত খরচের জন্য, কখনো পড়ার খরচ চালানোর জন্য। 

পরিবারের এ করুণ অবস্থার একপর্যায়ে আমার বাবা ২০১৯ সালে মারা গেলেন। তখন অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী এলেন, বাবাকে নিয়ে কথা বললেন, আফসোস করলেন। কিন্তু পরবর্তীতে পাশে পাইনি কাউকেই। বাবার স্মৃতি ও কীর্তি অমর করার লক্ষ্যে তার সবগুলো প্রতিষ্ঠান কখনো ভর্তুকি দিয়ে কখনো সামান্য আয় দিয়ে ধরে রেখেছি আমি, আমার মা ও আমার বোন।

আরও পড়ুন>> নজরুল সঙ্গীত কি পণ্য?

কী পেলেন সফিউল আলম রাজা? কী পেলেন ভাওয়াইয়ার যুবরাজ? নিজের পকেটের টাকা খরচ করে বাংলাদেশের শিল্প, ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন; অনেক বছর সততার সঙ্গে চাকরি করেছেন, অথচ আজও তার প্রাপ্য টাকার মামলা শ্রম আদালতে ঝুলছে! কোথায় শিল্প মন্ত্রণালয়? এ গুণী শিল্পীর প্রতিষ্ঠান ধরে রাখার জন্য কোনো সহায়তা বা অনুদান তো আমরা পাইনি! কোথায় আজ সাংবাদিক নেতারা? কোথায় আজ বড় বড় সাংবাদিক সংগঠনগুলো? তারা কেন পারছে না আমার বাবার পাওনা তার মৃত্যুর পাঁচ বছর পরও আদায় করে দিতে?

আমি আজ সকল সাংবাদিকদের কাছে প্রশ্ন রাখলাম, আমার বাবার যে প্রাপ্য অর্থ তিনি তার জীবদ্দশায় পাননি, সেই অর্থ আমি কি পাব কখনো? একবার আমার জায়গায় নিজের সন্তানকে বসিয়ে দেখুন। আপনার সন্তানকে কখনো আপনার প্রাপ্য নিয়ে আক্ষেপ করে ফেসবুকে পোস্ট দিতে হবে না তো?

ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ- সাংবাদিকতায় যতক্ষণ আপনি আছেন, বিভিন্ন সংগঠনে আপনার ভোট আছে- ততক্ষণ আপনার গ্রহণযোগ্যতা আছে। আপনার একটি ভোট পেতে সাংবাদিক নেতারা আপনার পেছনে ধরনা দেবেন। আর যেই না আপনি কোনো সমস্যায় পড়েছেন তখন আপনাকে বিপরীতে সমপরিমাণ ধরনা তাদের পেছনে দিতে হবে। আর আপনি মরে গেলেন তো সব শেষ। 

সাংবাদিক সংগঠনগুলো এককালীন আপনাকে কিছুটা সহায়তা করবে। পরে আর কোনো খোঁজ রাখা হবে না। কীভাবে আপনার সংসার চলবে সেই ব্যবস্থা কেউ করবে না। আপনি দেশ, সাংবাদিকতা ও সমাজের জন্য যত কল্যাণই করে যান না কেন। এ চলে আসছে বাংলাদেশে। এ ব্যবস্থার বদল হওয়া জরুরি।

এখন অনেক কষ্টে বলতে হয়, বাংলাদেশে সাংবাদিকদের জীবনটা কি এমন অনিশ্চিত-ই থেকে যাবে? অধিকার কি আদায় হবে কখনো? হয়তো না! মেঘের বাবা-মা শারীরিক আঘাতে মারা গিয়েছেন, আর আমার বাবা মারা গিয়েছেন মানসিক আঘাতে, অর্থকষ্টে। সমস্যাটা আসলে কোথায়?
আমি বলছি! সমস্যাটা সাংবাদিকদের নীরবতায়! আপনারা আর কতকাল নীরব রইবেন?

আপন দেশ/এমআর/এসএমএ

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

জনপ্রিয়