Apan Desh | আপন দেশ

শিল্পীর আবেগ ও হতাশা: সাদী মহম্মদের স্বেচ্ছামৃত্যু

রফিক সুলায়মান

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ১৪ মার্চ ২০২৪

আপডেট: ২৩:৫৭, ১৪ মার্চ ২০২৪

শিল্পীর আবেগ ও হতাশা: সাদী মহম্মদের স্বেচ্ছামৃত্যু

রফিক সুলায়মান, ফাইল ছবি

এ-বছর একজন শিল্পী একুশে পদকে সম্মানিত হওয়ার পর বেশ অহংকারের সুরে বলেছিলেন, বাংলা গানে তার যে অবদান সে-বিচারে আরো আগেই এই পদক পাওয়া উচিত ছিলো! শংকর রায় নামে একজন একুশে পদক লাভ করেছিলেন রবীন্দ্র স্বরলিপি সম্পাদনা করে। সম্পাদনায় সম্পাদকীয় লিখতে হয়।

‘ওথেলো’র অনুবাদের ভূমিকা লিখেছিলেন মুনীর চৌধুরী ১৫৯ পৃষ্ঠার। ‘অখণ্ড নজরুল-গীতি’র ভূমিকা লিখেছেন আবদুল আজিজ আল আমান প্রায় এক বইয়ের সমান। শংকর রায় রবীন্দ্র স্বরলিপির ভূমিকায় কী লিখেছেন তা অবশ্য পড়ার ইচ্ছে জাগেনি।

কিছুদিন আগে প্রয়াত হয়েছেন লেখক আবু বকর সিদ্দিক। কবিতা, কথাসাহিত্য, প্রবন্ধের পাশাপাশি তিনি একজন গণসঙ্গীত রচয়িতাও। ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধে হারিয়েছিলেন হাতের আঙ্গুল। না, তিনি রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মাননা পাননি।

অনেকটা অভিমানে আর অযত্নে চলে গেলেন শিল্পী সাদী মহম্মদ তকিয়ুল্লাহ। সহপাঠীরা যখন একুশে/স্বাধীনতা পদক পেয়ে যান; কিংবা জন্মদিনে পেয়ে যান উচ্চ লেভেল থেকে ফোন কল- তখন নিজেকে বড় একা ও শূন্য শূন্য অনুভূত হতেই পারে। ২০০১ থেকে ২০০৬ বিএনপি জামায়াত আমলে তিনি রাষ্ট্রীয় নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন। বিটিভিতে একরকম কালো তালিকাভূক্ত ছিলেন। সেই নিষেধাজ্ঞা আর প্রত্যাহার হয়নি এখন পর্যন্ত। রাষ্ট্র নির্বিকার। গান না গাইলে সাদী মহম্মদের মতো একজন মহান শিল্পী বাঁচবেন কী করে- এটি ভাবার মতো ঔদার্য আমাদের নেই। কোনোদিন হবেও না।

নিঃসঙ্গতা কী কষ্টকর সেটি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল জানতেন। আর জানতেন সাদী মহম্মদ। ছোট ভাই শিবলী মহম্মদ এনামউল্লাহকে যখন একুশে পদক দেওয়া হলো তখন কী অনুভূতি হয়েছিলো সাদী মহম্মদের? রাষ্ট্র বা তার সুহৃদগণ একবার ভেবে দেখেছেন? আপনারা একবার দৃশ্যটি কল্পনা করুন। শহীদ সলিমউল্লাহ’র পরিবারের সবচেয়ে কষ্টের দিন ছিলো সেটি।

আরও পড়ুন <> ঠার বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে অনন্য গবেষণা

সাদী মহম্মদ আজন্ম কষ্ট ও হতাশার ভেতর দিয়ে একেকটি দিন কাটিয়েছেন। ১৯৭১ এ তিনি নিজের পিতাকে চোখের সামনে শহীদ হতে দেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত দেশে শাহ্ আজিজ, আলীম, মাওলানা মান্নান, নিজামী, মুজাহিদ, কায়সারকে মন্ত্রী হতে দেখেছেন। স্বাধীনতা বিরোধীদের রক্তচক্ষু আর নাগিনীদের নিঃশ্বাস দেখেছেন। সরকারের প্রচারযন্ত্রে নিজেকে নিষিদ্ধ হতে দেখেছেন। আপন ছোটভাইয়ের নৃত্যশিল্পের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেখেছেন। কিন্তু আমৃত্যু রবীন্দ্রনাথের সাথে বসবাস করেও তিনি রয়ে গেলেন অপাঙক্তেয়। হায় আমার বাংলাদেশ!

‘সব ধরনের গান ভালো লাগে। কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি আমার তৃষ্ণা চিরন্তন,’ বাংলাদেশের একটি শীর্ষ গণমাধ্যমকে এমনই বলেছিলেন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন রবিরাগের পরিচালক সাদী মহম্মদ।

সাদি মহম্মদ বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি সর্বশক্তিমান তার সৃষ্টির মধ্যে বাস করেন। অন্যকে ভালোবেসে যে কেউ তার নেয়ামত পেতে পারেন। ফলে কেউ আমার সঙ্গে প্রতারণা করলে আমি মাথা ঘামাই না। আমার দৃষ্টিতে যে ব্যক্তি প্রতারণা করেছে তিনি আসলে নিজের সাথে প্রতারণা করেছেন।’

বাবা-মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী ১৯৭৩ সালে বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন সাদি মহম্মদ। তবে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মন বসাতে পারেননি। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াকালীন ১৯৭৫ সালে স্কলারশিপ নিয়ে শান্তিনিকেতনে সংগীত নিয়ে পড়তে যান। বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্রসংগীতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। সেই থেকে শুরু পথচলা।

বর্ষা ও বসন্তের গান পছন্দ করতেন সাদী মহম্মদ। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা দেখার কথাও বলেছেন। উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেনের সিনেমা ছাড়াও হলিউডের ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’, ‘রোমান হলিডে’ ছিল তার বেশ পছন্দের। এ ছাড়া বই পড়তেন। প্রিয় লেখকদের একজন ছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস পছন্দ করতেন। রবীন্দ্রসংগীত ও আধুনিক গানসহ সাদী মহম্মদের প্রকাশিত মোট অ্যালবামের সংখ্যা ষাটটিরও বেশি। ২০১৫ সালে তিনি বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন।

পরিশেষে বলতে পারি, এ কোনো আত্মহত্যা নয় কেবল। একজন শিল্পীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ তার কণ্ঠ। শীত-গ্রীষ্ম-ঠাণ্ডা-সর্দি কত শত প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে একজন শিল্পী অর্জন করেন লালিত্যময় কণ্ঠ। সেই কণ্ঠকে নিজেই যখন শেষ করে আত্মঘাতী হয়ে যান তখন আমাদেরকে নড়েচড়ে বসতে হবে। পুরস্কার আর পদককে হাতিয়ার বানানোর খেলা থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তি আর সুকুমারবৃত্তির প্রকৃত পরিচর্যার ক্ষেত্র বানাতে হবে বাংলাদেশকে।

লেখক : সংস্কৃতিবান ও কলাম লেখক।

আপন দেশ/এমআর

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

জনপ্রিয়