Apan Desh | আপন দেশ

নূরজাহানের বিতর্কিত প্রেম

আহমেদ তেপান্তর

প্রকাশিত: ১২:০২, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩

নূরজাহানের বিতর্কিত প্রেম

ছবি : সংগৃহীত

বিশ্বব্যাপী সংগীতপিপাসুরা তাকে চেনেন মালিকাণ্ডই-তারান্নুম, ইংরেজিতে কুইন অব মেলোডি বা সুরের রানি হিসেবে। যিনি সুরের মায়াজাল আর সৌন্দর্যের ছটায় পৃথিবীর আলো বা নূরজাহান নামে দ্যুতি ছড়িয়েছেন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এই ছটায় আলোকিত হয়েছেন কোটি কোটি সংগীতভক্ত। ছয় দশকের কর্মজীবনে গান ছাড়াও, অভিনয় আর পরিচালনায় হাত পাকিয়েছেন। ব্রিটিশ ভারতে জন্ম নেয়া এই গায়িকা থিতু হন পাকিস্তানের লাহোরে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগীতশিল্পীও বলা হয় তাকে।

একই সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে তিনি সর্বমহলে আলোচিত! পঞ্চাশ ও ষাট দশকে ঘরে ঘরে চর্চিত বিষয়বস্তুর নাম ‘নূরজাহান’। এমন কথা পাঠকমাত্রই সাদত হাসান মান্টোর ‘গাঞ্জে ফারিস্তে’ গ্রন্থে পাবেন। সুরের মায়াজালে দুর্নিবার নূরজাহান নিজেকে শরাবের মতো সমর্পণ করতেন, তেমনি প্রেমে এক রত্তি কম যাননি! সুর আর সৌন্দর্যের কলায় কুপোকাত করেছেন বহু বেগানাকে, তবে তাদের সৃষ্টির উল্লাস আর পৌরষত্বই তাকে আকর্ষণ করত। এমনই এক উদাহরণ খ্যাতিমান পাক ক্রিকেটার নজর মুহাম্মদ। ভারতের বিপক্ষে ১৯৫২ সালে ৫১৫ মিনিট ক্রিজে থেকে দলের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম অপরাজিত সেঞ্চুরি করার গৌরব অর্জনের কারণে ক্রিকেটীয় ইতিহাসে সুপরিচিত। কিন্তু নজর মুহম্মদের কর্মজীবনের যেমন একটি উত্তাল সূচনা হয়েছিল, আবার নূরজাহানের সঙ্গে জড়িয়ে নাটকীয়ভাবে শেষ হয়েছিল!

এ নিয়ে পাকিস্তানের প্রভাবশালী ডন, দি পাকিস্তান টুডে, ক্যাচনিউজ বিভিন্ন সময় প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যার ভাবানুবাদ এ লেখায় তুলে ধরা হলো- ‘নূরজাহানের বিতর্কিত প্রেম’ শিরোনামে। ২১ সেপ্টেম্বর ছিল কণ্ঠশিল্পীর ৯৮তম জন্মবার্ষিকী।

বিভিন্ন লেখায় ও সাক্ষাৎকারে এটি নিশ্চিত নজর মুহাম্মদের সঙ্গে গভীর সম্পর্কের কারণেই প্রথম স্বামীর সঙ্গে তালাক হয় নূরজাহানের। যদিও ফিল্মিক বোদ্ধাদের দাবি, একাধিক নারীর সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলেন স্বামী পরিচালক শওকত হুসেইন রিজভী। এখানে ‘নজর’ কেবল একটা উছিলা মাত্র। সুযোগ খুঁজছিলেন এবং হাতেনাতে পেয়ে সুযোগ কাজে লাগিয়েছিলেন।

অন্যদিকে ক্রিকেটের বাইবেল উইজডেন অনুসারে নজর মুহাম্মদের ক্যারিয়ার শেষ হয়েছিল একটি ব্যক্তিগত দুর্ঘটনার কারণে। প্রকৃত সত্য অনেক পর প্রকাশ হয় তিনজনের জবানিতেই!

মৃত্যুর পাঁচ বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে নূরজাহান নজর মুহাম্মদের সঙ্গে গভীর প্রণয়ের কথা স্বীকার করেন। ওই সময় সাবেক স্বামী শওকতও প্রসঙ্গটি সামনে আনেন। তাদের এই সাক্ষাৎকারে নজর মুহাম্মদের সঙ্গে প্রেমের মুগ্ধতা প্রকাশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসে নজরের ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার নেপথ্য কারণও!

নব্বইয়ের দশকে লেখা ক্রিকেট বই ‘প্রাইড অ্যান্ড প্যাশন’-এ লেখক উমর নওমান লিখেছেন- বিবাহিত নূরজাহানের সঙ্গে অন্তরঙ্গ থাকা অবস্থায় নজর মুহাম্মদ শওকতের ফিরে আসা টের পেয়ে তাড়াহুড়ো করে ঝাঁপ দিয়ে পালানোর পথে আহত হন। এ ঘটনায় আর কখনোই ক্রিকেটে ফিরতে পারেননি নজর মুহাম্মদ।

সাংবাদিক ওয়াসিম আকবর সত্তরের দশকে সাপ্তাহিক ‘পিমন’-এর জন্য নূরজাহানের খোলামেলা জীবন নিয়ে বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেন। ওই সাক্ষাৎকারে নূরজাহান প্রথম স্বীকার করেন নজরের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ সম্পর্কের কথা। সঙ্গে এও বলেন, একজন উঁচুদরের ক্রিকেটার বলে নয়, সম্পর্ক জড়িয়েছি মূলত তার অসাধারণ গায়কীর কারণে। তার জীবনে আসা প্রথম পুরুষ নজর।

নূরজাহানের মতে, তিনি প্রথম নজর মোহাম্মদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন যখন তিনি খুব ছোট ছিলেন এবং তার বড় ভাই সংগীতশিল্পী ফিরোজ নিজামীর কাছে গান শিখতেন। তার মতে, গান শেখার ক্লাসে প্রথমবারের মতো নজরের বাঁকা চোখে বিদ্ধ হয়েছিলেন। যদিও পরিস্থিতি এড়াতে কিছুটা বকা নজরকে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু যখন জানতে পারেন নজরের গান রেডিওতে বাজে তখন বাঁকা চোখে আত্মসমর্পণ করেন নূরজাহান।

ওই সাক্ষাৎকারে ম্যাডামের দাবি ছিল, সম্পর্কটা দুই পরিবারের সবাই জানত তবে নজরের পরিবার রাজি না হওয়ায় বিয়ে হয়নি, ফলে আশাহত হয়েই নূরজাহান শওকত হোসেন রিজভীকে বিয়ে করেন। কিন্তু কথায় বলে, প্রথম প্রেম কখনো বিস্মৃত হয় না, তেমনি হয়েছিল নজর-নূর প্রেম। দুজনেই গোপনে সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছিলেন। স্বামীর অনুপস্থিতিতে প্রেমের সাগরের ফেনায় গা ভাসিয়ে স্বপ্নে বিভোর। কিন্তু এটি যে একটা সময় কাল হতে পারে দুজনের জন্য, তা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে চাননি প্রেমকাতর এই যুগল!

সংসার জীবনে তিন সন্তানের জননী নূরজাহান কিছুটা আহত হলেও প্রলেপের জন্য হিতাহিত জ্ঞান ভুলে নজর মুহাম্মদের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন আরো নিবিঢ়ভাবে। এর মধ্যেই এক দিন হুট করে গৃহে প্রবেশ করেন শওকত। টের পেয়ে দৌড়ে পালাতে গিয়ে দেয়াল থেকে পড়ে হাত ভাঙেন নজর মুহাম্মদ। এক সাক্ষাৎকারে শওকতের দাবি, বিশ-পঁচিশ ফুট ওপর থেকে লাফ দিয়ে কেবল হাতই ভাঙেননি, জ্ঞান হারিয়ে ছিলেন নজর।

এই লাফ দেয়া ঘটনার বর্ণনায় নজর বলেন, আমি শুনেছিলাম বন্দুক হাতে আমাকে মারতে খোঁজ করছিলেন শওকত। সেই ভয়ে প্রাণ বাঁচাতে এমন ঝুঁকি নিয়েছিলাম। নজরের এমন দাবিকে অস্বীকার করেননি শওকত। বলেন, সেদিন যদি বন্দুক থাকত তাহলে সত্যি তিনি গুলি চালাতেন!

তবে স্থান নিয়ে তারতম্য থাকলেও নূরজাহান তার সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি নজর মুহাম্মদের সঙ্গে তার বাড়িতে নয়, অন্য কোথাও দেখা করেছিলেন। ওইদিনের সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে তিনি দাবি করেন, একজন অভিনেত্রীকে ঘিরে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া প্রসঙ্গে নজরের কাছে শুধু সান্ত্বনা পেতেই এসেছিলেন। কিন্তু শওকতের হাতে পিস্তল আছে এমন ভাবনা থেকেই নজরকে তাড়িয়ে দেন, আর নজরও প্রাণ বাঁচাতে দেয়াল থেকে লাফ দেন। আর তাতেই ঘটে বিপত্তি। বেচারাকে চিরদিনের জন্য ক্রিকেট ছেড়ে দিতে হয়!

পরে যখন নূরজাহানের সাক্ষাৎকারের বিষয়গুলো জানতে পারেন তখন তিনি সাংবাদিক মুনির এ মুনিরের সহায়তায় ‘নূরজাহান অর মে’ গ্রন্থে বিবাহবিচ্ছেদের ২৭ বছর পর এই গোপনীয়তাগুলো প্রকাশ করেছিলেন।

তবে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে শওকত দাবি করেন, নজর-নূর প্রেমের বাতায়ন এতটাই হাওয়া বইছিল যে, গৃহভৃত্যরাও এ নিয়ে বিব্রত ছিল।

শওকত হুসেন রিজভীর মতে, সেদিন তিনি লাহোরের ইসলামিয়া পার্কের কাছের বাড়িতে পৌঁছান যেখানে বারান্দার বিছানায় একসঙ্গে শুয়ে ছিলেন নজর মুহাম্মদ এবং নূরজাহান, তার কাছে পিস্তল ছিল না, যদি থাকত তবে সে দুজনকেই গুলি করতেন।

শওকত হুসেইন রিজভী বলেন, ঘটনার একপর্যায়ে নজরের প্রতি তার ভালোবাসার কথা স্বীকার করেন নূরজাহান। আর এর পরপরই বিচ্ছেদ ঘটে তাদের।

এই ঘটনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র নজর মুহাম্মদ সম্পর্ক নিয়ে মৌন থাকলেও জীবনের শেষভাগে সাংবাদিক ইবনে ইউনিসকে একটি সাক্ষাৎকারে ঘটনার কিছু বিবরণ বলেছিলেন, যা প্রকাশিত হয়েছিল তুফায়েল আখতারের ‘নূরজাহান ফিতুর জাহান’ বইতে।

ওই সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেছেন- নূরজাহান জাতীয় দলের ক্রিকেটার হওয়ায় তার প্রতি আকৃষ্ট হননি, বরং পুরুষত্ব, প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব এবং রাগ-জ্ঞানের কারণে কাছে এসেছিলেন।

নজর মুহাম্মদ বলেন, আমি নূরজাহানের ভালোবাসার জন্য আমার হাত বিসর্জন দেয়ার পাশাপাশি আমার টেস্ট ক্যারিয়ারও শেষ করে দিয়েছিলাম এবং এই ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে শওকত হোসেন রিজভী নূরজাহানকে তালাক দেন।

তার মতে, তিনি যদি কুমারী হতেন তবে নূরজাহানকে বিয়ে করতেন, কিন্তু সন্তানের কারণে তিনি তা করতে পারেননি এবং নূরজাহান তাদের প্রতি হতাশ হয়ে পরে বয়সে ছোট অভিনেতা ও প্রযোজক ইজাজ দুররানীকে বিয়ে করেন।

নজর মুহাম্মদ বলেন, মানুষ আমাকে যখন বলে আমি নূরজাহানের প্রেমিকা, তখন তাদের বলি- আমি নূরজাহানের প্রেমিক নই, আমি প্রেমিক।

আপন দেশ/আরএ

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

জনপ্রিয়