Apan Desh | আপন দেশ

বাঙালি সংস্কৃতির শিকড় বৈশাখি উৎসব

অরবিন্দ মৃধা

প্রকাশিত: ১২:০৭, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

বাঙালি সংস্কৃতির শিকড় বৈশাখি উৎসব

ফাইল ছবি

বাঙলার প্রাচীন সংস্কৃতি বর্ষবরণ উৎসব এবং বৈশাখী মেলা গ্রামীণজীবন ছাপিয়ে নাগরিক জীবনে ধর্ম-গোত্র-বর্ণ নির্বিশেষ সকল শ্রেণি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। এ মেলা এখন জাতীয় বন্ধন উৎসবে পরিণত হয়েছে। 

বাঙালির ভাষা-আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রামের মতো, প্রচলিত সংস্কৃতি রক্ষা এবং লালন পালনের জন্য রাজশক্তির বাধার মুখে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়েছে। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ হলে ঘুমন্ত বাঙালি জেগে ওঠে। ছায়ানট ও তখনকার আলোকিত কিছু মানুষের আন্দোলন; পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙালির গ্রামীণ বর্ষবরণ উৎসব গ্রাম থেকে আসন পাতে ঢাকা নগরের রমনা বটমূলে। সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের এই নিবিড় বর্ষবরণ পালন পরবর্তীতে বাঙলাদেশের সকল নগর, বন্দর, গ্রামগঞ্জ এমনকি বহির্বিশ্বে বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে পহেলা বৈশাখ বরণের ছায়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে।

সেই সুপ্রাচীন যুগ থেকে বাঙালির পূর্বসূরিগণ জীবীকার সন্ধান, জীবনের প্রয়োজন এবং সামাজিক নানা উপলক্ষকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন উৎসব-মেলা সৃষ্টি এবং পালন করে আসছে। কৃষিতান্ত্রিক জীবনযাত্রায় বর্ষবরণ অন্যতম অনুষঙ্গ। প্রকৃতি থেকে খাদ্যশস্য উৎপাদনের সূচনাকাল হিসেবে চিহ্নিত করে বৈশাখকে নির্ধারণ করা হয়েছে।

এর পাশাপাশি অজ্ঞ-ভীতু মানুষের লোকজ বিশ্বাসের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছে উৎসব। যেমন- বৈশাখী উৎসব (বৌদ্ধ) চৈত্রসংক্রান্তি, বারুণী উৎসব, দোলউৎসব, মাঘী পূর্ণিমা, রথযাত্রা, পৌষসংক্রান্তি, বিভিন্ন পুজো, ঈদ, পুণ্যাহ (খাজনা আদায়) মেলা, মহররম, ওরসমেলা, গাজীর মেলা, পাঁচপীরসিন্নি মেলা, বনবিবি মেলা, বদরের ওরস মেলা, ফকিরের মেলা, টেংরা মাগুর (মাছের) মেলা, বড়দিন উৎসব মেলা, কঠিন চীবরদান মেলা, চড়ক মেলাসহ অসংখ্য লোকজ মেলা বৈশাখী উৎসব-মেলাকে কেন্দ্র করে অতীতকাল থেকে শুরু হয়ে আজও চলমান। আছে গ্রামীণ জীবনে কবি গান, জারি গান, যাত্রাপালা উপলক্ষে সপ্তাহ, পক্ষকাল বা মাসব্যাপী মেলা উৎসব।

আরও পড়ুন <> অদ্বৈতের জীবনচিত্র তিতাস একটি নদীর নাম

গ্রামীণমেলা নাগরিক জীবনে প্রভাব ফেলায় নগরকেন্দ্রিক নতুন নতুন মেলার উদ্ভব হয়েছে। যেমন- উন্নয়ন মেলা, ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলা, শিল্প-বাণিজ্য মেলা, কারুশিল্প মেলা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলা, শিক্ষা মেলা, বৃক্ষ মেলা, ভাষা দিবস একুশে মেলা, স্বাধীনতা মেলা, বিজয় মেলা, মুজিবনগর মেলা, পশুপাখি মেলা, পর্যটন মেলা, পিঠাপুলি মেলা, আনন্দ মেলা, নারীদিবস মেলা, বলীখেলা মেলা, তথ্য মেলা, জাতীয় কুটির শিল্প মেলা, লোকশিল্প মেলা, এস এম ই মেলা, নবান্ন মেলা, কর মেলাসহ সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বহু নতুন মেলার সৃষ্টি হয়েছে। 

কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকগণের জন্ম-মৃত্যুকে উপলক্ষ করে ব্যক্তি নামের মেলা পালিত হয়ে থাকে। যেমন- মধুমেলা, (যশোর) রবীন্দ্র মেলা (শিলাইদহ, শাহজাতপুর, পাতিসর, দক্ষিনডিহি), নজরুল মেলা (ত্রিশাল), লালন মেলা (কুষ্টিয়া), মীর মশাররফ মেলা (কুষ্টিয়া), সুলতান মেলা (নড়াইল), ভুলু দেওয়ান মেলা, (ঝিনেদা) খান-ই-জাহান (ওরশ) মেলা (বাগেরহাট), খানবাহাদুর আহসানউল্লাহ (ওরশ) মেলা (সাতক্ষীরা), বিজয় সরকার মেলা (নড়াইল), জসীমউদ্দীন মেলা (অম্বিকাপুর), বেগম রোকেয়ামেলা (রংপুর), অনুকূল ঠাকুর মেলা-৩০ ভাদ্র (পাবনা), জিন্দাপীর মেলা (দিনাজপুর), শ্রীচৈতন্য মেলা (সিলেট), ভাসানী মেলা (টাঙ্গাইল), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেলা (টুঙ্গিপাড়া), হরিচাঁদ ঠাকুর মেলা (ওড়াকান্দি), পাগলা কানাই মেলা (ঝিনেদা), এছাড়া নানা ধর্মবিশ্বাস এবং মতপথের গুণি ব্যক্তিগণের স্মরণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে উৎসব এবং মেলা হয়ে থাকে। এসব মেলা এবং পার্বণ কিন্তু ওই আদিম বৈশাখী মেলার পথ ধরে প্রসারিত হয়েছে।

বাঙালির বর্ষবরণ কবে কখন থেকে শুরু হয়েছে তা দিনক্ষণ দিয়ে বলতে না পারলেও একথা বলা যায় যে, যখন থেকে কৃষিভিত্তিক জীবনযাত্রা শুরু হয়েছে তখন থেকে নতুন বর্ষাকে বরণ করার প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। প্রাচীন যুগ থেকে বাঙালি কৃষককুল বর্ষার আগমনকে ফসল উৎপাদনের সময় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সেই যুগে হালচাষ বা লাঙল চাষই ছিল ফসল উৎপাদনের একমাত্র মাধ্যম। তাই তারা স্বশিক্ষা জ্ঞানের বিচারে শুভদিন নির্ধারণ করে নতুন বর্ষার আগমনে হালচাষবর্ষ ধরে লাঙল চাষ আরম্ভ করতেন, কিছু মাঙ্গলিক আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে।

এই হালচাষ আরম্ভটাকে কৃষকের ভাষায় বলা হয়, ‘হালপুটনে বা হালফুটানো’ অর্থাৎ হালচাষের নতুন বছর শুরু। এই দিনে কৃষক তার গরু স্নান করিয়ে মাথায় তেল সিঁদুর দিয়ে ধান, দূর্বাঘাস, আমের পল্লব ঠেকিয়ে পরিবারের নারী পুরুষ শুদ্ধ হয়ে দিনের পূর্বভাগে (তিথি মোতাবেক) শুভক্ষণে শঙ্খধ্বনি, উলুুধ্বনি, বাদ্দিবাজনার মাধ্যমে বলদ গরু দিয়ে হালচাষ উদ্বোধন করতেন। আদিম কৃষককুলের উত্তরসূরিগণ আজও পাঁজি-পুঁথি দেখে এ সংস্কৃতি পালন করে থাকেন। 

এই হালপুটনের দিন থেকে শুরু হয় কৃষকের চাষবর্ষ বা হালবর্ষ। যেটি পরবর্তীতে আধুনিক বাঙালি সংস্কৃতিতে নববর্ষ, পহেলা বৈশাখ বা বর্ষবরণ উৎসব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এসব বিবেচনায় বৈশাখী উৎসব বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির গৌরবময় উত্তরাধিকার। কারণ, কৃষিভিত্তিক জীবনযাত্রা থেকে বাঙালি সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে। 

এই সংস্কৃতির শিকড় অনেক গভীরে। বাঙালির লোকায়ত জীবনে কুটির শিল্পজাত সামগ্রি উৎপাদন ও ব্যবহার সভ্যতা সৃষ্টির শুরু থেকে অর্থাৎ বলা যায়, পাথরে পাথরে ঘর্ষণের দ্বারা আগুন আবিষ্কার এবং খাদ্যদ্রব্য পুড়িয়ে খাওয়ার যুগ থেকে। পশু শিকারের যুগে মানুষ ধাতব দ্রব্য ব্যবহার করে কুটির শিল্পজাত কোচ, সড়কি, বল্লব, দা, কোদাল, কুড়াল ইত্যাদি হাতিয়ার তৈরি ও ব্যবহার শিখেছে।

আপন দেশ/এমআর

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়