Apan Desh | আপন দেশ

ঢাকার জলাবদ্ধতা থেকে কবে মুক্তি মিলবে?

রায়হান উল্লাহ

প্রকাশিত: ১০:৩৩, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩

আপডেট: ১২:১৭, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩

ঢাকার জলাবদ্ধতা থেকে কবে মুক্তি মিলবে?

রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার শুক্রবারে চিত্র, ছবি: সংগৃহীত

ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের মূল দায়িত্ব এখন সিটি করপোরেশনের। খাল খনন ও নর্দমা নির্মাণে দুই সিটি করপোরেশন— ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) শত শত কোটি টাকা ব্যয় করেছে। এক সময় রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরেসনের দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের ছিল। অনেকটা সময় ছিল ওয়াসারও। এমন পালাবদল অনেক হয়েছে। শুধু জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাননি নগরবাসী।

অবশ্য দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র দাবি করছেন তারা জলাবদ্ধতা নিরসনে অনেকটাই সফল। এমনকি সিটি করপোরেশন দুটির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা বুঝছেন না এত পানি কোথায় থেকে আসে। আর ঢাকাবাসী মনে করছেন তারা একটি নোংরা ও বসবাস অযোগ্য শহরে থাকছেন। তারা জানেন না এ থেকে মুক্তি মিলবে কখন।  

ঢাকায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত তুমুল বৃষ্টি হয়। সঙ্গে চলে বজ্রপাত ও দমকা হাওয়া। এতে করে ডুবে যায় রাজধানীর অনেক এলাকা। দুঃখের বিষয় রাজধানীর একাধিক এলাকায় শুক্রবারও পানি জমে থাকতে দেখা যায়। 

এদিকে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করছেন এমন ও বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতা ডেঙ্গুর ভয়াবহ রূপকে বাড়িয়ে দেবে। 

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ১২২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, এটি এ মৌসুমে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। তবে এমন বৃষ্টি প্রায় প্রতিবছরই হয়। যেমন গত বছর ২৫ অক্টোবর ঢাকায় পুরো দিনে ২৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। এবারের বৃষ্টির একটি দিক হল, এটি হয়েছে ছয় ঘণ্টায়। 

বৃষ্টিতে পানি এত বেশি ছিল অনেক সড়কে যানবাহন বিকল হয়ে পড়ে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বৃষ্টি বেশি হলে পানি জমতে পারে। কিন্তু নিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা থাকলে সেই পানি দ্রুত সরে যাওয়ার কথা। কিন্তু পানিনিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা নেই। এদিকে রাতভর ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষ সড়কে জলাবদ্ধতায় দুর্ভোগ পোহালেও পাশে পায়নি মেগা সিটির দায়িত্বে থাকা কোনো সেবা সংস্থাকে।

একসময় জলাবদ্ধতার জন্য ঢাকা ওয়াসাকে দোষারোপ করত সিটি করপোরেশন। তবে ২০০০ সালের শেষ দিকে রাজধানীর ড্রেনেজ ও খাল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের কাছে ছেড়ে দিয়েছে ওয়াসা। প্রথম দিকে সিটি করপোরেশনের তৎপরতা দেখা গেলেও এ বছর তারা নিশ্চুপ। ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হলেও কোনো খাল, বক্স কালভার্ট, ড্রেন পরিষ্কার করেনি সিটি করপোরেশন। সারফেস ড্রেনেও আবর্জনার স্তূপ। মেট্রোরেলসহ রাজধানীতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে বিদ্যমান ড্রেনগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে একটু বৃষ্টিতেই পানি সড়কে উঠছে। রাজধানীর অনেক খাল হারিয়ে প্রায় বন্ধ পানিপ্রবাহ। দখলদাররা খাল ভরাট করে গড়েছেন স্থাপনা। মাঝে মধ্যে সিটি করপোরেশন অভিযান চালিয়ে খালের বর্জ্য অপসারণ ও দখলমুক্ত করে। তবে ক’দিন পরই আগের অবস্থায় ফিরে আসে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জনশুমারির (২০২২) প্রাথমিক প্রতিবেদন বলছে, রাজধানী ঢাকায় এক কোটি দুই লাখের বেশি মানুষ বসবাস করে। জলাবদ্ধতা মানুষের জীবনে নানাভাবে দুর্ভোগ তৈরি করে। চলাচলের ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। জলাবদ্ধতা অর্থনীতির ক্ষতি করে। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের ‘জলবায়ু ও দুর্যোগসহিষ্ণু বৃহত্তর ঢাকা এলাকা: একটি ব্যষ্টিক বিশ্লেষণ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরে জলাবদ্ধতার কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ গড়ে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা, এখন যা আরও বেশি।

ঢাকা নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘জলাবদ্ধতা হতে পারে। কিন্তু তাই বলে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা পরও পানি নামবে না, এটা কেমন কথা? এ ব্যর্থতার জন্য যারা দায়ী, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত।’

ঢাকা-১৬ (পল্লবী-কালশী) আসনের এমপি ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ বলেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকায় বৃহস্পতিবার রাতে পানি জমেনি। যখন জমতো, সংসদে বলতাম। আমি ১১ হাজার কোটি টাকা খরচ করে এ সমস্যার সমাধান করেছি। একসময় কালশী, পল্লবীতে বৃষ্টি হলে গলা সমান পানি হতো। বৃষ্টি হলেই এখন পানি দ্রুত নেমে যায়।’ তবে ইলিয়াস মোল্লাহর এলাকার বাসিন্দারা জানান, বৃহস্পতিবার রাতে অনেক এলাকা তলিয়ে গেছে। এমনকি কালশী মোড়ে শুক্রবারও হাঁটুপানি ছিল।

আরও পড়ুন <> ভিসানীতিতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই: প্রধানমন্ত্রী

ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, ‘অস্বাভাবিক বৃষ্টির কারণে বৃহস্পতিবার রাতে নগরীতে জলাবদ্ধতা হয়েছে। তবে অল্প সময়েই তা নেমে গেছে। মোহাম্মদপুর এলাকায় সাধারণত তিন মিলিমিটার পর্যন্ত জলাবদ্ধতা হলে সহজে পানি নেমে যায়। কিন্তু সাড়ে পাঁচ মিলিমিটার হওয়ায় কিছুটা দুর্ভোগ হয়েছে।’ তিনি করেন, ‘জলাশয়, খাল, বিলগুলো দিন দিন দখল, ভরাট ও দূষণের কারণে পানি সহজে নামতে পারে না। এর পরও হটস্পট চিহ্নিত করে ড্রেনের কাজ করেছি। কিন্তু পলিথিন, ময়লা-আবর্জনার কারণে ড্রেন বন্ধ হয়ে যায়।’

রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘নির্মিত এলাকার জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে। উন্নয়নের নামে শোষণযোগ্য এলাকা আচ্ছাদিত করে ফেলছি। এখন উত্তরণের একমাত্র উপায় ওয়ার্ডভিত্তিক ১০-১২ শতাংশ এলাকায় জলাধার বা দু-তিনটি করে পুকুর করা। জমি অধিগ্রহণ করে হলেও এটি করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘ধানমন্ডি লেক না থাকলে পুরো ধানমন্ডি এলাকা বৃহস্পতিবার পানিতে সয়লাব হয়ে যেত। লেক, খাল, পুকুরের মতো রিচার্জার পন্ড রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে। এলাকাভিত্তিক সমস্যার সমাধান করতে হবে। পানি ধারণ করার সক্ষমতা বাড়াতে হবে, যেটি ড্যাপেও রয়েছে।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘জলাধার রক্ষায় আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই। ফলে সরকারি-বেসরকারি সব জলাধারই ভরাট হচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান নিজেরাই যখন ভরাট করে, তখন অন্যরা কী করবে? ফলে বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে রাজধানী।’

রাজউকের বোর্ড সদস্য (উন্নয়ন) অবসরপ্রাপ্ত মেজর শামসুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘রাজউক প্রকল্প এলাকায় জলাধার রাখার চেষ্টা করে। পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পেও ১০০ কিলোমিটারের বেশি লেক রাখা হয়েছে। কাজেই রাজউক জলাধার রক্ষার ব্যাপারে সচেষ্ট।’

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘রাজউক, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিভিল এভিয়েশন, ওয়াসা, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, জেলা প্রশাসন, পুলিশ, বিএডিসি, বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ– সব সেবা সংস্থারই দায় রয়েছে। শুধু দুই মেয়রকে দুষে লাভ নেই। সবাই মিলেমিশে ধ্বংস করে ফেলেছে নগর পরিকল্পনা। এখন সিটি করপোরেশন শতচেষ্টা করলেও জলাবদ্ধতা নিরসনে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে। এর পরও মেয়ররা এমন দুর্গতি হলেই সামনে আর জলাবদ্ধতা হবে না বলে যে আশার বাণী শোনান– সবই ফাঁকা বুলি, মিথ্যা আশ্বাস। কারণ, জলাবদ্ধতা নিরসনের মৌলিক জায়গা এরই মধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে। যেটুকু বাকি, তাও শেষ করতে সবাই উঠে-পড়ে লেগেছে। ফলে নগরবাসীর কোনো পরিত্রাণ নেই।’ তিনি বলেন, ‘জাতীয় সংসদে এমপিরা নিজ এলাকার রাস্তা, কালভার্ট, ব্রিজ ইত্যাদির প্রয়োজন তুলে ধরেন। কিন্তু ঢাকা শহরের এমপিদের মুখে কখনো এসব যে দরকার, তা বের হয় না। তারা সোচ্চার হলে কিছুটা হলেও হয়তো সমাধান মিলত।’

আপন দেশ/আরএ

মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়