Apan Desh | আপন দেশ

বাঙালি সংস্কৃতির বাড়ন্ত প্রতিপক্ষ

হারুন হাবীব

প্রকাশিত: ২২:৫৪, ১৪ এপ্রিল ২০২৩

আপডেট: ২০:৪৫, ২৭ জুলাই ২০২৩

বাঙালি সংস্কৃতির বাড়ন্ত প্রতিপক্ষ

ফাইল ছবি

পুরনো দিন বদলেছে;সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো বদলেছে। বাঙালির জীবনে উৎসব-পার্বণের কমতি ছিলোনা আগেও, বেশির ভাগই তা ছিল নানা ধর্মসম্প্রদায়ের আবাহন থেকে। ভাগ্যাহত বাঙালি জীবনের কঠিন সংগ্রামের ফাঁকে উৎসবের আয়োজন করেছে। এর পরেও ঈদ, পুজা ইত্যাদি উৎসবগুলি সার্বজনীন সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে।

সময়ের পালাবদলে দেশ ভাগ হয়েছে, বাঙালির একাংশকে নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। উনিশশ’ ষাটের দশকে রাষ্ট্রযন্ত্রের রবীন্দ্র বিরোধীতার প্রতিবাদের পথ ধরে বাঙালি শেকড়ের সন্ধানে নামে। ঢাকার রমনা উদ্যানের সংগ্রাম ছোট থেকে বড় হয়। ক্রমান্বয়ে পহেলা বৈশাখ ধর্মবর্ণ মিলে বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়।  

প্রথম দিকে শহর-কেন্দ্রিক হলেও ক্রমান্বয়ে নববর্ষের উৎসব গ্রামগঞ্জে ছড়ায়; ধনাট্যের চৌকাঠ পেরিয়ে এর আমেজ মধ্যবিত্ত, এমন কি নিম্মবিত্তের দুয়ারে পৌছে। নববর্ষের উদযাপন এখন বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনার অন্বেষণ। যে বাংলা সন মোঘল আমলের কৃষি পণ্যের খাজনা আদায়ে প্রবর্তন করা হয়েছিল, তা আজ পরিবর্তিত রুপে আবির্ভূত হয়েছে। অর্ধ শতাব্দিরও বেশি সময় ধরে বাঙালি নববর্ষকে কেবল নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ করেই নেয়নি, সময়ের পড়তে তা সমাজ-সংস্কৃতিরও অঙ্গ হয়েছে। সময়ের যা দাপট, এ  যদি না হতো তাহলে হয়তো বাংলার লোকসংস্কৃতি কিংবা বাংলা ঋতুর কথা বাঙালির নতুন প্রজন্ম ভুলেই যেত ! 

নানা অনুসঙ্গ এসেছে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে; যুক্ত হয়েছে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ডালি, নতুন সংযোজন এসেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এই শোভাযাত্রায়, অশুভের বিনাশ কামনায়, সত্য ও সুন্দরের প্রার্থণায় শামিল হয়েছেন ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ নির্বিশেষে সব পেশার, সব শ্রেণীর মানুষ। নানা রংয়ের শাড়ি, মুখে আলপনা, বাহারি পাঞ্জাবি, ফুলের বিচিত্র শোভা, এসবের সঙ্গে তরুণদের হাতে জাতীয় পতাকা দেখে আমাদের সব কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। তারুণ্যের এ প্রত্যয় অসাম্প্রদায়িকতা পক্ষে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে; এ যেন অন্ধকার থেকে আলোতে এগিয়ে যাওয়া।

রমনার বটমূলে সাহসী বাঙালির নেতৃত্বে নবজাগরণের যে ডঙ্কা বাজছে, আজ অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় পরে সে ডঙ্কার দোলা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। এ উৎসবের মধ্য দিয়ে বাঙালির শাশ্বত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য দেশের গন্ডির বাইরে বেরিয়ে বিশ্বের দুয়ারে পৌছেছে। আরও আনন্দের বিষয় যে, বোমা মেরে, ধর্মান্ধতার শিকল পরিয়ে এ উৎসব বন্ধ করা যায়নি। ধর্মীয় অপব্যাখ্যার বর্মেও ঠেকানো যায়নি। 

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- এতে কী তুষ্ট থাকবে বাঙালি? সে সুযোগ কি আছে ? একবারে নেই। কারণ অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার বিরোধিতা আজও আত্মসমর্পন করেনি। নতুন আদলে ধর্মীয় উগ্রতা মানুষকে আজও বিভাজিত করে  চলেছে। ফলে আক্রান্ত হচ্ছে এক বাঙালি আরেক বাঙালির অসহিষ্ণুতায়!   

ধর্মের লেবাসে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পর বাঙালির ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা জেগে ওঠে। রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ সেই চেতনাকে বেগবান করে ক্রমান্বয়ে লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে নাগরিক জীবনের সেতুবন্ধ ঘটে। ১৯৭১ এর সশস্ত্র-মুক্তিযুদ্ধ সহ পালাক্রমিক জনসংগ্রাম সেই উপলব্ধিকে অপ্রতিরুদ্ধ করে। সাহিত্য ও শিল্পকলায় সে দ্যোতনা ছড়িয়ে পড়ে; নৃ-তাত্ত্বিক, সামাজিক ও ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য মিলে পহেলা বৈশাখ প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়। অনুধাবন করা উচিত, ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্টতা সত্বেও বাঙালি আমাদের রাষ্ট্রীয় ভূখন্ডে একক নয়; আছে আদীবাসী, নানা নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠী, যাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে, আছে বৈশাবিসহ সংস্কৃতির নিজস্ব আবাহন। অতএব বাঙালির নববর্ষ তখনই পূর্ণতা পাবে তখন  সকলের নববর্ষকে আমরা সম্মান জানাতে শিখবো।

পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের জন্ম প্রাসঙ্গিকতায় পহেলা বৈশাখের উদযাপন ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে যদিও, কিন্তু এর শ্বাশত আবেদন এপার-ওপারে সমান।বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, এমন কি ইউরোপ, আমেরিকাসহ  বিশ্বের নানা প্রান্তে ৩০ কোটিরও বেশি বাঙালি পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে। দুর্ভাগ্য যে, পঞ্জিকার হেরফের ঘটিয়ে সর্বজনীন উৎসব কে খন্ডিত করা হয়েছে! এমনকি ভাগ হয়ে গেছে রবীন্দ্র-নজরুলের জন্মতিথি গুলিও! এই বিভাজন দূর্ভাগ্যজনক।  

প্রশ্ন হচ্ছে, বাঙালিত্বের অবিনাসী সংস্কৃতি উপলব্ধি আমরা লালন করি? বাংলা ভাষা, এর সন-তারিখ কে কতটা সমাদর করি আমরা?  এক কালে বাঙালির জীবন জীবিকা বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী সম্পন্ন  হতো; আজ তা নেই। এক কালে বাঙালির পারিবারিক ও সামাজিক কাজকর্ম, বিবাহ, জন্ম-মৃত্যু সহ জীবনের সব প্রয়োজনে বাংলা সন তারিখ ছিল অনস্বীকার্য; আজ নেই ! দুর্ভাগ্য যে, যে নবীনেরা পহেলা বৈশাখের উৎসবে মাতেন তাদের কাছে বাংলা সন-তারিখ অপ্রয়োজনীয় হয়েছে! ইংরেজির বিশ্ব আধিপত্য অনস্বীকার্য, পরিবর্তন মেনে নিতে হবে, কিন্তু আপন ভাষা-সংস্কৃতির বিনিময় কি?

শুধু তাই নয়, বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিজাতীয় আগ্রাসন আজ নতুন মাত্রা লাভ করেছে। ভাষার বিকৃতি আবারও ধর্মান্ধ এবং সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির জাগরণ ঘটেছে, যাকে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পরাজিত করা হয়, ভুললে চলবেনা দেশের পাঠ্যপুস্তকে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দকে নির্বাসন দেওয়ার চেষ্টা চলছে! কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ আগ্রাসন সফলতা লাভ করেছে। অতএব শিক্ষা ব্যবস্থায় এই আগ্রাসন ছোট করে দেখার অবকাশ নেই।  

শিক্ষাক্ষেত্রেই নয়, বহু শাখাতেই দৃশ্যমান হচ্ছে পরিকল্পিত আগ্রাসন। মৌলবাদ ও ধর্মান্ধতা নতুন মাত্রা লাভ করার দ্বারপ্রান্তে এসেছে। ধর্মীয় বক্তিতার নামে নারীবিদ্বেষ অব্যাহত রয়েছে! প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী গোপনে, কিছু ক্ষেত্রে  প্রকাশ্যেও, অপতৎপরতা চালাচ্ছে। এসবের বিপরীতে রাষ্ট্র ও সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট, কার্যকর উদ্যোগ দরকার, যা সব ক্ষেত্রে নেই। ফলে বাঙালির সাংস্কৃতিক শক্তি ক্রমান্বয়ে বিপন্ন হচ্ছে। দেশের মাটিতে প্রভূত অর্থনৈতিক অগ্রগতির আলো জ¦ললেও বিজাতীয় সংস্কৃতির অন্ধকার ঠেকানো যাচ্ছেনা। অথচ এ অন্ধকার রোধ করা না গেলে সব আলো নিভে যাবে। 

রাজনৈতিক অঙ্গনে ধরাশায়ী হলেও ধর্মীয় উগ্রবাদ ও ধর্মান্ধতা নিত্য নতুন চেহারায় এগিয়ে আসছে। যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ উপড়ানো হয়েছে বলে অর্ধ শতক আগে বাংলাদেশ প্রশান্তি লাভ করেছে, সেই সাম্প্রদায়িকতা আজ নানা কৌশলে বিস্তৃত হচ্ছে। রাজনৈতিক ধর্মবাদীরা সাধারণ মানুষের আবেগ কাজে লাগিয়ে তৃণমূলে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের’ অভিযোগে সাধারণ মানুষ নির্যাতিত হচ্ছে। মনে রাখা দরকার, যে সমাজে উগ্রবাদীরা ধর্মের মাইক্রোফোন নিয়ন্ত্রণ করতে সফল হয় সে সমাজে ধর্মের পবিত্রতা খর্ব  হয়, তৈরি হয় ধর্মীয় উন্মাদনার ক্ষেত্র, যার কূফল দৃশ্যমান হয় সকল ক্ষেত্রে। 

শুধু এই নয়, উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো বাঙালির উদার অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি আঘাত হানছে, কখনো সরাসরি। গ্রামগঞ্জের যাত্রাপালার সংস্কৃতি প্রায় বিলুপ্ত হয়েছে। লোক ঐতিহ্যের উৎসব গুলিতে প্রতিবন্ধক তৈরির অযুহাত সৃষ্টি করা হচ্ছে। ওরা বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস, আইন, সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাবারও উদাহরণ তৈরি করছে। মাঠ প্রশাসনের উদাসীনতায় সমাজে মৌলবাদ ভীতি বেড়ে চলেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধর্মান্ধরা আশকারা পাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। অনেক ক্ষেত্রে বাউলরা আজ ধর্মব্যবসায়ীদের ভয়ে তটস্থ। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অপতৎপরতা চালানোর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বলা বাহুল্য, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিকে ‘বিধর্মীদের সংস্কৃতি’ বলে মিথ্যাচার করে রাজাকার-আদবদরের অনুসারীরা নিত্যনতুন উদ্যোগে সফল হতে চাইছে। সব মিলিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠছে নি:শব্দ মৌলবাদ।

এসবের নিয়ে নাগরিক সমাজের উদ্বেগের শেষ নেই। কারণ  রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠীর  অবস্থান পাকাপোক্ত করতে সক্ষম হলে বড় ক্ষতির কারণ হবে। অতএব  শিক্ষা ধারায় পাঠ্যসূচি থেকে যে কোন ঘৃণা সঞ্চারী রচনা বাদ দিতে হবে, বিজ্ঞানভিত্তিক ও সমতার সমাজ গড়তে হবে।  

দৃশ্যতই  ধর্মান্ধ এবং রাজনৈতিক ধর্মবাদীরা রাষ্ট্রক্ষমতার অভ্যন্তরে শিকড় বিস্তার করতে ব্যস্ত। অতএব এ প্রবণতার শিকড় উৎপাটন অত্যাবশ্যকীয় জাতীয় দায়িত্ব। কারণ এ বিপর্যয় বাংলাদেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে। আরও উদ্বেগের বিষয় যে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ডের পরেও রাষ্ট্রকে অন্ধকারের রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত করা যায়নি! প্রার্থনা করি, বাঙালির  দেশপ্রেম জাগ্রত হোক, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। বাংলা নববর্ষে এই আমার প্রার্থনা।

 লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, লেখক ও চিন্তাবিদ

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়