Apan Desh | আপন দেশ

ডলারের বিপরীতে টাকার রেকর্ড দরপতন

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১০:৪৭, ৪ জুলাই ২০২৩

আপডেট: ১২:২৭, ৪ জুলাই ২০২৩

ডলারের বিপরীতে টাকার রেকর্ড দরপতন

ফাইল ছবি

দেশের ইতিহাসে টাকার সর্বোচ্চ অবমূল্যায়ন হয়েছে। সোমবার (৩ জুলাই) বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থেকে ১০৮ দশমিক ৮৫ টাকা আন্তঃব্যাংক হারে মার্কিন ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে একদিনে স্থানীয় মুদ্রার ইতিহাসে সর্বোচ্চ দুই টাকা ৮৫ পয়সা অবমূল্যায়ন হয়।

একাধিক বিনিময় হার-ভিত্তিক ব্যবস্থা থেকে সরে এসে, বাজার-ভিত্তিক একটি একক বিনিময় হার চালুর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। একইসঙ্গে গত জানুয়ারিতে আইএমএফের অনুমোদিত চার দশমিক সাত বিলিয়ন ডলারের ঋণেরও অন্যতম শর্ত ছিল একক বিনিময় হার চালু। আর সেটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ পদক্ষেপ।

তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মৌখিক নির্দেশনা অনুসারে, বিনিময় দর ঠিক করে দিচ্ছে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা)। ফলে আন্তঃব্যাংক ডলার বাজারের ব্যবস্থাপনা এখনো তাদের হাতেই রয়েছে।

সোমবার এক বিজ্ঞপ্তিতে বাফেদা আমদানিকারকদের জন্য ডলারের দর বাড়িয়ে ১০৯ টাকা নির্ধারণ করে। বাফেদার কর্মকর্তারা জানান, গত ২৬ জুনের সভায় ব্যাংকগুলোকে সর্বোচ্চ ১০৯ টাকা দরে আন্তঃব্যাংক বাজারে ডলার ক্রয়-বিক্রয়ের নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু, অনেক ব্যাংকই আমদানিকারকদের কাছে ১০৯ টাকার বেশি দরে প্রতি ডলার বিক্রি করছিল। এখন আমদানি ব্যয় পরিশোধেও তাই একই দর কার্যকর করা হলো।

বাফেদার সাম্প্রতিকতম সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রেমিট্যান্স হিসেবে আসা ডলার ব্যাংকগুলো ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা দরে কিনতে পারবে। রফতানি আয়ের প্রতি ডলার কিনতে পারবে ১০৭ টাকা ৫০ পয়সায়।

সোমবার রিজার্ভ থেকে বৈদেশিক পেমেন্টের জন্য ব্যাংকগুলোর কাছে ৭২ মিলিয়ন ডলার নতুন আন্তঃব্যাংক দরে বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিক্রি করা ডলারের দর আগের ১০৬ টাকা থেকে বেড়েছে।

গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে ৯৩ দশমিক ৪৫ টাকা থেকে ১৬ শতাংশ বা ১৫ দশমিক চার টাকা অবমূল্যায়ন হয়েছে স্থানীয় মুদ্রা টাকার।

চলতি অর্থবছরের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার-ভিত্তিক একটি একক বিনিময় হার চালুর ঘোষণা দেয়। এই ব্যবস্থায় ডলার বা অন্য কোনো বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার বিনিময় মান নির্ধারিত হবে বাজার-চাহিদার ভিত্তিতে।   

মুদ্রানীতি বিবৃতিতে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্য রয়েছে। যার আওতায়, বাংলাদেশ ব্যাংকও বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় বা বিক্রয়ের নির্দিষ্ট কোনো দর ঘোষণা করবে না।

এর আগে চার দশমিক সাত বিলিয়ন ডলার ঋণ প্যাকেজের শর্ত হিসেবে, রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একটি একক বিনিময় হার চালুর পরামর্শ দেয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।  

গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম দ্রুত বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে বাফেদাকে রফতানি, আমদানি ও রেমিট্যান্সের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বিনিময় হার নির্ধারণের নির্দেশ দেয়।

ডলারের দর উল্লম্ফন করে ১১৫ টাকায় দাঁড়ালে, মুদ্রাবাজারের অস্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণে আনতে একাধিক বিনিময় হারের এই ব্যবস্থা চালু করা হয়। ডলারের উচ্চ দর প্রশমিত করতে এই ব্যবস্থা কার্যকর প্রমাণিত হলেও, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিম্ন দরে ডলার কিনতে শুরু করলে– দ্রুত পতনের মুখে পড়ে ফরেক্স রিজার্ভ।

অন্যান্য বাজার দরের চেয়ে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির দর উল্লেখযোগ্যভাবে কম থাকায়, বাংলাদেশ ব্যাংক এই ব্যবধান কমিয়ে আনতে টাকার দ্রুত অবমূল্যায়নের পদক্ষেপ নেয়।

এদিকে একাধিক বিনিময় হার চালুর পর ২০২৩ সালে মে মাস নাগাদ দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমে ২৯ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরেও যা ছিল ৩৬ দশমিক চার বিলিয়ন ডলার। তবে আন্তর্জাতিক সহযোগীদের থেকে বাজেট সহায়তা পাওয়ায় জুনে রিজার্ভ কিছুটা বেড়ে ৩১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়।

রিজার্ভের অবনতির মধ্যেই বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উঁচু মাত্রার দুর্বলতা ও তারল্যের ঝুঁকি থাকার কথা উল্লেখ করে মে মাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের ঋণমান কমায় মুডিস ইনভেস্টরস সার্ভিস। মুডিসের প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশের ঋণমান কমানোর ক্ষেত্রে একাধিক বিনিময় হার চালু থাকার বিষয়টিও তাদের পর্যালোচনায় ছিল।  

এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন বাজার-ভিত্তিক বিনিময় হার চালুর উদ্দেশ্যে পদক্ষেপ নিচ্ছে। আর তাতেই একদিনে সর্বোচ্চ অবমূল্যায়ন হলো টাকার। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ মানুষের যখন নাভিশ্বাস উঠছে, তারমধ্যেই আরও কমলো টাকার মান।  

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, আন্তঃব্যাংক হারে ডলার বিক্রির মাধ্যমে আইএমএফের শর্তপূরণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আইএমএফের একক হারের ধারণার সাথে এটি সঙ্গতিপূর্ণ হওয়ায়, তাদের শর্তপূরণ হয়েছে।  

তিনি বলেন, আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার বর্তমানে কার্যকর কোনো বাজার নয়। বর্তমানে এই বাজারে দৈনিক এক-দুই মিলিয়ন লেনদেন হচ্ছে। কিন্তু, যখন একাধিক বিনিময় হার ছিল না, তখন বাজারটি ছিল আরও সক্রিয়। আমি একদিনেই ৬০০ মিলিয়ন লেনদেন হতে দেখেছি। তাই আন্তঃব্যাংক হারকে বাজার-ভিত্তিক দর বলা যাবে না।

তিনি আরও বলেন, রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের ডলার কেনার দরে সীমা থাকায়, আন্তঃব্যাংক হারের বাজার-ভিত্তিক চালিকাশক্তির অভাব রয়েছে। যেমন ব্যাংকগুলো যে দরে ডলার কিনছে, তার ওপর সর্বোচ্চ এক টাকা মুনাফা করতে পারে, এতে ডলার কেনার ওপর একটা সীমা আরোপ হয়ে যাচ্ছে; যা আন্তঃব্যাংক হারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।   

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফারাহ মো. নাসের বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে ব্যাংকগুলোর কাছে নতুন আন্তঃব্যাংক হারে ডলার বিক্রি করা হয়েছে।

আপন দেশ/আরএ

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়