Apan Desh | আপন দেশ

রেমিট্যান্সে প্রণোদনা: প্রধানমন্ত্রীর উপহার ও কিছু প্রস্তাবনা

তপন দেবনাথ

প্রকাশিত: ১২:০৫, ৩ অক্টোবর ২০২৩

আপডেট: ০১:৩৩, ৪ অক্টোবর ২০২৩

রেমিট্যান্সে প্রণোদনা: প্রধানমন্ত্রীর উপহার ও কিছু প্রস্তাবনা

ফাইল ছবি

বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একমাত্র দেশ, যে দেশের সরকার প্রবাসীদের স্বদেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর প্রণোদনা দিয়ে থাকে। এই ব্যবস্থা প্রবাসে অর্থ উপার্জনকারী একজন প্রবাসী বাংলাদেশীর প্রতি অতি উচ্চস্তরের সম্মান এবং পরিশ্রমকে সরকার অতি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে বলে আমি মনে করি।

যখন প্রণোদনা দেয়া হতো না তখনো প্রবাসীরা দেশে অর্থ পাঠাতেন। একজন প্রবাসী তার বিদেশে উপার্জিত অর্থ স্বদেশে না পাঠিয়ে কী করবেন? দেশে পরিবার পরিজন, যাদের মুখের হাসি ফোটানো এবং নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করার জন্য নিজের দেশ ত্যাগ করে অধিক অর্থ উপার্জনের প্রত্যাশায় একজন লোক স্বদেশ ত্যাগ করে বিদেশে কঠোর পরিশ্রমে নিয়েজিত হন।

বাংলাদেশের বর্তমান প্রবাসীবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর দুই শতাংশ হারে প্রণোদনা ঘোষণা করেন। এই ঘোষণায় রেমিট্যান্স প্রেরণকারী ও তাদের আত্মীয় পরিজনের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। কারণ প্রবাসীদের পাঠানো টাকার সাথে পরিবারগুলো সরকারের পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ ফাও কিছু টাকা পাবে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে আমাদের এক বিশাল জনগোষ্ঠি এর আওতার বাইরে থাকে এবং সীমিত সংখ্যক লোকের লাভের বোঝা বহন করতে হয় পুরো জাতিকে। প্রণোদনা ঘোষণাকালীন এক ইউএস ডলারে বাংলাদেশে ৮৫/৮৬ টাকা পাওয়া যেত যা বর্তমানে ১১৪/১১৫ টাকা পাওয়া যায়। রেমিট্যান্স প্রেরণকারী এবং তার পরিবারবর্গ ভালোই আছে বলা যেতে পারে। কিন্তু যাদের জীবনে ডলার বা রেমিট্যান্স এবং প্রণোদনার কোনো সম্পর্ক নেই তাদের জীবনযাত্রা এখন কোন পর্যায় আছে?

দেশে ডলারের দাম বৃদ্ধি পেলে রফতানিকারকরা এবং রেমিট্যান্স প্রেরণকারীরা যে লাভবান হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশ বছরে যত টাকার পণ্য রফতানি করতে পারে আমদানি করতে হয় তার চেয়ে ঢের বেশি এবং বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমদানিকৃত পণ্যের দাম ইউএস ডলারেই পরিশোধ করতে হয় এবং আমদানিকারকদের বেশি মূল্য দিয়েই ডলার কিনতে হয়। বেশি মূল্য দিয়ে পণ্য ক্রয় করলে বাজারে পণ্যের মূল্য বেড়ে যায়। পাঠকগণ এতক্ষণে হয়তো বুঝতে পেরেছেন একটি ক্রিয়ার কতগুলো প্রতিক্রিয়া থাকে। সীমিত কিছু সংখ্যক লোক লাভবান হলেও দায়ভার বহন করতে হয় পুরো জাতিকে।

২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে রেমিট্যান্স প্রণোয়ন শতকরা দুই ভাগ থেকে বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করা হয়েছে। এটাকে প্রধানমন্ত্রীর প্রবাসীদের জন্য উপহার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর উপহার গ্রহণ করেছি এবং লাভবান হচ্ছি। প্রধানমন্ত্রীর ভাষাতেই বলতে চাই যে এতে তো পণ্যের ক্রয়মূল্য আরো বেড়ে গেল। সর্বোচ্চ সুবিধা হিসেবে প্রায় বছরখানেক আগে থেকে বাংলাদেশি ব্যাংকগুলো থেকে রেমিট্যান্স প্রেরণ করলে তার কমিশন ফি-ও মওকুফ করা হয়েছে। ২৩ বছর ধরে রেমিট্যান্স প্রেরণ করে আসছি এবং বর্তমান সুবিধাগুলো সর্বকালের সুবিধার মধ্যে অন্যতম, তারপরেও আমি তৃপ্ত হতে পারছি না কেন?

বিনা ফি-তে বাংলাদেশি ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স প্রেরণ করলে প্রবাসে তাদের অফিস ভাড়া, কর্মচারির বেতন এবং আনুষঙ্গিক খরচ কে বহন করে থাকে? একমাত্র সরকার এই ব্যাংকগুলোর সংগৃহীত রেমিট্যান্সের ক্রেতা। সেক্ষেত্রে সরকারকেই এক্ষেত্রে সাবসিডি দিতে হচ্ছে বলে আমার ধারণা। সব মিলিয়ে একটি ইউএস ডলার সংগ্রহ করতে সরকারকে মোট কত টাকা ব্যয় করতে হয় সেই হিসাব এখন আর মেলানোই যাচ্ছে না। দেশীয় আমদানিকারকরা তাদের পণ্যমূল্য পরিশোধ করতে যেহেতু এই ডলারই ক্রয় করে থাকেন সেহেতু তাদেরকে বেশি দাম দিয়েই ডলার কিনতে হয়। এমনকি বিদেশ থেকে যে পণ্যটি আমদানি করা হয় সংশ্লিষ্ট পণ্যটির মূল্য বিদেশে না বাড়লেও শুধু উচ্চমূল্যে ডলার ক্রয়ের ফলে পণ্যটির মূল্য বৃদ্ধি পেতে বাধ্য। এই ব্যাপারে সরকারের অভিজ্ঞ নীতি নির্ধারকরা কী ভাবছেন? যারা প্রণোদনা আরো বাড়ানোর জন্য দাবি করছেন এবং যারা তাতে সায় দিচ্ছেন তারা এর সুফলের চেয়ে বেশি হওয়া কুফলের দিকে নজর দিচ্ছেন না।

নানাভাবে ভর্তুকি দিয়ে সরকারের রেমিট্যান্স সংগ্রহ বা ইউএস ডলার সংগ্রহ যে রাষ্ট্রের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিও যে রাষ্ট্রের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইতোপূর্বে সৌদি আরব ছিল সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স প্রদানকারী দেশ। বর্তমানে সৌদি আরবকে পিছনে ফেলে যুক্তরাষ্ট্র রেমিট্যান্স প্রেরণকারী দেশের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে। এরপর বাংলাদেশের পোশাক আমদানিকারক দেশ হিসেবেও যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষে রয়েছে। সুতরাং বলা যেতেই পারে যে দেশে ডলার রিজার্ভের সিংহভাগ যুক্তরাষ্ট্র থেকেই হয়ে থাকে। যদিও এটি আসল কথা নয়।

যে কথা বলার জন্য আমার এই নিবন্ধ লেখার উদ্দেশ্য, তা হলো কীভাবে রেমিট্যান্স প্রদানকারীদের আরও বেশি সম্মান দেখিয়ে ডলারের মূল্য না বাড়িয়ে স্থিতিশীল রাখা যায়। একজন রেমিট্যান্স প্রদানকারী হিসেবে আমি আরও বেশি সুবিধা চাইব সেটিই স্বাভাবিক, কিন্তু দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির কথা না ভাবলে চলবে কী করে? কেননা দেশে রেখে আসা আত্মীয় পরিজনও যে বৃহত্তর জনগোষ্ঠিরই একটা অংশ। সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে দেশে ডলার দিয়ে কেউ কোনো পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করে না। কাজেই এই তেজী বস্তুটি তাদের নাগালের বাইরেই থেকে যায়। কিন্তু আমদানি করা কোনো পণ্য ক্রয় করতে গেলেই তারা টের পায় যে বাংলাদেশি টাকার মান কত নিচে নেমে গেছে।

আমি অর্থনীতিবিদ নই, একজন ছাপোষা মানুষ। দেশের আত্মীয়-পরিজন সুখে থাকুক সে প্রত্যাশা যেমন আছে তেমনি প্রত্যাশা দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির প্রতিও। তাই আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় সরকারের প্রতি পরামর্শ এই যে, আর কোনোভাবেই যেন ডলারের মূল্য বৃদ্ধি না পায় সে দিকে সরকারকে কঠোরভাবে নজর দিতে হবে। এটি প্রায় স্পষ্ট যে রেমিট্যান্স প্রদানে বিশেষ সুবিধা প্রদানের পরও রিজার্ভ খুব একটা বাড়েনি। বরং ডলারের মূল্য বৃদ্ধির ফলে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য লাগামছাড়া বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেহেতু দেশের সাধারণ জনগণ ডলার ব্যবহার করেন না সেহেতু এর মূল্য যেন জনগণের ওপর প্রভাব না ফেলে, সে বিষয়টি সরকারকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। দেশে যারা ডলার ব্যবহার করেন বা যাদের কাজের জন্য সরকারে এত প্রচেষ্টা সেক্ষেত্রে ডলার ব্যবহারকারীদের একটি ভূমিকা থাকা দরকার বলে আমি মনে করি। সব দায়ভার সরকারকে নিতে হবে কেন? ডলার দিয়ে পণ্য আমদানি করে দাম বৃদ্ধি করে তার লভ্যাংশ তো সরকারকে দেয়া হয় না বরং জনগণের পকেট ফাঁকা করা হচ্ছে। সুতরাং সরকারের ডলার সংগ্রহ প্রচেষ্টার সাথে এর ব্যবহারকারীরও প্রচেষ্টা থাকা দরকার। রেমিট্যান্স প্রেরণকারীকে প্রণোদনা প্রদান করে ডলারের দাম বৃদ্ধি না করে অন্য আর কী উপায়ে তাদেরকে লাভবান ও সম্মানিত করা যায় তার একটি পন্থা খুঁজে বের করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রবাসীদের বিমান ভাড়ায় কোনো ভর্তুকি দেয়া যায় কিনা ভেবে দেখা যেতে পারে। রেমিট্যান্স প্রদানকারী যে দেশে বাস করেন এবং যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রেরণ করেন তার একটি সনদ গ্রহণ করে দেশে আসা যাওয়ার সময় বিমান বন্দরে তাদেরকে সকল প্রকার হয়রানি থেকে বিরত রেখে রেমিট্যান্স প্রদানকারীকে সম্মান জানানো যেতে পারে।

বিদেশে কর্মী প্রেরণ আরও সহজতর এবং বাংলাদেশ বিমান চলাচল করে এমন দেশে প্রথমবার যাওয়া-আসার ভাড়া মওকুফ করে একজন রেমিট্যান্স প্রেরণকারীকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা যেতে পরে। দেশের অপ্রচলিত পণ্য রফতানির দিকে বিশেষ নজর দেয়া দরকার। ট্যুরিজমকে আরও গতিশীল করা দরকার। এক্ষেত্রে বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোর ভূমিকা শূন্যের কোটায়। সরকারকে ঠেলা মেরে মিশন কর্মকর্তাদের ঘুম ভাঙাতে হবে। বাংলাদেশের প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে ডলারের পরিবর্তে দুই দেশের প্রচলিত মুদ্রায় লেনদেন করে ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা অনেক কমানো যেতে পারে। ডলার যে দেশের নিজস্ব মুদ্রা নয় এবং অপর দেশের মুদ্রাও নয় সেক্ষেত্রে বৈদেশিক লেনদেন কেন তৃতীয় দেশের একটি মুদ্রা ব্যবহার করতে হবে-এটি ভেবে দেখার সময় হয়েছে।

গত এক বছরে প্রতি ইউএস ডলারের দাম বেড়েছে কমপক্ষে ত্রিশ টাকা। এতে রেমিট্যান্স প্রেরণকারীরা অভাবনীয় লাভবান হয়েছেন বলা যায়। কিন্তু ডলার দিয়ে দেশে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য কতগুণ বেড়েছে এবং লাভের পরিবর্তে কতটা জাতীয় ক্ষতি হয়েছে তা হিসাব করে দেখা দরকার। শুধু দাম বাড়ালেই এবং প্রণোদনা বৃদ্ধি করলেই যদি ডলার প্রবাহ বৃদ্ধি পেত তাহলে এতদিনে ডলারের চাপে তো বাংলাদেশ ব্যাংকে স্থান সংকুলান সমস্যা দেখা দিত। তাহলে এটি বোঝাই যাচ্ছে যে ডলারের দাম বৃদ্ধি বা প্রণোদনা প্রবাহ বাড়ানো একমাত্র পন্থা নয়। ডলার প্রবাহ বাড়ানোর বিকল্প পথগুলো নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে এবং ডলারের দাম বৃদ্ধি পেলে যে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে জনজীবনে তার প্রভাব পড়ে- সে বিষয়েও সতর্কভাবে ভাবতে হবে।

তপন দেবনাথ : যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী, সাহিত্যিক ও কলাম লেখক।

আপন দেশ/আরএ

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়