Apan Desh | আপন দেশ

ওয়াজেদ মিয়ার দুঃসহ দিনলিপি

রাহাত মিনহাজ

প্রকাশিত: ১৩:১৩, ৫ আগস্ট ২০২৩

আপডেট: ১২:২৬, ৬ আগস্ট ২০২৩

ওয়াজেদ মিয়ার দুঃসহ দিনলিপি

ফাইল ছবি

বিজ্ঞানী ওয়াজেদ মিয়ার স্ত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাবা বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বপ্নের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি। নানাবিধ সমস্যা আর ষড়যন্ত্রের পরও যিনি কঠিন হাতে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে এগিয়ে নিচ্ছিলেন।

দুই ভাই নব বিবাহিত। বাড়িতে বিয়ের আমেজ। ছোট্ট রাসেল নিশ্চয় সে সময় বেশ আনন্দে সময় পার করছিল। নতুন দুই সদস্য সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল ধীরে ধীরে মানিয়ে নিচ্ছিলেন বেগম মুজিব ও ৩২ নম্বরের পরিবেশের সঙ্গে। এমনই এক আনন্দঘন পরিবার রেখে ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট ইউরোপের পথে পাড়ি দিয়েছিলেন ওই বাড়ির বড় সন্তান শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা। সঙ্গে শেখ হাসিনার স্বামী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া, শিশুপুত্র জয় ও কন্যা সায়মা। জার্মানিতে বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর আমন্ত্রণে বন-এ গিয়েছিলেন তারা। সেখান থেকে ব্রাসেলস যান ১২ আগস্ট।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জামাতা ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া শুধু আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন পরমাণু বিজ্ঞানীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। তিনি বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্রের অনেক উত্থান-পতন, চড়াই-উতরাই খুব কাছ থেকে দেখেছেন। ১৫ আগস্টের বিভীষিকার পর বঙ্গবন্ধু পরিবারের এক দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে অতি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৫ আগস্টের পরের সেই দিনগুলোর চিত্র পাওয়া যায় তার অত্যন্ত সুপাঠ্য স্মৃতিকথামূলক ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে। বইটির পাতায় পাতায় স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধু পরিবারের দুঃসহ সেই সব দিনের কথা।

আরও পড়ুন<< খায়রুল আলমের লেখা: বঙ্গমাতা : জাতির পিতার প্রেরণাদায়ী ও মমতাময়ী সহচর

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট। ওই দিন ভোরে যখন ৩২ নম্বর আক্রান্ত, তখন সাতসমুদ্র তের নদী পার ব্রাসেলসে মাত্র মধ্যরাত পার হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে ভোর আর ইউরোপে ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী মাত্র নতুন একটা দিন শুরু। দিনটি সেই কাল দিন, ১৫ আগস্ট। জাতির পিতার নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের পাঁচ ঘণ্টা পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার খবর পৌঁছায় শেখ হাসিনার স্বামী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার কাছে। ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন, ১৫ আগস্ট ভোরে আমার ঘুম ভাঙে ব্রাসেলস্ এ বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের স্ত্রী’র ডাকে। তিনি জানান, জার্মানীর বন থেকে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ফোন করেছেন। ফোনে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী জানান ‘বাংলাদেশে কূ-দে-তা হয়ে গেছে। আপনারা আর প্যারিস যাবেন না। বিষয়টি হাসিনা আর রেহানাকেও জানাবেন না।’... এরপর আমি আস্তে আস্তে তিন তলায় চলে আসি। হাসিনা অশ্রুজড়িত কণ্ঠে জানতে চান কী হয়েছে? তিনি কী বলেছেন? আমি বলি, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী প্যারিস যাত্রা বাতিল করে বন-এ ফিরে যেতে বলেছেন। আর বাংলাদেশে কী যেন ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছে যাতে আমাদের আর প্যারিস যাওয়া নিরাপদ নয়। এ শুনেই কান্নায় ভেঙে পড়েন দুই বোন।

ড. ওয়াজেদ বর্ণনা করেছেন, ‘ব্রাসেলস থেকে ১৫ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে তারা বনের উদ্দেশ্যে রওনা হন। এমন সময় হাসিনা আর রেহানা সারাক্ষণ কান্নাকাটি করছিলেন। বিকেল ৪টার দিকে তারা হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বাড়িতে পৌঁছান। এদিকে যুগোস্লাভিয়া সফর শেষে ফ্রাঙ্কফুটে যাত্রা বিরতির সময় হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বাসায় আসেন ড. কামাল হোসেন। তখন ওয়াজেদকে বলা হয় বিবিসির ভাষ্য অনুযায়ী, বেগম মুজিব আর রাসেল ছাড়া কেউ বেঁচে নেই। আবার ঢাকায় ব্রিটিশ মিশনের বরাত দিয়ে কিছুক্ষণ পরই বলা হয়, মুজিব পরিবারের কেউই বেঁচে নেই। এমন সময় আমরা তিনজনই একমত হই যে, একমাত্র ভারতই হতে পারে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নিরাপদ স্থান।’

আরও পড়ুন: কানাই চক্রবর্তীর লেখা- বিশ্বশান্তি ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের মূলনীতি

এম এ ওয়াজেদ মিয়া আরও লিখেছেন, কঠিন সেই দুঃসময়ে স্ত্রী শেখ হাসিনা, শ্যালিকা রেহানা, শিশুছেলে জয়, মেয়ে পুতুলের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও প্রাণ রক্ষার জন্য ভারত সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করা হয়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আশ্রয় দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে ২৫ আগস্ট জার্মানির ফ্রাঙ্কফুট থেকে দিল্লির উদ্দেশে রওনা হন তারা। এয়ার ইন্ডিয়ার জ্যাম্ব জেটটি তাদের নিয়ে পৌঁছায় দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে। প্রথমে তাদের নেয়া হয় ডিফেন্স কলোনির এক ফ্ল্যাটে। সে সময় ভারত সরকারের এক যুগ্ম সচিব ওয়াজেদ ও শেখ হাসিনাকে জানান, রাত ৮টায় তাদের এক বাসায় নেয়া হবে বিশেষ সাক্ষৎকারের জন্য। সেই রাতে ওই বাসায় যাওয়ার পথে তাদের সঙ্গে অপর এক গাড়িতে আসেন ভারত সরকারের উচ্চ পদস্থ আরেক কর্মকর্তা। ১৫ মিনিটের যাত্রা শেষে তারা পৌঁছান ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনে। একটা লম্বা সোফায় বসেন শেখ হাসিনা। ওয়াজেদ মিয়া অন্য একটি সোফায়। প্রায় ১০ মিনিট পর ওই ঘরে প্রবেশ করেন ইন্দিরা গান্ধী। তিনি এসে শেখ হাসিনার সোফায় বসেন। সামান্য কুশল বিনিময়ের পর ইন্দিরা গান্ধী তাদের কাছে জানতে চান ১৫ আগস্ট ঘটনা সম্পর্কে তারা অবগত আছেন কিনা? এর জবাবে জার্মানিতে থাকা অবস্থায় তারা যেসব তথ্য পেয়েছিলেন সেসব তথ্যই পুনরায় উল্লেখ করেন। এ সময় ইন্দিরা গান্ধী তার শীর্ষ কর্মকর্তাকে এ সম্পর্কে সব শেষ তথ্য তুলে ধরতে বলেন। পাশে দাঁড়ানো কর্মকর্তা দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে জানান, ঢাকায় মুজিব পরিবারের আর কেউ বেঁচে নেই। শেখ হাসিনা আবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় ইন্দিরা গান্ধী শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘তুমি যা হারিয়েছ তা কোনোভাবেই পূরণ হওয়ার নয়। তোমার একটি ছেলে ও একটি মেয়ে রয়েছে। এখন থেকে তোমার ছেলেকেই তোমার আব্বা আর মেয়েকেই মা হিসেবে ভাবতে হবে। তোমার ছেলে-মেয়ে ও বোনকে মানুষ করার ভার তোমাকেই নিতে হবে। এতএব তোমার কোনো অবস্থাতেই ভেঙে পড়লে চলবে না।’ (পৃষ্ঠা ২৫১-২৫২)

আরও পড়ুন<< হারুন হাবীবের লেখা: বাঙালি সংস্কৃতির বাড়ন্ত প্রতিপক্ষ

ওয়াজেদ মিয়া আরও উল্লেখ করেছেন সেই দফায় ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতা থাকাকালে এটিই ছিল ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাদের একমাত্র সাক্ষাৎ। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে ইন্ডিয়া গেটের কাছে পান্ডারা রোডের এক দোতলা বাড়ি তাদের জন্য নির্ধারণ করা হয়। এক তলায় দুটো ফ্ল্যাট। একটি ফ্ল্যাটে কোনো আসবাপত্র ছিল না। এরপর ভাড়ায় কিছু আসবাবপত্রের ব্যবস্থা করা হয়। এদিকে ভারত সরকার ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে ভারতীয় আণবিক শক্তি কমিশনে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়। পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপ। যার শর্ত অনুযায়ী ওয়াজেদ মিয়াকে বাসা ও অফিসের যাতায়াত সুবিধাসহ দৈনিক প্রদান করা হতো মাত্র বাষট্টি রুপি পঞ্চাশ পয়সা। ড. ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন, ‘সেই সময় আমাদের কঠিন কিছু নিয়ম মেনে চলতে হতো। অর্থাৎ বাইরের কারও কাছে আমাদের পরিচয় না দেয়া। কারও সঙ্গে কোন যোগাযোগ না করা এবং নিরাপত্তা প্রহরী ছাড়া বাইরে না যাওয়া। বিষয়গুলো তারা কঠোরভাবে মেনে চলতেন। এদিকে সময় কাটানো ও নিজেদের ব্যস্ত রাখতে বাসায় সরবরাহ করা হয় ভারতীয় একটি সাদা-কালো টিভি। এ ছাড়া আরও একটি নিজস্ব ট্র্যানজিস্টার ছিল। বাসায় কোনো টেলিফোন ছিল না। সুতরাং বাংলাদেশ সংক্রান্ত খবরা-খবর পাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল ওই ট্র্যানজিস্টার। এভাবেই নানা শঙ্কা আর অনিশ্চয়তায় দিন কাটে জাতির জনকের দুই কন্যার।’ ভারতে টানা ছয়টি বছর অসহায় সময় কাটে জাতির পিতার দুই কন্যা শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানার।

এরপর ১৯৮১ সালে ভারত থেকে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। গত কয়েক বছরে ইট-কাঠের ঢাকা মহানগরী খুব একটা না বদলালেও তত দিনে বদলে গেছে একজন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পুরো পৃথিবী। বদলে গেছে বাংলাদেশ।

রাহাত মিনহাজ : সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। 

আপন দেশ/আরএ

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়