Apan Desh | আপন দেশ

পোশাকের ধারে-ভারে দুই সহোদর শত কোটি টাকার মালিক

আফজাল বারী

প্রকাশিত: ১৯:৪৮, ৬ আগস্ট ২০২৩

আপডেট: ২০:৩৬, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

পোশাকের ধারে-ভারে দুই সহোদর শত কোটি টাকার মালিক

দুই সহোদর মো: নুর আলম ও মো: সারে আলম

পিতার চারচালা টিনের ঘর দু’পাশ ঠেলে উঠেছে ডুপ্লেক্স আলিশান বাড়ি। সম্পদ বেড়েছে বিদ্যুৎ গতিতে। অর্থে অঙ্ক ছাড়িয়েছে দেড়শ’ কোটি। আটপৌরে বয়ষ্ক গৃহিনী মাতাও হয়ে গেছেন পুরোদস্তুর ‘ব্যবসায়ী’। ভাইদের হাতের কব্জিতে শোভা পাচ্ছে স্বর্ণের মোটা ব্রেসলেট।

সড়কের দু’ধারে ধূলা উড়িয়ে পৎ পৎ করে চলে তাদের গাড়ি। সামনে-পেছনে ডজনখানেক মটরসাইকেলের বহর। এই বিত্ত-বৈভব এনে দিয়েছে রাষ্ট্রীয় ইউনিফর্ম। জামাতাদের উছিলায় সম্পদ বেড়েছে শ্বশুরকুলেও।

এটি কোনো জমিদার পরিবারের বর্ণনা নয়। দরিদ্র পিতার সন্তান নূরে আলম এবং সারে আলম। তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া আশুগঞ্জ দুর্গাপুর ইউনিয়নের সোহাগপুর (নাকরপাড়া) গ্রামের বাসিন্দা। পিতার নাম মো: আক্তারুজ্জামান, মাতার নাম মা লুৎফা বেগম। মো: নূরে আলম (বিপি নং-৭৭০৬১১৯৭৮৭) এখন সীমান্তবর্তী জয়পুরহাটের পুলিশ সুপার (এসপি)। সহোদর  মো: সারে আলম (বিপি নং-৭৮০৩০১০৮১৭) পুলিশের এসআই (সার্জেন্ট) হিসেবে নিয়োগ লাভ করে এখন পুলিশের ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এ কর্মরত। মা লুৎফা বেগম সাধারণ একজন গৃহিনী।

পিতার অর্থ-বিত্ত বলতে তেমন কিছুই ছিল না। কিন্তু দুই ভাই পুলিশের চাকরি পাবার পরই  বিদ্যুৎ গতিতে বাড়তে থাকে তাদের অর্থ-বিত্ত। পৈত্রিক ভিটায় তুলেছেন আলীশান ডুপ্লেক্স বাড়ি। নামে-বেনামে কিনছেন অজস্র সম্পত্তি। কম করে হলেও দেড় শ’ কোটি টাকার সম্পদের মালিক তারা। তাদের দুর্নীতিলব্ধ এসব বিষয় সম্পত্তির বিস্তারিত বিবরণ সমৃদ্ধ অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একাধিকবার জমা পড়েছে।  

অভিযোগগুলো শতভাগ দুদকের তফসিলভুক্ত হলেও রহস্যজনক  কারণে মামলা হয়নি একটিও।   

নূরে আলম-সারে আলমদের কত সম্পদ ?

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, তাদের দুই ভাইয়ের সম্পদের মধ্যে রয়েছে : রাজধানীর লাল মাটিয়ায় ব্লক ‘বি’এর হোল্ডিং নং-১/১০, ব্লক-বি, তে অবস্থিত প্রায় ২২শ’ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট। এর আনুমানিক মূল্য প্রায় সাড়ে ৫ কোটি  টাকা। পিতা আক্তারুজ্জামানের নামে প্রতিষ্ঠিত নূরে আলম-সারে-আলমের রয়েছে ‘মেসার্স আক্তারুজ্জামান কোং’ নামে  একটি  প্রতিষ্ঠান। এর অধীনে ‘আক্তারুজ্জামান-১’ নামে রয়েছে একটি বাল্ক হেড। ৩০ হাজার সিএফটি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন এই নৌযানটির মূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা। কথিত পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স আক্তারুজ্জামান’ সাইন বোর্ডের আওতায় বিআইডব্লিউটিএ’র অনুমোদনহীন এই বাল্ক হেড দিয়ে চলে বালু সন্ত্রাস। মেঘনার বুক চিড়ে বালু উত্তোলনের মাধ্যমে নদী ভাঙনের কারণ সৃষ্টি করা হয়। বিপরীতে বালুর স্তুপের মতোই উঁচু হয় নূরে আলম-সারে আলমের পরিবারের সম্পদের পাহাড়।

নূরে আলমের শ্বশুর মোমিন খাঁন। এই নামে ‘মোমিন খান-১’ নামে রয়েছে ৫০ হাজার সিএফটি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন আরেকটি বাল্কহেড। অনুমোদনহীন এই নৌ যানটির মূল্য প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা। ‘মোমিন খান-২’ নামে রয়েছে ২০ হাজার সিএফটি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বাল্কহেড। এটির মূল্যও কোটি টাকার কম নয়। কোনো বাল্ক  হেডেরই এমভি (মোটর ভ্যাসেল) নম্বর নেই। ‘পারিবারিক ব্যবসা’র আওতায় দুই পুলিশ কর্মকর্তার রয়েছে এস্কেভেটর। অন্তত: ১০টি ড্রাম ট্রাক। এসবের মোট মূল্য প্রায় ৮ কোটি টাকা। নূরে আলম ও তার পরিবারের সদস্যরা ব্যবহার করেন টয়োটা এ্যাসকয়ার (নং-ম-০০-০৫০৯) মাইক্রোবাস। সারে আলম ব্যবহার করেন প্রিমিও জি সুপিরিয়র মডেলের (নং-ঢাকা মেট্টো-গ-২৭-৬১২৯) গাড়ি। তার স্ত্রী ব্যবহার করেন টয়োটা (নং-ঢাকা মেট্টো-গ-২২০৩৫০৪) গাড়ি। 

পুলিশ ভ্রাতৃদ্বয় স্বনামে, মা এবং ভাইয়ের নামে কিনেছেন বিপুল স্থাবর সম্পত্তি। নৌবন্দর ও বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে প্রসিদ্ধ আশুগঞ্জ সোনারামপুর মৌজায় বিভিন্ন দাগে মূল্যবান এই সম্পত্তি গুলোর অবস্থান। এর মধ্যে ২০১৮ সালে দাতা আলকাছ গংয়ের কাছ থেকে মা লুৎফা বেগম গংয়ের নামে আশুগঞ্জ থানাধীন বাণিজ্যিক এলাকায় সোনারামপুর, সোহাগপুর ও বাহাদুরপুর মৌজায় বিভিন্ন দাগে কিনেছেন বিঘার বিঘা সম্পত্তি। জমির মধ্যে রয়েছে- () বাহাদুরপুর মৌজায় ছোট ভাই শফিউল আলম ইমনের নামে কিনেছেন ( দলিল নং-১২০৫/২০২৩) ৫৬ শতাংশ জমি।  ()  নূরে আলমের নামে সোহাগপুর মৌজায় কিনেছেন (দলিল নং-১২৯২/২০২০) সাড়ে ৩ শতাংশ। () একই মৌজায় হাসিনা বেগমের কাছ থেকে কিনেছেন (দলিল নং-২৮৩৬/২০২১)  ১.১০ শতাংশ। () খোদেজা বেগমের কাছ থেকে কিনেছেন (দলিল নং-২৮৬৬/২০২১)৭.৫০ শতাংশ। () আলকাছ গংয়ের কাছ থেকে মা লুৎফা বেগমের নামে কিনেছেন (দলিল নং-১১৭০/২০১৮)০.৪৫ শতাংশ।

() ২০১৯ সালে নাছির মিয়া গংয়ের কাছ থেকে একই নামে কেনাহয়েছে (দলিল নং-১৫৭/২০১৯) ২.৩৮ শতাংশ জায়গা। () ২০১৮ সালে ফজলে শিকদারের কাছ থেকে নূরে আল মনিজ নামে  (দলিল নং-৩০৬১/২০১৮) কিনেছেন ১৫ শতাংশজায়গা। () মহিউদ্দিন শিকদারের কাছ থেকে মা লুৎফা বেগমের নামে কেনা হয়েছে (দলিল নং-১১২/২০১৯) ৪৫ শতাংশ জায়গা। () শফিউল আলমের নামে মিজান শিকদারের কাছ থেকে কেনা হয়েছে (দলিল নং-৯৪৮/২০২০)৮ শতাংশ জায়গা। (১০) এর আগে শফিউল আলমগংয়ের নামে দেন শিকদারের কাছ থেকে কেনা হয় (দলিল নং-২৩০৯/২০১৯) ৭৫ শতাংশ জমি। (১১) মা লুৎফা বেগমের নামে কেনা হয় (দলিল নং-৬৮৯/২০১৯) ১.১২ শতাংশ জায়গা। (১২)  নূওে আলম নিজ নামে কেনেন (দলিল নং-২৯৯৫/২০১৮)৯৪ শতাংশ জমি। (১৩) মা লুৎফা বেগম গংয়ের নামে জসিম উদ্দিনের নামে কেনেন (দলিল নং-১০২৩/২০১৯) ৮৮ শতাংশ জমি।(১৪) নূরে আলম নিজ নামে এমদাদুল সিকদারের কাছ থেকে কেনেন (দলিল নং-২৯৯৬/২০১৮) ১৫ শতাংশ জায়গা। (১৫) মা লুৎফা বেগম গংয়ের নামে হুমায়ুন কবিরের কাছ থেকে কেনেন (দলিল নং-১১৩৭/২০১৮)১.৯৪ শতাংশ জায়গা। (১৬) ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত জগৎ বাজার বাণিজ্যিক এলাকায় নূরে আলমের  স্ত্রী এবং তার শ্বশুরের নামের রয়েছে ১৫ শতাংশ জায়গা। (১৭) সোনারামপুর ইদন শিকদারের কাছ থেকে শফিউল আলম গংয়ের নামে কেনেন (দলিল নং-২৩০৯/২০১৯) ০.৭৫ শতাংশ।  (১৮) একই মৌজায় আব্দুস সালামের কাছ থেকে লুৎফা বেগম গংয়ের নামে কেনা (দলিল নং-৬৮৯/২০১৯) হয় ১.১২ শতাংশ। (১৯) নূরে আলমের নামে কেনা (দলিল নং-২৯৯৫/২০১৮) হয় ০.৯৪ শতাংশ। (২০) লুৎফা বেগম গংয়ের নামে জসিমউদ্দিনের কাছ থেকে কেনা (দলিল নং-১০২৩/২০১৯) হয় ০.৮৮ শতাংশ। (২১) এমদাদুল সিকদারের কাছ থেকে নূরে আলম নিজ নামে কেনেন (দলিল নং-২৯৯৬/২০১৮) ০.১৫ শতাংশ। (২২) লুৎফা বেগমের নামে হুমায়ুন কবির গং থেকে কেনা হয়  (দলিল নং-১১৩৭/২০১৮) ১.৯৪ শতাংশ। (২৩) জগৎবাজার বাণিজ্যিক এলাকায় নূরে আলমের স্ত্রী ও শ্বশুরের নামে কেনা হয় ১৫ শতাংশের প্লট।

(২৪) নিজ এলাকায় নামে-বেনামে বিপুলসম্পত্তি কিইেন তুষ্ট হননি নূরে আলম। রাজধানী সংলগ্ন পূর্বাচল পুলিশ অফিসার্স হাউজিং প্রকল্পে (আনন্দ হাউজিং) তার রয়েছে ৫ কাঠার প্লট। (২৫) উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরে রয়েছে ২ হাজার স্কয়ার ফিটের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। 

পুলিশের একজন নিরস্ত্র সাব-ইন্সপেক্টর হলেও সম্পদের পাল্লায় বড়ভাই নূরে আলমের চেয়ে কম করেননি সারে আলম। (২৬) রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মোহাম্মদীয় হাউজিং সোসাইটিতে স্ত্রীর নামে কিনেছেন ৩ হাজার স্কয়ার ফিটের ২টি বিলাস বহুল ফ্ল্যাট। মূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা। (২৭) ঢাকার কেরাণীগঞ্জ আটিবাজারে রয়েছে স্ত্রীর নামে ১ বিঘাজমি। দুই ভাইয়ের আত্মীয়-স্বজনের নামে রয়েছে তাদের বিপুল বেনামীসম্পদ ও বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে নগদ অর্থ। সব মিলিয়ে তাদের সম্পত্তির পরিমাণ শত কোটি টাকার বেশি।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, নূরে আলম-সারে আলম ব্রাদার্সের পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা সোহাগপুরে কায়েম করেছেন ত্রাসের রাজত্ব। প্রতিবাদের সাহস নেই কারও। দোর্দন্ড প্রতাপশালী সহোদর দুই পুলিশ কর্মকর্তার অর্থ-বিত্তের দাপটে তটস্থ স্থানীয়রা। টুশব্দটি করলে তাদের ভয় দেখানো হয় পুলিশ ও মিথ্যা মামলার।

দুদকের সচিব মাহবুব হোসেন আপন দেশ ডটকমকে বলেন, অভিযোগ দুদকের তফসিলভুক্ত হলে দায়মুক্তি লাভের কোনো সুযোগ নেই। তবে এই বিষয়ে সর্বশেষ অবস্থা জেনে জানাতে পারব।   

আপন দেশ/এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়